ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে পিতার সম্পত্তিতে হিন্দু মেয়েদের অধিকার

প্রকাশিত: ২০:১৬, ১৯ এপ্রিল ২০২১

বাংলাদেশে পিতার সম্পত্তিতে হিন্দু মেয়েদের অধিকার

আলোচ্যসূচীর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন। উল্লেখ্য, হিন্দু ধর্মের মূল ভিত্তি বেদ এবং হিন্দু আইন হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত আইন। সে কারণে বেদকেই হিন্দু আইনের মূল উৎস হিসেবে ধরে নেয়া হয়। হিন্দু বিশ্বাস মতে অতি প্রাচীনকালে দেবতাগণ প্রত্যক্ষভাবে যেসব বলেছিলেন এবং মুনিগণ যা শ্রবণ করেছিলেন পরবর্তী সময়ে ওই শ্রবণ তথা শ্রুতির ওপর ভিত্তি করে মুনিবর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদ সঙ্কলন করেন। এ ছাড়া প্রাচীনকালে ঐশ্বরিক নির্দেশাবলী, যা আর্যঋষিগণ গুরুশিষ্য পরম্পরায় স্মৃতিতে রেখেছিলেন এবং মুনিগণ পরবর্তীতে সঙ্কলন করেছিলেন, তাই সংহিতা বা স্মৃতিশাস্ত্র নামে খ্যাত। এই সংহিতাগুলোকে ধর্মশাস্ত্র বলা হয়। এতদ্ব্যতীত এ উপমহাদেশে হিন্দু আইনের উৎস বলে পরিগণিত আইনগত প্রতিষ্ঠিত বহুবিধ প্রথাসহ নানা উৎস-উপাদানও রয়েছে। একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, ভারতবর্ষে হিন্দু আইনে এক যুগান্তকারী, বৈপ্লবিক ও ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। ১৯৫৬ সালে Hindu Disposition of Property Act ভারতে পাস হওয়ার ফলে পিতার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে পুত্র ও কন্যা সন্তানের সমানাধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। উত্তরাধিকার আইনে ভারতীয় এই সংশোধনীতে কন্যা, বিধবা মহিলা ও অন্য নারী উত্তরাধিকারীরা বর্তমানে জীবনস্বত্বের পরিবর্তে সম্পূর্ণ স্বত্বের অধিকারী হয়। সেই প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা বৈষম্যমূলক হিন্দু আইন ধর্মীয় সংস্কারমুক্ত হয়ে মানবিক এবং যৌক্তিক অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। প্রসঙ্গত, প্রতিবেশী দেশ নেপালেও কন্যা-সন্তানরা পিতার সম্পত্তির সমঅধিকার ভোগ করে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশের মেয়েদের দুর্ভাগ্য যে, আজ অবধি পৈত্রিক সম্পত্তিতে তাদের কোন রকম অধিকার নেই। হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের ভারতীয় সংশোধনী বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর প্রযোজ্য না হওয়ার যথার্থ কারণ থাকতে পারে না। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিকভাবে ভারতের সঙ্গে আমাদের যেমন অতি নিকট সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যিক সম্বন্ধও বিদ্যমান। প্রসঙ্গত এ উপমহাদেশে বাঙালী সমাজে হিন্দু নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত প্রথার নাম সতীদাহ। এ ধরনের ধর্মীয় কু-প্রথার নামে দীর্ঘকালব্যাপী এ উপমহাদেশে লাখ লাখ হিন্দু মেয়েকে অত্যন্ত নির্মম, নির্দয়ভাবে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। বাঙালী পন্ডিত ও সমাজ সংস্কারক রাজা রাম মোহন রায়ের সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে সতীদাহ প্রথাকে বাতিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে কলঙ্কজনক এ প্রথার অবসান ঘটে। সেদিনও কিন্তু হিন্দু সমাজের একদল মানবরূপী দানব এ আন্দোলনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে মামলা করেছিলেন। হিন্দু নারী মুক্তির আর এক স্বনামধন্য পন্ডিত ও মানবহিতৈষী ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একশ্রেণীর হিন্দু সমাজপতির বাধার সম্মুখীন হয়েও ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু বিধবা নারীদের পুনর্বিবাহ বৈধ করা হয়। বাঙালী নারী জাগরণের আরও এক পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া বিশ শতকের প্রারম্ভে মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার আলোকে দীপান্বিত করে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। বাংলাদেশে প্রচলিত তথাকথিত হিন্দু আইনের বেড়াজালে হিন্দু মেয়েরা অত্যন্ত অসহায়ভাবে, আর্থিকভাবে ক্ষমতাহীন অবস্থায় এক প্রকার ভাসমান পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাদের সারাটি জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবারের কোন না কোন পুরুষ সদস্যের মুখাপেক্ষী হয়ে অমর্যাদা, অবহেলায়, উপেক্ষায় পারিবারিক দায়িত্ব পালনে বাঁধা থাকেন তারা। আর জীবনের শুরুতে পিতার অধীনে, মধ্যখানে স্বামীর এবং পরবর্তীতে পুত্র-সন্তানের কর্তৃত্বে-নিয়ন্ত্রণে জীবনের শেষ দিন অবধি লতানো বৃক্ষের মতো পরাশ্রিত জীবনের ভার বহন অব্যাহত রাখতে হয়। একুশ শতকের এই আধুনিক পৃথিবীতে এসেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি আমাদের কন্যাসন্তানদের প্রাপ্য উত্তরাধিকার ফিরিয়ে দিয়ে তাকে মানবিক মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে। অধিকারহীন এই সন্তানরা নীরবে নিভৃতে কেঁদে চলেছে দীর্ঘকাল ধরে। সমাজপতিরা বুঝেও বুঝতে চায় না, দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না। আরও আছে অন্তর্বোধে মৌলবাদ, কূপমন্ডকতা, পশ্চাৎপদতা ও সঙ্কীর্ণতার বেড়াজাল এবং মূঢ়তার অন্ধকার যেখানে জ্ঞানের আলো পৌঁছায় না, মুক্তবুদ্ধির চর্চা যেখানে অনুপস্থিত। প্রকৃতির সমস্ত সৃষ্টি-প্রল্ডিয়া এমনই যে, কোন পক্ষ থেকেই প্রভাব বিস্তারের কোন ধরনের সুযোগ প্রায় নেই। পৃথিবীতে মানুষের সৃষ্টিতে নারী শক্তিকে আদ্যাশক্তি বলে বিবেচনা করা হয়। সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে মানব শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণে নারী কিংবা পুরুষ কারোরই কর্তৃত্ব নেই। কিন্তু দায়ী করার প্রশ্ন উত্থাপিত হলে বৈজ্ঞানিকভাবে এক্ষেত্রে দায় পুরুষের ওপরই বর্তায়। এই প্রেক্ষাপটে পুত্র ও কন্যার অধিকার এবং মর্যাদার জায়গাটি কোন বিচারেই ভেদযুক্ত হতে পারে না। সম্পত্তিতে সমান অধিকার- এটি এ সময়ের অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত দাবি। নারী হোক বা পুরুষ হোক তার প্রথম পরিচয় সে মানুষ। উনিশ শতকে স্বামী বিবেকানন্দ বলে গেছেন, ‘পাখি যেমন এক ডানায় ভর করে উড়তে পারে না, তেমনি নারী জাতির অবস্থার উন্নতি না হলে জগতের উন্নতি সম্ভব নয়। কোন জাতির উন্নতির মাপকাঠি হলো সেই জাতিতে নারীর মর্যাদার স্থান।’ উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হলো, বাঙালীর সহ বছরের কাক্সিক্ষত জাতিরাষ্ট্র একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বাহাত্তরের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রদত্ত হয়েছে। ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, ভাষা ও লিঙ্গ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমানাধিকারের বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে আমাদের এ সংবিধানে। এরই নিরিখে সরকারসহ যথাযথ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি এ আইন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসা সময়ের দাবি। বিচক্ষণ, দূরদর্শী, প্রজ্ঞাবান এবং উদার আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পিতার সম্পত্তিতে সন্তানের অধিকারের বিষয়টি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে সনির্বন্ধ অনুরোধ, সদর্থক দৃষ্টি দিয়ে অধিকার বঞ্চিত হিন্দু মেয়েদের দীর্ঘকালের এ ইস্যুটির সমাধানে এগিয়ে আসার জন্য। ২০১২-এ ১৭ আগস্ট বিবিসি বাংলায় ‘হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে সংশোধনীর প্রস্তাব’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। উক্ত প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয় যে, বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়েরা যাতে পিতার সম্পত্তিতে সমান অধিকার পান, সেই লক্ষ্যে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংশোধনের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশের আইন কমিশন। কমিশন বলছে, উত্তরাধিকার সূত্রে পুত্রের সঙ্গে কন্যাকেও পূর্ণ ও সমানাধিকার দিতে হবে। আইন কমিশন আরও বলছে তাদের মাঠপর্যায়ের গবেষণা দ্বারা তারা এর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সময়ের দাবি বলে মনে করছেন। আর এ লক্ষ্য পূরণে প্রচলিত হিন্দু আইনের সংস্কারের জন্য কমিশনের সুপারিশসমূহ একটি পূর্ণাঙ্গ আইন করে কার্যকর করার জন্য সরকারের নিকট সুপারিশ করা হয়েছে। সম্পত্তিতে মেয়েদের সমানাধিকারের বিষয়টিতে সমাজের অধিকাংশ মানুষ স্বাগত জানিয়েছেন। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিম-লীর কোন কোন সদস্যও এ বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখেছেন। অবশ্য হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ মনে করছেন বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা হিন্দু আইন সংস্কারের উপযোগী নয়। সমাজ ব্যবস্থার কথা তুলে যে বক্তব্য উত্থাপিত হয়েছে সেটি হলো জাতিচ্যুতি অথবা ধর্মান্তরের ঘটনা। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এ মত গ্রহণযোগ্য নয়। তবে ধর্মান্তরিত হলে হিন্দু নারী বা পুরুষ যে কোন পরিস্থিতিতে তার উত্তরাধিকার সম্পত্তির অধিকার হারাবেন- এই বিধান রেখেই দ্রুত হিন্দু উত্তরাধিকার আইন পাস করা হোক। অতি আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো যে, গত ৩০ মার্চ ২০২১-এ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ‘হিন্দু উত্তরাধিকার আইন : সংস্কারের প্রস্তাব’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই বৈঠকের সহযোগিতায় ছিল দেশের বহুল প্রচারিত প্রত্রিকা প্রথম আলো। ৩১ মার্চ ২০২১-এ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় উল্লিখিত পত্রিকায়। এই বৈঠকে স্বপন ভট্টাচার্য্য, নিমচন্দ্র ভৌমিক, আরমা দত্ত, ছায়া ভট্টাচার্য্য এবং রিনা রায়ের মতো স্বনামধন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আলোচনায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন। তারা সবাই দ্রুত হিন্দু উত্তরাধিকার আইন পাসের আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়া আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এ আলোচনায় অংশ নিয়ে এ আইনের পক্ষে মত দিয়েছেন। বিশেষত বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি নিমচন্দ্র ভৌমিক এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক রিনা রায়- এ বিষয়টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। তবে তারা সবাই যে বিষয়ে অতীব গুরুত্ব দিয়েছেন সেটি হলো ধর্মান্তর। ধর্মান্তরিত হলে হিন্দু নারী-পুরুষ উত্তরাধিকার সম্পত্তির অধিকার হারাবেন- এই বিধান রেখেই দ্রুত হিন্দু উত্তরাধিকার আইন পাসের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন সবাই। আর এর প্রেক্ষাপটে দীর্ঘকালের বিভেদপূর্ণ ধর্মনীতি নির্ভর অন্যায় ও বেআইনী এই প্রথার অবসানের মধ্য দিয়ে নারী অধিকার ও নারী মুক্তির এ বিষয়টি আলোর মুখ দেখবে বলেই প্রত্যাশা। লেখক : রাজনীতি ও সমাজ বিশ্লেষক [email protected]
×