ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় ওয়াসিম

প্রকাশিত: ২২:১২, ১৯ এপ্রিল ২০২১

বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় ওয়াসিম

গৌতম পান্ডে ॥ ‘দি রেইন’, ‘ডাকু মনসুর’, ‘জিঘাংসা’, ‘কে আসল কে নকল’, ‘দুই রাজকুমার’, ‘সওদাগর’, ‘নরম গরম’, ‘চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা’, ‘রাজমহল’সহ অনেক ব্যবসাসফল সিনেমার নায়ক ওয়াসিম। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রে শীর্ষ নায়কদের একজন ছিলেন তিনি। ফোক ফ্যান্টাসি আর এ্যাকশন ছবির অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেতা ছিলেন তিনি। অভিনয় জীবনে ১৫২টির মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন চলচ্চিত্রের সোনালি দিনের চিত্রনায়ক ওয়াসিম। রবিবার (১৮ এপ্রিল) বাদ জোহর বনানী কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। শনিবার (১৭ এপ্রিল) দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় মারা যান ওয়াসিম। রবিবার (১৮ এপ্রিল) বাদ জোহর গুলশান আজাদ মসজিদে মরহুমের প্রথম জানাজা হয়। এরপর বনানী কবরস্থানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তার লাশ দাফন করা হয়। এ সময় তাকে শেষ বিদায় জানাতে হাজির হয়েছেন মিশা সওদাগর, জায়েদ খান, চলচ্চিত্র প্রযোজক ইকবালসহ চলচ্চিত্রাঙ্গনের অনেকে। এ্যাকশন, বিশেষ করে ফোক-ফ্যান্টাসি সিনেমার এক নম্বর এই নায়ক গত কয়েকদিন ধরে বাসায় শয্যাশায়ী ছিলেন। পরিবার থেকে জানানো হয়েছিল তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু করোনা মহামারীর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ। এজন্য উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নিয়ে যেতে পারেনি পরিবার। ব্রেন, নার্ভ ও হার্টের সমস্যায় ভুগছিলেন বরেণ্য এই অভিনেতা। অসুস্থ হওয়ার পর তাকে রাজধানীর এভার কেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে বাসায় নিয়ে যেতে বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে তখন ওয়াসিমের মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়া শেষ। বলছি ১৯৭০ সালের কথা। সেই সময়ই সিনেমা ভাগ্য তাকে আঁকড়ে ধরে। গুলিস্তানের ফিল্ম পাড়া থেকে তার ডাক আসে। নিজে যোগ্য কী না এমন প্রশ্নই ছুড়ে দিয়েছিলেন ওয়াসিম প্রথমদিনে তাকে ডাকা পরিচালক মোহসীন, নাসিমা খান, আহমাদ জামান চৌধুরী খোকাকে। যাচাইয়ের পর ওয়াসিম নায়ক হিসেবে পরিপূর্ণ, যেন তারই প্রমাণ মিলে। শুরু হলো নায়োকোচিত জীবনের পথচলা। মোহসীন পরিচালিত ‘রাতের পর দিন’ চলচ্চিত্রে ববিতার বিপরীতে একজন সাধারণ ছেলের চরিত্রে অভিনয়ের মধ্যদিয়ে শুরু হয় ওয়াসিমের নায়ক জীবন। প্রথম চলচ্চিত্রেই নায়ক হিসেবে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এরপর টানা ত্রিশ-চল্লিশটি সুপার ডুপারহিট চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। সে সময় তার জীবনের ঘড়ির কাঁটায় কখন রাত হয়েছে কখন দিন এসেছে তা তিনি নিজেই জানতেন না। শুধু কাজ করতেন। দর্শকের ভাললাগা ভালবাসার জন্যই ছিল তার নিবেদিত জীবন। পরিচালকদের চেষ্টায়, দর্শকের ভালবাসায় তিনি ওয়াসিম হয়ে উঠেন। দর্শকের মাঝেই তার আজীবন বেঁচে থাকার ব্যাকুলতা ছিল। ওয়াসিমের পারিবারিক নাম মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ। পরিচালক মোহসীন তার নাম রাখেন ‘ওয়াসিম’। চাঁদপুরের সন্তান ওয়াসিমের পরিবার থাকতেন পুরান ঢাকায়। তার বাবা এ বি মোজাম্মেল হক, মা খুরশীদা বেগম। ২৩ মার্চ জন্ম নেয়া এই কিংবদন্তী নায়কের একমাত্র ছেলে ফারদুন একজন ব্যারিস্টার। বোম্বের রাজকাপুরের সহকারী ছিলেন এদেশের প্রয়াত কিংবদন্তী পরিচালক মমতাজ উদ্দীন। তিনিই ওয়াসিমকে নিয়ে দ্বিতীয় চলচ্চিত্র নায়িকা কবিতার বিপরীতে নির্মাণ করেন ‘কে আসল কে নকল’ সিনেমাটি। প্রথম চলচ্চিত্র আর দ্বিতীয় চলচ্চিত্রের সফল ধারাবাহিকতায় এক অন্যরকম উচ্চতায় পৌঁছান ওয়াসিম। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। তখন শুধু সামনের দিকেই তার নায়ক হিসেবে এগিয়ে যাবার পালা ছিল। একে একে ইবনে মিজানের ‘রাজদুলারী’, ‘ডাকু মনসুর’, ‘চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা’সহ এসএম সফির ‘দি রেইন’, মমতাজ আলীর ‘ঈমান’, দেওয়ান নজরুলের ‘দোস্ত দুশমন’,‘আসমান জমিন’, ‘ধর্ম আমার মা’, ‘আসামী হাজির’ এবং অন্যান্য পরিচালকের ‘প্রিন্সেস টিনা খান’, ‘বেদ্বীন’, ‘লুটেরা’, ‘আকাশ পরী’, ‘নূরী’ , ‘নরম গরম’, ‘প্রাণ সজনী’, ‘দুলারী’, ‘জিপসী সর্দার’, ‘শিরি ফরহাদ’, ‘চন্দনা ডাকু’, ‘আবেহায়াত’, ‘সাক্ষী’, ‘বিনি সুতার মালা’, ‘বানজারান’, ‘রসের বাইদানী’,‘ লাল মেম সাহেব’সহ আরও বহু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। প্রতিটি চলচ্চিত্রেই ওয়াসিমে’র অনবদ্য অভিনয় দর্শককে মুগ্ধ করেছে। মমতাজ আলীর ঈমান চলচ্চিত্রে তিনি তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন যা আমাদের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিরল। নায়কের নায়োকোচিত উপস্থিতি পর্দায় থাকাবস্থাতেই একটা সময় নিজেকে আড়াল করে নেন। কিন্তু এখনও তিনি সেই যুবক বয়সের আদলেই নিজেকে ধরে রেখেছেন। নিজের প্রযোজনা সংস্থা ডাব্লিউ আর প্রোডাকশন থেকে নির্মাণ করেছিলেন ‘মোহন বাঁশি’, ‘হিসাব চাই’ ও ‘নয়া তুফান’ চলচ্চিত্র। তার মৃত্যুতে চলচ্চিত্র পরিবারে আরও শোক নেমে আসে। কারণ তার আগের দিনই চলচ্চিত্র পরিবার কবরীকে হারিয়েছে।
×