ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় খেটে খাওয়া মানুষ

প্রকাশিত: ২১:০৭, ২০ এপ্রিল ২০২১

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় খেটে খাওয়া মানুষ

গত বছর মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া করোনার মহাদুর্বিপাকে সবচেয়ে বিপন্ন অবস্থায় পড়েছে দৈনিক খেটেখাওয়া হতদরিদ্র মানুষ। আয় কমে যাওয়া থেকে শুরু করে চাকরি হারানোর মতো দুঃসময়ও তাদের মারাত্মকভাবে তাড়া করেছে। অনাহারে, অর্ধাহারে নিত্যজীবন কাটানো সেই সময়ের এক দুঃসহ করুণ অবস্থা। সেখানে বসতবাড়ির গৃহপরিচারিকা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত গাড়ির চালক ছাড়াও রিক্সা, ভ্যান এবং অটোচালকরাও পড়ে সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতিতে। ২ মাসের কঠোর অবরুদ্ধতার ক্রান্তিকালে ফুটপাথে বসা দৈনিক খুচরা ব্যবসায়ীর রুজিরোজগারকে করোনাকালে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। আবার হরেক রকম অবকাঠামো নির্মাণ শ্রমিকরাও পড়ে চরম বিপদের মুখে। এখানে শুধু চাকরি খোয়ানো কিংবা আয়-রোজগার কমে যাওয়া নয় তিল তিল করে কষ্টার্জিত অর্থের সঞ্চয়ের ওপরও পড়ে এক অনাকাক্সিক্ষত কালো ছায়া। প্রতিদিনের আয় না থাকায় জমাকৃত টাকা শুধু খরচ করেও পার পাওয়া যায়নি। বরং ঋণগ্রস্ত হয়ে আরও ভয়াবহ অবস্থায় পড়ে যাওয়া তাদের জীবনের অশুভ সঙ্কেত। সংক্রমণ জুন, জুলাই পর্যন্ত তার উর্ধগতি কমাতে ব্যর্থ হলে সে অবধি অতিসাধারণ মানুষের জীবনে তেমন কোন আশার আলো দৃশ্যমান হতে আরও সময় লেগেছে। এমন দুরবস্থায় সরকারী অর্থ ও খাদ্যপণ্য সহায়তা প্রদানে কিছুটা চাহিদা মিটলে পরিপূর্ণভাবে দিন যাপন বয়ে চলা সত্যিই এক সঙ্কটময় পরিস্থিতি মোকাবেলা করা। গতবছরের শেষ সময়ে এসব হতদরিদ্র, দিনমজুর মাথা তুলে দাঁড়াতে নানারকম দৈনন্দিন কর্মযোগে যুক্ত হয়ে প্রতিদিনের জীবন যাপনকে কোনভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। ঘুরে দাঁড়ানোর এই সময়ে নিজেদের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে না করতেই আবারও সংক্রমণকাল এসে সব তছনছ করে দিল। গত বছরের চরম স্থবিরতার আকালে নগর, শহর ও বন্দরের অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ অন্য কোন পথ খুঁজে না পেয়ে গ্রামের বাড়ির দিকেও ছুটে যেতে দেখা গেছে। গ্রামে গঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অনেকেরই সম্পৃক্ত হওয়ার চিত্রও উঠে এসেছে। পরবর্তীতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে তারা পুনরায় আগের আবাসস্থলে ফিরে এসে নতুন করে রুজিরোজগারের পথ খুলে বসতে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করতে থাকে। অনেক গৃহশ্রমিক বিশেষ করে নারীরা তাদের হারানো পেশা ফিরেও পায়। দৈনিক ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা ফুটপাথে ও বিভিন্ন বিপণি বিতানের চারপাশে তাদের সামান্য পসরা সাজিয়ে বিক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে নতুন উদ্যোমে ক্ষুদ্র পেশায় সম্পৃক্ত হতে পেরেছে। মোটামুটি বলতে গেলে বিপন্ন অর্থনীতির চাকা পুনরায় তার গতি ফিরে পেয়ে সামনে এগিয়েও চলে। ২০২০ সালের শেষের দিকে সংক্রমণ ধীরগতি ও মৃত্যু সংখ্যা কমতে থাকলে ২০২১ সালের প্রথম দুই মাস তার ধারা অব্যাহত থাকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর দ্বারপ্রান্তে এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের মাহেন্দ্রক্ষণে করোনা আবারও তার সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কাকে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে দেয়। করোনার এই দ্বিতীয় ঢেউ যেমন মাত্রাতিরিক্ত ছোঁয়াচে পাশাপাশি প্রাণঘাতী হিসেবে একে বিশেষভাবে চিহ্নিতও করা গেছে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এর ব্যাপক বিস্তার এবং মৃত্যু সংখ্যার উর্ধগতি আবারও পুরো দেশকে এক অনিশ্চয়তার যাঁতাকলে নিয়ে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা এই বহুল সংক্রমিত ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের প্রাণহরণকারী ব্যাধিটি অতি অল্প সময়ের মধ্যে কত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। শুধু তাই নয়, সংক্রমণের হারও যে প্রতিনিয়ত উর্ধগতির দিকে সেটাও সবাইকে শঙ্কায়, আতঙ্কে দিশেহারা করে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে করোনার টিকা আবিষ্কার উপস্থিত সঙ্কটের এক অবিস্মরণীয় বৈজ্ঞানিক নিরলস গবেষণা। ভ্যাকসিন শুধু আবিষ্কারই নয় দেশে দেশে বিভিন্ন মাত্রার এই ভ্যাকসিন প্রয়োগও শুরু হয়ে গেছে। আমাদের বাংলাদেশে সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ড এস্ট্রাজেনেকার টিকা ভারতের মাধ্যমে সরবরাহিত হয়ে ইতোমধ্যে টিকা প্রদান কর্মসূচীও শুরু করা হয়েছে। প্রথম সারির যোদ্ধা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এই টিকা প্রদান কার্যক্রমে অংশ নিতে পেরেছে। সরকার অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এই সরকারী টিকা সরবরাহ করতে দক্ষতার পরিচয়ও দিয়েছে। কর্মসূচীর আওতায় অনেকের দ্বিতীয় ডোজও সম্পন্ন হয়েছে। তবে টিকার কার্যকারিতার স্থায়িত্ব এখনও সময় এবং আরও গবেষণার অপেক্ষায়। সঙ্গত কারণে ভ্যাকসিন নিলেও স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এখন অবধি নিয়মের অধীন। সেটাই এখন খুব সম্ভব মানা হচ্ছে না। টিকা প্রদান শুরু হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে ফেব্রুয়ারির ১ম সপ্তাহে। আর বহুল সংক্রমণ করোনা তার নতুন বৈশিষ্ট্যে আক্রান্ত করে যাচ্ছে মার্চ মাস থেকে। এই এক মাসের মাথায় মানুষের মধ্যে চলাফেরার ক্ষেত্রে যে অবাধ গতি সেখানেই কোন লাগাম টানানো যায়নি। বার বার সতর্ক, সাবধানতায় নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করা হয়- নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে গেলে পূর্বের নিয়মবিধিকে কোনভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। গণমানুষের মধ্যে ভয়ভীতি আতঙ্ক কেটে যাওয়াটা স্বাভাবিক হলেও সাবধানতা আমলে নেয়াটাও অত্যন্ত জরুরী ছিল। যা অনেকেই বহাল তবিয়তে এড়িয়ে চলেছেন। এভাবে চলতে থাকলে তার মাসুল কিভাবে দিতে হতে পারে সেটাও সবাইকে বুঝতে হবে। শনাক্তকরণ ও মৃত্যুর হার যেভাবে লাফ দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে সেখানে আরও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা সরকারের এক অবিচল দায়বদ্ধতা। প্রথমে ৭ এপ্রিল থেকে ১২ এপ্রিল সকাল ছয়টা পর্যন্ত অবরুদ্ধ করা হলেও কেউ তা তোয়াক্কা পর্যন্ত করেনি, বিভিন্ন জায়গায় তা দৃশ্যমানও হয়েছে। ফলে আরও কঠোর নিয়মবিধিতে আবারও লকডাউনকে সম্প্রসারিত করা হয়। এবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী কঠোর অবস্থানে অবরুদ্ধতার এই সময়কে নিয়ন্ত্রণে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তবে এখনও সংক্রমণের হার কমেনি এবং মৃত্যুর সংখ্যাও ক্রমান্বয়ে বাড়ার দিকে। আর এই স্থবিরতার যাঁতাকলে পড়েছে সবচাইতে বেশি হতদরিদ্র, অসহায়, নিম্ন আয়ের মানুষ। যারা গত বছরের লকডাউনেও অনেক বেশি বিপন্ন সময়কে মোকাবেলা করেছিল। তারা সবেমাত্র ঘুরে দাঁড়িয়ে নতুনভাবে নিজেদের রুজিরোজগারকে গুছিয়ে আনতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যাচ্ছে। তারাই আজ সঙ্কটের আবর্তে আরও দুঃসহ সময়কে আলিঙ্গন করার অপেক্ষায়। গত বছরের ঋণগ্রস্ত বিভিন্ন পেশায় খেটেখাওয়া মানুষ এখনও আগের কর্জই শোধ করতে পারেনি। তাদের আবার নতুন করে প্রতিদিনের আয়ের ওপর পড়েছে অভিশাপের কালো ছায়া। দিনমজুর, রিক্সা, ভ্যান এবং অটোচালকরা তাদের রোজগারের যান নিয়ে বের হলেও যাত্রীর অভাবে তাদের নিত্য আয়ের ওপর ভাটা পড়ার প্রবণতা অনেক বেশি। অকারণে, অপ্রয়োজনে এখন মানুষ কোথাও যাচ্ছে না। সারাদিনে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা রোজাগার হতো। এখন তা অনেকের ক্ষেত্রে একেবারে শূন্যের কোঠায়। এই বছরের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি বিশ্বব্যাংক আশট করছে ২.৬ শতাংশ থেকে ৫.৬ শতাংশ। এখানে বিশ্বব্যাংক আরও বলেছে- সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষের রুজিরোজগারের ওপর আঘাত মোট জাতীয় আয় কমতির দিকে চলে যায়। কারণ এসব হতদরিদ্র, দিনমজুরই সংখ্যায় অনেক বেশি। সেখানে সরকারকে নগদ অর্থ সহায়তা থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে তাদের যাপিত জীবনের মানসম্মত ব্যবস্থা তৈরি করে দিতে হয়। এর অন্যথা হলে নি¤œ আয়ের গরিব মানুষের বিবর্ণ চিত্র যেমন শঙ্কিত হবার মতো একইভাবে মোট জাতীয় আয়ের ওপরও পড়ে এক অবর্ণনীয় দুর্দশা। গত বছরের লকডাউনে আমরা দেখেছি ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে খাদ্য সহায়তা দিতে। এছাড়া নগর অভিভাবকরাও সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে বিপন্ন মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীও সামাজিক দূরত্ব মেনে নিম্নবিত্তদের মধ্যে খাদ্য সহায়তা প্রদান সেই দুর্যোগ সময়ের এক অনন্য কর্মযোগ। স্থানীয় জেলা প্রশাসকরাও খুব বেশি পিছিয়ে ছিলেন না। নিজ নিজ এলাকায় হতদরিদ্র মানুষের মধ্যে খাদ্যপণ্য বিতরণ করে নিজেদের অর্পিত দায়িত্বের প্রতি সম্মানও দেখিয়েছেন। আবার জাতীয় সংসদ সদস্য এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও অতি সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কার্পণ্য করেননি। এসব শুধু দৃষ্টান্ত নয়, এই মহৎ কাজকে আবারও বেগবান করে সংশ্লিষ্টদের পাশে দাঁড়ানো সময়ের অনিবার্য দাবি। মানুষ মানুষের জন্য এমন অমৃত বাণী অতি দুঃসময়ে তার আপন মহিমায় সম্প্রসারিত হতেও সময় নেয় না। এবারের অবরুদ্ধতার কঠিন জালে দেশ আটকে পড়লে অসংখ্য মানুষের রুজি-রোজগারে যে বেহাল দশা সংশ্লিষ্টদের বিপন্ন করে দিতে পারে তেমন আশঙ্কা বিচলিত হওয়ার মতোই। করোনার লাগাতার দুর্ভোগে জনজীবনে এখনও কোন স্বস্তি আসেনি। অর্থনীতির চাকা সচল রাখা হলেও হরেক রকম বিপর্যয়কেও সবসময় মোকাবেলা করতে হয়। অভ্যন্তরীণ ব্যবসাবাণিজ্যেও দুরারোগ্য ব্যাধির টানাপোড়েনে হিমশিম খেতে হয়। বহির্বাণিজ্যেও পড়ে এর নেতিবাচক প্রভাব। রফতানি সঙ্কটে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও প্রাসঙ্গিক বিপত্তি মাথা চাড়া দেয়। সেখানে পোশাক শিল্প কারখানার মজুরী-শ্রমিকদের বেহাল দশা গত লকডাউনেও দৃশ্যমান হয়েছে- এবারে তা কোন্ পর্যায়ে যাবে সেটাও সময়ের নির্ধারণের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। পোশাক খাতে সরকারী প্রণোদনা গত বছরে সংশ্লিষ্ট মালিকদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সেখানে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরিতে যে কাটাছেঁড়া করা হয় তাও সে সময়ের এক অসহনীয় দুর্ভোগ। উপস্থিতির হারে বেতন নির্ধারণ হলেও তা হবার কথা ছিল না। সেখানেও শ্রমিকরা নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হয়। সরকারী প্রণোদনায় মালিকরা লাভবান হলেও মূল নিয়ামক শক্তি দৈনিক শ্রম বিনিয়োগ করা মজুরী শ্রমিকদের তাদের প্রত্যাশিত বেতনটুকু পেতেও হিমশিম খেতে হয়েছে। লেখক : সাংবাদিক
×