ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তপন বিশ্বাস

সৎ স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ১১ এপ্রিল ২০২১

সৎ স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

জনকণ্ঠ পত্রিকায় চাকরি প্রায় দেড়যুগ হয়ে গেল। আমাদের সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ স্যারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক স্মৃতি। যোগদানের দিন যখন সম্পাদক স্যারের রুমে গেলাম, তখন থেকেই তাঁর প্রতি একটা অন্যরকম শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হলো। স্পষ্টবাদী এই ব্যক্তিটির রুচিশীল পোশাক, কথা বলার ভঙ্গি ও ব্যবহারে প্রথমদিনই রীতিমতো ভক্ত হয়ে গেলাম। এর আগে কম সময়ের মধ্যে তিনটি পত্রিকায় চাকরি নিয়েছিলাম। এটি জেনে স্পষ্টবাদী এই মানুষটি বলে বসলেন, কবে আবার এই পত্রিকা ছাড়বা। তখন আমি বলে বসলাম স্যার, এবার আমার আদর্শের পত্রিকা পেয়ে গেছি। এই পত্রিকা ছেড়ে আর কোথাও যাব না। যতদিন চাকরি করব, জনকণ্ঠ পত্রিকায়ই করব। সেই থেকে পথচলা শুরু। তাই ‘ওয়ান ইলেভেনের’ মধ্যে চরম দুরবস্থার মধ্যেও আঁকড়ে থেকে ছিলাম। মনে পড়ছে ২০০৫ সালের নবেম্বর মাসের কথা। সেদিন তৎকালীন গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধে একটা রিপোর্টে তার বক্তব্যের জন্য গিয়েছিলাম। বিশেষ কারণে তিনি ঘন ঘন এপিএস বদল করতেন। প্রতিমন্ত্রীর কাছে শুধু জানতে চেয়েছিলাম, গতকাল (২০০৫ সালের ১৯ নবেম্বর) একজন নতুন এপিএস নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি কয় নম্বর এপিএস। এতেই তিনি প্রচ- ক্ষুব্ধ হয়ে আমাকে জোর করে তার বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে আটকে রাখেন এবং ফিজিক্যালি এসল্ট করেন। এ ঘটনা মুহূর্তে সংবাদকর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক শ’ সাংবাদিক জড়ো হয়ে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে রাস্তা অবরোধসহ দফায় দফায় মিছিল এবং মিছিল শেষে সমাবেশ করে। এ ঘটনা বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের অধিকাংশ স্বনামধন্য মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হয়। ঘটনার পর অফিসে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি (সম্পাদক) আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন তাঁর রুমে। আমাকে বসিয়ে নানা বিষয় বারবার জানতে চেয়েছিলেন এবং বললেন, তুমি তো হিরো। গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছ। সেই থেকে স্যারের বিশেষ নজরে স্থান পেলাম। আতিকউল্লাহ খান মাসুদ স্যার ছিলেন স্পষ্টবাদী, অত্যন্ত সাহসী, ভদ্রলোক, দিলখোলা ও পরোপকারী মানুষ। তাই তো বিভিন্ন মানুষের জন্য তিনি ছিলেন বটবৃক্ষের মতো। এক কথায় তাঁর কাছ থেকে কেউ খালি হাতে ফিরতেন না। ‘ওয়ান ইলেভেনে’ তিনি কারাবাস করেছিলেন দীর্ঘদিন। এ সময় ডিউটিরত বিভিন্ন পুলিশ তাঁকে সম্মান করতেন। স্যার সম্মোধন করে স্যালুট করত। কারওবা চাকরি, কারওবা ভাল পদে বদলি করিয়ে দিয়েছেন তিনি। কোথাও কোথাও তিনি নিজে ফোন করে বলতেন, তপনকে পাঠালাম, বিষয়টা দেখার জন্য অনুরোধ করতেন কোন কোন মন্ত্রীকে। একবার আমাকে ফোন করার পর নেটওয়ার্কের ডিস্টার্বের কারণে কথা কেটে গিয়েছিল। কিছু কথা তিনি শুনতে পাননি। তাতেই কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, তোমার কথা শুনতে পাই না কেন? পরক্ষণে তিনি বললেন, বিকেলে আমার সঙ্গে দেখা কর। বিকেলে নির্ধারিত সময়ে তাঁর রুমে গেলে জানতে চাইলেন কি মোবাইল ফোন ব্যবহার করি। কম দামি ফোন হওয়ায় তিনি তোফায়েল ভাইকে নির্দেশ দিলেন আমার জন্য একটি ভাল মোবাইলফোন সেট কিনে দিতে। ২০১০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কনফারেন্স কভার করতে জেনেভা যাই। যাবার আগে তিনি আমাকে ডাকলেন। জানতে চাইলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় আমাদের সব খরচ বহন করছেন কি না। তারাই সব খরচ বহন করছে বলার পর আমাকে বললেন, তুমি তোফায়েলের সঙ্গে দেখা করে যাও। আমাদের রিপোর্টাররা যারা বিদেশ যেতেন, তাদের প্রত্যেককে তিনি কিছু সহযোগিতা করতেন। তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবক। মাথার ওপরে ছাদ। আজ আমাদের মাথার ওপরে ছাদ নেই। শুধু শূন্য আর শূন্য। তিনি ছিলেন মজার মানুষ। যে কোন কিছুতে সুযোগ পেলে তিনি মজা করতে পছন্দ করতেন। একবার তুহিন নামে আমাদের এক রিপোর্টারকে নিয়ে বেশ মজা করেছিলেন। তুহিনের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও। সে কম্পিউটারের ফন্টকে ফ্রন্ট বলেছিল। শুরু হলো তাকে নিয়ে মজা করা। বারবার তিনি বলছেন, ফন্ট। সে আবারও বলছে ফ্রন্ট। এটা নিয়ে চলল কয়েকদিন। তিনি ক্রিকেট খেলা খুব পছন্দ করতেন। আমাদের ফ্লোরে এলে খেলার তথ্য জানার জন্য ফটোগ্রাফার জসিমকে টিভির সামনে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। মাঝে মাঝে বলতেন, আম্পায়ার (জসিমকে মজা করে আম্পায়ার ডাকতেন) রান কত। কত ওভার চলছে। তিনি সিনিয়র জুনিয়র সকলের বন্ধু ছিলেন। সকলকেই তিনি ভালবাসতেন। তেমনি যে কোন সমস্যায় পাশে দাঁড়াতেন অভিভাবক হিসেবে। এভাবে অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে স্যারের সঙ্গে। কত আর বলব। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ, দক্ষ ও স্বাধীনচেতা একজন মানুষ। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন স্বাধীনতার ধারক। স্বাধীনতার আদর্শকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন সারাজীবন। জীবনে কখনও অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াননি। সত্যকে ধারণ করতে গিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন লৌহমানব। কোন কিছুতেই তিনি লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি কখনও। আদর্শ থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বিচ্যুত হননি। সত্য প্রকাশে তিনি আদৌ ভয় পেতেন না। ছাড়ও দিতেন না। এমনকি সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশে তিনি কখনও পিছপা হননি। চারদলীয় জোট আমলে সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। এ জন্য অনেক স্থানে জনকণ্ঠ পত্রিকায় অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনাও তাঁকে দমাতে পারেনি। জেল-জুলুমকেও তিনি তোয়াক্কা করতেন না। সততা, অন্যায়ের এই প্রতিবাদ এবং স্বাধীনতার সপক্ষের অবস্থানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে অন্যরকম সম্মান করতেন। শুধু সম্মান নয়, পছন্দও করতেন এবং ভালবাসতেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এত গভীর সম্পর্ক থাকলেও তিনি নিজের জন্য কখনও কিছু চাননি। লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, জনকণ্ঠ
×