ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিজ ফ্ল্যাট থেকে তারেক শামসুর রেহমানের মরদেহ উদ্ধার

প্রকাশিত: ২৩:২৯, ১৮ এপ্রিল ২০২১

নিজ ফ্ল্যাট থেকে তারেক শামসুর রেহমানের মরদেহ উদ্ধার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর উত্তরার নিজ ফ্ল্যাট থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তারেক শামসুর রেহমানের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। শনিবার দুপুরে পুলিশ রাজউকের উত্তরা এ্যাপার্টমেন্টের তার ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙ্গে লাশ উদ্ধার করে। পুলিশের উত্তরা জোনের এসি শচীন মৌলিক জনকণ্ঠকে জানান, স্থানীয়রা খবর দিলে বেলা ১১টার দিকে থানা পুলিশ তারেক শামসুর রেহমানের উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টরের রাজউক এ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টের চার নম্বর সড়কের ১২/এ দোলনচাঁপা-২ এর ফ্ল্যাট থেকে তার লাশ উদ্ধার করেছে। এক পা বাথরুমে এবং শরীরের বাকি অংশ রুমের ফ্লোরে পড়ে ছিল। স্ট্রোকে নাকি অন্য কোন কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। তা নিয়ে তদন্ত চলছে। তবে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিল রোগে ভুগছিলেন। তিনি এই ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন। তার স্ত্রী ও ছেলে আমেরিকায় থাকেন। গতকাল রাতে সর্বশেষ এক প্রতিবেশীর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। সকালে তারাই পুলিশে খবর দিয়েছেন। সহকারী পুলিশ কমিশনার শচীন মৌলিক জানান, আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, অধ্যাপক শামসুর রহমানের রোগের কারণে মৃত্যু হয়েছে। তবে আমরা সব বিষয়কে সামনে রেখেই তদন্ত করছি। খাদ্য বিষক্রিয়ার কারণে তার মৃত্যু হতে পারে। বিছানার ওপর স্যালাইনের প্যাকেট ছিল। বিছানায় তিনি বমিও করেছে। পরে তিনি বাথরুমে বমি করতে গিয়ে পড়ে যান। এতে তার নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হওয়ার চিহ্ন ছিল। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে। খবর পেয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের ক্রাইমসিন টিম ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করছে। আলামত সংগ্রহ শেষে তার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। দোলনচাঁপা ভবন-২ এর ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সেক্রেটারি মোহাম্মদ আলী দেওয়ান জানান, শনিবার সকাল পৌনে ৮টার দিকে তার কাজের বুয়া এসে কলিং বেল চাপে। কিন্তু ভেতর থেকে কোন সাড়া না পেয়ে চলে যায়। সে আরেক বাসায় কাজ করে এসে আবার কলিং বেল চাপে। তখনও সাড়া না পেয়ে ভবনের নিচে কেয়ারটেকারকে বিষয়টি জানায়। এরপর কেয়ারটেকার আমাকে বিষয়টি জানালে আমি পুলিশে খবর দেই। পরে দুপুর ১২টার পর তুরাগ থানা পুলিশের একটি দল এসে শিক্ষক ও কলামিস্ট ড. তারেক শামসুর রেহমানের ১৩০৪ নম্বর ফ্ল্যাটের দরজায় ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে প্রবেশ করে বাথরুমের দরজার সামনে তার নিথর দেহ দেখতে পায় পুলিশ। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বাথরুমের দরজার সামনে বমির ওপর পড়েছিল শামসুর রেহমানের মরদেহ। এ সময় তার পা ছিল বাথরুমের ভেতর। বাকি শরীর ছিল দরজার সামনে। তার শরীরে ছিল সাদা রঙের সেন্টু গেঞ্জি ও কালো রঙের প্যান্ট। আর তার ডান পায়ে ছিল মোজা। মাহমুদ হাসান মাসুম নামে এক প্রতিবেশী জানান, দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন। আমি স্যারকে একাধিকবার শ্বাসকষ্টজনিত রোগের ওষুধ এনে দিয়েছি উত্তরা থেকে। এদিকে শামসুর রেহমানের খালাত ভাই বদরুল আলম বলেন, তার স্ত্রী ও কন্যা সন্তান যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তিনি একাই ফ্ল্যাটে থাকতেন। তার স্ত্রী এবং সন্তানের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। এ ছাড়া তার আপন ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। তাদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী করণীয় আমরা ঠিক করব। তবে আমার জানা মতে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। রাজউক এ্যাপার্টমেন্টের এ-ব্লকের ফ্যাট মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক মাহমুদুল হোসেন রাসেল বলেন, ওনার উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ এ্যাজমার প্রবলেম ছিল। তার ভবনে থাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক শফিকুর রহমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, সকাল থেকে তার (ড. তারেক শামসুর রেহমান) কোন যোগাযোগ না পাওয়ায় ফ্ল্যাটের স্বত্বাধিকারীরা পুলিশকে অবহিত করেন। পুলিশ এসে দরজা ভেঙ্গে তাকে মৃত দেখেন। তুরাগ থানার ডিউটি অফিসার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আসমাউল হুসনা জানান, দুপুর ১টার দিকে সংবাদ পেয়ে পুলিশ ফোর্স ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। তার ঘরের দরজা ভেতর থেকে লাগানো ছিল। পুলিশ দরজা ভেঙ্গে মরদেহ উদ্ধার করেছে। ওসি মোঃ মেহেদি হাসানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল সেখানে কাজ করছে। মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে প্রাথমিক কোন তথ্য জানাতে পারেননি তিনি। তারেক শামসুর রেহমান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার ও রাজনীতি বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক সদস্য ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী সম্পন্ন করা তারেক শামসুর রেহমান জার্মানি থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের আইভিপি ফেলো ছিলেন। জাবিতে অধ্যাপনার পাশাপাশি ড. রেহমান নিয়মিত কলাম লিখছিলেন। প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে তার কলাম নিয়মিত ছাপা হতো। দুই দশক ধরে বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়া ও বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে তার অনেক গ্রন্থ রয়েছে। বই লেখার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে কলাম লিখতেন। দেশের অন্যতম সেরা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। বছর দুই আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরে যান এই শিক্ষক। তিনি উত্তরায় নিজ ফ্ল্যাটে একাই বসবাস করতেন। তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ইরাক যুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনীতি, গণতন্ত্রের শত্রু-মিত্র, নয়া বিশ্বব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বিশ্ব রাজনীতির চালচিত্র, উপআঞ্চলিক জোট, ট্রানজিট ইস্যু ও গ্যাস রফতানি প্রসঙ্গ, বাংলাদেশ: রাষ্ট্র ও রাজনীতি, বাংলাদেশ: রাজনীতির ২৫ বছর, বাংলাদেশ: রাজনীতির চার দশক, গঙ্গার পানি চুক্তি: প্রেক্ষিত ও সম্ভাবনা, সোভিয়েত-বালাদেশ সম্পর্ক, বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর ইত্যাদি। ইউজিসির শোক ॥ অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী শহীদুল্লাহ। এক শোকবার্তায় ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান একজন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ছিলেন। তিনি তার গবেষণা ও লেখনির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি ও বৈদেশিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। ইউজিসি চেয়ারম্যান তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
×