ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন রায়

জার্মান কোম্পানির অর্থ কেলেঙ্কারি এবং ফিলিপিন্সের ব্যাংক

প্রকাশিত: ২১:০১, ১১ এপ্রিল ২০২১

জার্মান কোম্পানির অর্থ কেলেঙ্কারি এবং ফিলিপিন্সের ব্যাংক

বছর দুয়েক আগে আমি একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিয়েছিলাম। সেই প্রযুক্তির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা একটি কথাই বারবার বলার চেষ্টা করেছেন যে, এই নতুন প্লাটফর্মটি অনেক বেশি আধুনিক এবং নিরাপদ। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক ঝুঁকি ও সমস্যাই লাঘব করা সম্ভব হবে, যা পুরাতন প্রযুক্তি দ্বারা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে আমি তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে, এই প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনরকম ঝুঁকিই কি থাকবে না? তারা সরাসরি উত্তর না দিয়ে পরোক্ষভাবে এই বলে আশ্বস্ত করল যে, নতুন প্রযুক্তি সবসময়ই পুরাতন প্রযুক্তির চেয়ে বেশি আধুনিক ও নিরাপদ এবং এর মাধ্যমেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমি প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলাম, এক সময় টেলেক্সের পরিবর্তে সুইফট আবিষ্কার হলো। সেই সুইফট কর্তৃপক্ষও আজকের দিনের মতো জোরগলায় দাবি করেছিল যে, এই আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে জালিয়াতির ঝুঁকি নেই বললেই চলে। পরবর্তীতে দেখা গেল এই সুইফট চালু হবার পর আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ অর্থ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে তার সামান্যতমও ঘটেনি যখন টেস্টভিত্তিক টেলেক্সের মাধ্যমে লেনদেনের আদান-প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশ বাংক এই আধুনিক সুইফটের মাধ্যমে অর্থ জালিয়াতির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। আমার এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের তেমন কোন গ্রহণযোগ্য মন্তব্য ছিল না, থাকার কথাও নয়। আসলে প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের যেভাবে আঁকড়ে ধরেছে এবং যতটা নির্ভরশীল করে তুলেছে তাতে ভালমন্দ যাই হোক না কেন, আমাদের নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। একের পর এক নতুন প্রযুক্তি আসবে এবং বিশ্বের নামী-দামী, ছোট-বড়, সরকারী-বেসরকারী নির্বিশেষে সকল প্রতিষ্ঠান এগুলো গ্রহণ করে আধুনিকতার নতুন মাত্রায় নাম লেখাবেন এটিই বর্তমান সময়ের বাস্তবতা। আর সেইসঙ্গে একের পর এক ঘটতে থাকবে শিউরে উঠার মতো সব অর্থ কেলেঙ্কারি বা জালিয়াতির ঘটনা। এসব অর্থ কেলেঙ্কারি বা জালিয়াতির অধিকাংশ ঘটনা মানুষের অগোচরেই থেকে যায়। যে সামান্য কিছু ঘটনা জনসমক্ষে আসে তাই একেবারে আঁতকে উঠার মতো। লাইবর রেট কেলেঙ্কারি, প্রেসাস মেটাল লেনদেন কেলেঙ্কারি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার কেলেঙ্কারি, সাবপ্রাইম মর্টগেজ কেলেঙ্কারি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইকুয়েডরের ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ প্রভৃতি স্মরণকালের ভয়াবহতম অর্থ কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতির ঘটনা। লাইবর রেট কেলেঙ্কারির ঘটনা এতই ভয়াবহ ছিল যে, এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় বেঞ্চমার্ক রেটের যবনিকাপাত ঘটিয়ে ছেড়েছে। উল্লেখ্য, আগামী বছর থেকে বিশ্বের সর্বাধিক এই জনপ্রিয় লাইবর রেট বন্ধ হয়ে যাবে। এসব অর্থ কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতির সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে জার্মানির এক নামকরা কোম্পানির বিশাল অঙ্কের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা। জার্মানি কোম্পানি ওয়ারকার্ডের (Wirecard) দুই বিলিয়নের অধিক অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা ধরা পড়েছে। ওয়ারকার্ড জার্মানির একটি বৃহৎ কোম্পানি যাদের অটোমোটিভ এবং প্রকৌশল কাজে রয়েছে বিশেষ দক্ষতা এবং সুনাম। বিশ্বব্যাপী এই কোম্পানি অনলাইন পেমেন্ট প্রসেস করার মাধ্যমে ১.৯০ বিলিয়ন ইউরো মুনাফা অর্জন করে, যা ডলারে প্রায় দুই বিলিয়নের ওপরে। এই সমুদয় মুনাফা তারা তাদের বাৎসরিক হিসাবেও যথারীতি প্রদর্শন করে। কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মারকুস ব্রন (গধৎশঁং ইৎধঁহ) জার্মানিতে এই কোম্পানির খুবই সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখান। তিনি জার্মানি সরকারের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে বেশ সখ্য গড়ে তোলেন, যাদের অনেকে এই কোম্পানির প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করে ভূয়সী প্রশংসাও করেছিলেন। এর মধ্যেই এই দুই বিলিয়ন ডলারের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ পায় এবং মুহূর্তের মধ্যেই সবকিছু তছনছ হয়ে যায়। কোম্পানির দেউলিয়া হতে আর কিছু বাকি ছিল না। সেইসঙ্গে প্রধান নির্বাহীকে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল। এই বিশাল অঙ্কের অর্থ কেলেঙ্কারির মূল হোতা ছিলেন প্রধান অর্থ কর্মকর্তা বা সিএফও জন মারসালেক (Jon Marsalek)। তিনি ঘটনা ফাঁস হবার পর থেকেই আত্মগোপনে গেছেন এবং ইন্টারপোলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছিল। সিএফও মারসালেককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বিশ্বব্যাপী ব্যবসার প্রসার ঘটানোর জন্য। এরই অংশ হিসেবে তার নেতৃত্বে অসংখ্য অনলাইন পেমেন্ট বা লেনদেন প্রসেস করা হয়েছিল, যেগুলো সরাসরি জুয়া বা অন্যান্য অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত। এমনকি পেমেন্ট প্রসেস করার সময় সংশ্লিষ্ট পক্ষের পরিচিতিও গোপন রাখা বা ধুয়াসার মধ্যে রাখা হয়েছে। এই ধরনের লেনদেন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এসব অভিযোগ অতীতে ওয়ারকার্ড কোম্পানির বিরুদ্ধে উঠলেও কেউ আমলে নেয়নি, কেননা জার্মানি কোম্পানি বলে কথা। মারসালেক তার নিজস্ব বলয়ের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে অসংখ্য ভুয়া লেনদেন প্রসেস করেন, যার মাধ্যমে ১.৯০ বিলিয়ন ইউরো বা দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি মুনাফা কোম্পানির হিসাবে দেখান। এই মুনাফার সম্পূর্ণ অর্থই ফিলিপিন্সের বিডিও ইউনিব্যাংকে এবং ব্যাংক অব ফিলিপিন্স আইল্যান্ডে গচ্ছিত আছে বলে দাবি করা হয়। কোম্পানির এমন দাবির সত্যতা নিরূপণের জন্য কেপিএমজি নিরীক্ষা দলের কয়েক সদস্য সশরীরে উপস্থিত হয়ে সেই ব্যাংক দুটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে গচ্ছিত দুই বিলিয়ন ডলারের সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করেন। গত বছর মার্চ মাসে থমাস একেলম্যান নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে কোম্পানির দায়িত্ব নেয়ার পর বিষয়টি নিয়ে তার সন্দেহ হয় এবং তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে তিনি ফিলিপিন্সের ব্যাংকে গচ্ছিত ১.৯০ বিলিয়ন ইউরো থেকে একশত মিলিয়ন ইউরো জার্মানির কোন ব্যাংকের কোম্পানির হিসাবে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। সিএফও মারকালেস জার্মানি থেকে ফিলিপিন্সের ব্যাংকে সেই পরিমাণ অর্থ পাঠিয়ে তা পুনরায় জার্মানির ব্যাংকের কোম্পানির হিসাবে নিয়ে এসে বিষয়টির সত্যতা প্রমাণের বৃথা চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয়নি। অবশেষে ঘটনাটি জানাজানি হয়ে যায়। ফলে ওয়ারকার্ড কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের মাথায় হাত পড়ে। কেননা মুহূর্তের মধ্যে কোম্পানির শেয়ারমূল্যের ৯৯% দরপতন ঘটে এবং সেইসঙ্গে কোম্পানিটি দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আবেদন করে। ওয়ারকার্ড কোম্পানি মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায় যে, মারসালেকের মাধ্যমে ১.৯০ বিলিয়ন ইউরো বা দুই বিলিয়নের অধিক মার্কিন ডলার জালিয়াতির ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ফিলিপিন্সের দুটো বাণিজ্যিক ব্যাংকের নাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ হ্যাকিং করে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে আত্মসাৎ করার ক্ষেত্রে ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংকিং কর্পোরেশন জড়িত ছিল। এ কারণে তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং তাদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে বরখাস্তও করে। এরপরও ফিলিপিন্সের সেই রিজাল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অস্বীকার করে। একইভাবে জার্মানি কোম্পানি ওয়ারকার্ডের দুই বিলিয়ন ডলার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টিও ফিলিপিন্সের বাণিজ্যিক ব্যাংক দুটি অস্বীকার করে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক অব ফিলিপিন্স আইল্যান্ড কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করেন যে, প্রাথমিক তদন্তে তারা দেখতে পান একজন জুনিয়র অফিসার এই লেনদেন সংক্রান্ত দলিলপত্রে স্বাক্ষর করেছেন এবং অন্য স্বাক্ষরটি জালিয়াতি বলে দাবি করেছেন। ইউবিও ইউনিব্যাংক অবশ্য পুরো লেনদেনকেই সম্পূর্ণ জালিয়াতির ঘটনা বলে উল্লেখ করেছে। জার্মানি কোম্পানির এই বিশাল অঙ্কের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় জার্মানি সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা হতবাক হয়ে যায়। তারা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে তদন্ত করছে। তাদের তদন্তে নিশ্চয়ই বের হয়ে আসবে যে, সত্যিকার অর্থেই ফিলিপিন্সের দুটি বাণিজ্যিক ব্যাংক জার্মানি কোম্পানির এই বিশাল অঙ্কের অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিল কিনা। একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকও যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে তাদের আত্মসাৎ করা অর্থ ফিরে পাবার উদ্দেশ্যে মামলা দায়ের করেছে। মামলার চূড়ান্ত রায়ে প্রমাণ হবে যে, ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংক সেই মানি লন্ডারিং ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল কিনা। এর আগে কোনকিছুই হয়ত নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে এই ধরনের বিশাল বিশাল অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে ফিলিপিন্সের ব্যাংকের নাম জড়িয়ে থাকার বিষয়টি অবশ্যই উদ্বেগের কারণ। বিষয়টি আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে ভাবিয়ে তুলেছে। আসলেই সেখানকার ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তেমন কোন দুর্বলতা আছে কিনা, বিশেষ করে তাদের কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে বিশেষ ঘাটতি আছে কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। ফিলিপিন্স সরকার তথা সেখানকার নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেমন বিষয়গুলো ভেবে দেখবে, ঠিক তেমনি আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থারও বিষয়টি খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। তা না হলে অনেকেই আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। লেখক : ব্যাংকার, টরনটো, কানাডা [email protected]
×