ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

সেই হেফাজতী তাণ্ডব সেই ’৭১ এবং নব্য সুশীল!

প্রকাশিত: ২১:৩০, ১ এপ্রিল ২০২১

সেই হেফাজতী তাণ্ডব সেই ’৭১ এবং নব্য সুশীল!

হেফাজতী তাণ্ডবে হামলা-আক্রমণের যে ধরনটি দেখা যাচ্ছে সেটি পুরোপুরি ’৭১-এর জামায়াত-শান্তি কমিটি, রাজাকার আর আলবদরীয় তা-বের কপি! তাদের এ তাণ্ডব সেই একই রকম। ২০১৩ এর শাপলা চত্বরের তা-বে যেমন সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র গুণ্ডা-ক্যাডারদের, এখানেও বিশেষত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডারদের তা-ব দেখেছে জাতি। বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীদের এই হামলার টার্গেট, আশ্চর্য এই যে- ’৭১-এর মতই থানা ও পুলিশ, ভূমি অফিস, পৌর অফিস, আওয়ামী লীগ নেতাদের বাসভবন, মন্দির, সাংবাদিক, এমনকি পাঠাগার এবং সেই স্বনামধন্য ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর নামাঙ্কিত ভবন ও আলাউদ্দীন খাঁ সঙ্গীত কেন্দ্র; যেটি মাদ্রাসার মৌলবাদী ছাত্র-শিক্ষকদের হাতে কয়েক বছর আগেও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল! তাদের অর্থাৎ হেফাজতের বাবুনগরী ও মামুনুল হকের অপছন্দের তালিকাটি সুস্পষ্ট হয়েছে তাদের হামলার টার্গেট দেখে- ১. আওয়ামী লীগ, যার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল যেটি তাদের প্রিয় (এখনও)! পাকিস্তানকে ভেঙ্গে তাদের উগ্র ওহাবীবাদী মনকে ভেঙ্গে দিয়েছিল। ‘আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ স্লোগান তোলা মোল্লা, আফগান ফেরত আজিজুল হক মারা গেলেও তার পুত্র মামুনুল হক সেই প্রাচীন ভ্রান্ত আদর্শে এখনও বিশ্বাসী। আওয়ামী লীগ ’৭৫-এ, ২০০১-২০০৫-এ, ২০১৩ তে বিএনপি-জামায়াতের ভয়াবহ হামলার শিকার হয়ে ছিল। ২. ’৭১-এ ও থানা ও পুলিশ ছিল শান্তি কমিটি- রাজাকারদের হামলার টার্গেট, এবারেও তাই। ৩. ’৭১-এ যেমন হিন্দুর ঘরবাড়ি ও মন্দির হামলার শিকার হয়েছিল তারা ২০০১-২০০৫-এবং ২০২১-এ শাল্লায়, গাইবান্ধায় তেমনই হামলার শিকার হয়েছে। ৪. ’৭১-এ, ২০০১ থেকে ২০০৫-এর মতো ২০২১-এ সাংবাদিকরা হামলার টার্গেট হলো। এর সঙ্গে নতুন যুক্ত হলো- পাঠাগার ও পৌর ভবন-যে স্থাপনাগুলোতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও প্রযুক্তি শিক্ষার-ব্যবহারের কেন্দ্র ছিল। নব্য সুশীলদের বলছি-এরা বাংলার ভাষা-সংস্কৃতির শত্রুই শুধু নয়, এরা দেশ ও জাতির বিজ্ঞানভিত্তিক পড়াশোনা, জ্ঞানচর্চা, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারকেও শত্রু গণ্য করে। এতে আপনারা নিজেদেরও নিরাপদ ভাবতে পারেন কি? মনে রাখতে হবে, হরতাল অথবা ধর্মঘট ডাকা যে কোন দলের অধিকার। কিন্তু বুঝতে হবে, সরকারের কোন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপনি হরতাল ডাকতে পারেন। নিশ্চয়ই যে ভারত আমাদের ’৭১-এর স্বাধীনতা অর্জনের মহান মুক্তিযুদ্ধের মিত্র দেশ ও তার প্রধানমন্ত্রীর আগমনের বিরুদ্ধে হরতাল সমর্থন কেউ করতে পারেন না। এই হরতালের আগে শাল্লায় এই হেফাজত, নেপথ্যে জামায়াত-শিবিরের নেতা-গু-া-ক্যাডারদের দ্বারা হিন্দুদের ওপর কি অবর্ণনীয় হামলা, লুট, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। তার কদিন আগে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধী অর্থাৎ বাঙালী সংস্কৃতিবিরোধী উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখেছে, ভাস্কর্যও ভেঙ্গেছে! তারা সামনে পহেলা বৈশাখের আয়োজনেরও বিরোধিতা করবে বলে আশঙ্কা করি। গ্রামে-গঞ্জে পান্তা খাওয়াকে শুনেছি বেদাত ঘোষণা করে স্থানীয় মৌলবাদীরা সাধারণ কৃষক নারী-পুরুষের মগজ ধোলাই করেছে। শুনেছি, এই ঢাকায় প্রতিবেশী হিন্দু যুবকদের কাছ থেকে মুসলিম শিশু আগে নিয়মিত বৈশাখী নতুন জামা-কাপড় নিলেও পরে আর নেয়নি। ৪. এই কট্টর হেফাজত- জামায়াত যে বাঙালীর সঙ্গীত, যাত্রাগান, বাউল সঙ্গীত ও বাউল দর্শনবিরোধী তার প্রমাণ বহুবার দেখেছি। এবারও সেই বিশ্বখ্যাত আলাউদ্দীন খাঁ আবারও মৌলবাদীদের হামলার শিকার হলেন। এই তা-ব যে তারা চালাবে এর কোন আগাম খবর গোয়েন্দাদের কাছে থাকল না কেন? আমি মনে করি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রশাসক এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেক আগেই নিজস্ব আইনী প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত হয়ে আগেই জামায়াত-হেফাজত ও বিএনপির ক্যাডার গু-াদের গ্রেফতার করা উচিত ছিল। জানি না, প্রশাসক-পুলিশ আবার জামায়াত-হেফাজতপন্থী কিনা! যে সহিংস ঘটনা ঘটেছে, তার দায়-দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনকে, পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিদের অবশ্যই নিতে হবে। সরকার এতদিন যাবত চলা একটা অশান্তি আঁচ করতে পারেনি, এটি বিশ্বাস হয় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, সরকার ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি দেখছে। এ তো দেখি আমরা সব হারিয়ে চরম সর্বনাশের আশায় বসে আছি! ঘটনা ঘটার আগে দুর্বৃত্তদের গ্রেফতার করলে পরে আর গুলি করতে হতো না, তাই না? ফলে জনগণের জানমাল-বসত, সরকারের অফিস- থানা, আওয়ামী লীগের নেতাদের বসতঘর আগুনে ধ্বংস হতো না। কই, এরপরও, বাবুনগরী-মামুনুল হক জেহাদী উগ্র, দেশ ও জাতির জন্য চরম ক্ষতিকর ব্যক্তিরা গ্রেফতার হচ্ছে না কেন? সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করতে বিদেশ থেকে বেশ কিছু ব্যক্তি এসেছে শোনা যাচ্ছে। এরা আর ওরা এক হয়ে কাজগুলো করেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে সরকারকে বুঝতে হবে, কোন কোন সময় শুরুতেই লাঠির এক বাড়িতে সাপকে মেরে ফলতে হয়, অথবা ষড়যন্ত্রের মাথায় আঘাত করতে হয়। আবার কোন কোন সময় কর্মীদের ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে উচ্চপর্যায়ের নেতা পর্যন্ত পৌঁছে তারপর তাকে ধরা হয়। হেফাজতকে অনেক বেশি সময় দিয়েছে সরকার, যার প্রয়োজন ছিল না। ভাস্কর্য ভাঙ্গার চরম রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্যের জন্য বক্তব্যদাতাদের তখনই গ্রেফতার করলে পরবর্তী কয়েকদিন যাবত এসব অপঘটনা ঘটানো সম্ভব হতো না। আমার বাবা, অতি সৎ ইমাম পুত্র, বলতেন ঐ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অজ্ঞ মোল্লারা দুটি জিনিসের কাছে নতজানু হয়- অর্থ অথবা মারধর। বর্তমানে জামায়াতে ইসলামী তাদের ’৭১-এর কলঙ্কিত ভূমিকার কারণে কিছুটা দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। বিএনপির নেতা জিয়াউর রহমান শুরুতে এসেই জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিয়ে এবং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিষিদ্ধ করা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে প্রমাণ করল জিয়া-বিএনপি জামায়াতের মিত্র দল। তারপর থেকেই জামায়াতের উত্থান ঘটে, আলবদর, আলশামসের মতন বাংলা ভাই-আবদুর রহমান, জেএমবি, হিজবুত তাহরীর ইত্যাদি জঙ্গী দলের খুনীরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ-প্রগতিশীল শিক্ষক-লেখক-গায়ক, ছাত্র-ব্লগারদের হত্যা শুরু করে বিএনপির তারেক-খালেদার মদদে। সুতরাং আজকে সরকারকে বুঝতে হবে, সরকারের প্রধান দায়িত্ব ধর্মনিরপেক্ষ বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, দেশপ্রেমিক নাগরিকদের রক্ষা করা। সরকারের হাতে বঙ্গবন্ধুর ’৭২-এর সংবিধানটি আছে। সেটিকে জিয়া-এরশাদ কর্তৃক সংঘটিত বিকৃতিগুলো বর্জন করে অবিকৃত সংবিধানটি চালু করা জরুরী প্রয়োজন। পাশাপাশি, বাঙালী সংস্কৃতিকেও সুরক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে জামায়াত-বিএনপির ক্রীড়নক হেফাজত ও অন্য জঙ্গী দলকে নিষিদ্ধ করে তাদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। সরকারকে নিজেকেও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। নতুবা খুনী জামায়াতের হাত থেকে আরেক খুনী-উগ্র জঙ্গী গোষ্ঠীর সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্টকারী হেফাজত, জেএমবি, হিজবুত, আল্লার দল, আনসার আল ইসলাম ইত্যাদির অবস্থান জাতিকে দেখতে হবে এবং অনাকাক্সিক্ষত বাধা-বিঘ্নের মুখোমুখি হতে হবে। সরকারকে বুঝতে হবে, মুক্তিযুদ্ধও থাকবে, আবার তার পাশে যুদ্ধাপরাধীর পাকিস্তানী আদর্শও থাকবে- তা চলতে পারে না। জনগণ যখন ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীর বিচার চায়, তখন তারা যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে সহাবস্থান চায় না। এটি অবাস্তব এবং অসম্ভব কল্পনা, যা এখনই রদ করতে হবে বেশি দেরি হয়ে যাবার আগেই। দেরি হয়েছে অনেকটাই। ’৯৬-এ যুদ্ধাপরাধী মিত্রকে পরাজিত করা সম্ভব হলেও এবং অনেক দ্রুত অনেক কাজ করা সত্ত্বেও ২০০১-এ দেশী-বিদেশী চক্রের ষড়ষন্ত্র নির্বাচনী ফল পাল্টে দিয়ে আবার যুদ্ধাপরাধী-মিত্র বিএনপি জয়ী হয়ে স্বরূপে অর্থাৎ, জামায়াতের আলবদরীয় আওয়ামী লীগ বিরোধী ও হিন্দু এবং বাঙালী সংস্কৃতির চর্চকারীদের বিরোধী অবস্থান নিয়ে তাদের ওপর অকল্পনীয় নির্যাতন-হত্যা-গুম-লুট-ধর্ষণের যে চিত্র ফিরিয়ে এনেছিল তা ছিল হুবহু ’৭১-এর জামায়াতের রাজাকারের নারকীয় চিত্র! বর্তমানে বিএনপি কিছুটা দুর্বল। জামায়াত কলঙ্কিত। সুতরাং তারা তাদের পাকিস্তানী এজেন্ডার বাস্তবায়নে ’৭১-এর অপর যুদ্ধাপরাধী দল হেফাজত ও নেজামে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধীদের কাজে লাগাচ্ছে, তা তো জনগণ, সুশীল সমাজ বুঝতেই পারছেন। তাই এখন আর দুই বিপরীতমুখী আদর্শের সহাবস্থান মেনে চলার সরকারের কোন প্রয়োজন নেই। কোন ভয়ও নেই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ দল- জোট ’৭২-এর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শভিত্তিক সংবিধানে ফিরে যাবে- এটিই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী জনগণ বিশ্বাস করে। উল্লেখ্য, যে সংবিধানে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার উৎস জনগণ নির্দিষ্ট করা আছে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনার মৌল প্রত্যয়। তারপরও কথা থাকে- আমরা মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে শান্তিপূর্ণ, অবাধ জ্ঞান বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চার সমৃদ্ধ জীবন কি উপহার দেব না? যখন সময় এখন আমাদের, যখন সরকার এখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী এবং পুরো বিশ্বে আমাদের সরকারপ্রধান অতি সম্মানিত, তাঁর কাজকর্ম পুরো বিশ্বে প্রশংসিত, তখন আমরা নগণ্য এক হেফাজতকে মূল্য দিতে যাব কেন? তাদের শাপলা চত্বরের সবরকম সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ওপর মামলা রুজু করে হুকুমের আসামি, বড় বড় মোল্লা নেতার বিচার শুরু করা হোক। স্মরণ করুন- একদিন আমরা যুদ্ধ করব ভাবিনি, কিন্তু সময় এলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে করেছি। একদিন আমরা যুদ্ধাপরাধীর বিচার করতে পারব ভাবিনি, কিন্তু সময় এলে করেছি। একদিন আমার বাবা জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা ভেবে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করাতে পারবেন চিন্তা করে যখন পারেননি, তখন প্রতিবাদী গল্প ‘মৃতের আত্মহত্যা’ লিখে পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু সেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারও সঠিক সময় এলে আমরা করতে পেরেছি। একুশে গ্রেনেড হামলার মামলা, কোটালিপাড়ায় বোমা পুঁতে রাখার মামলা, সারাদেশে বোমা হামলার মামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা- সবই করেছি সফলভাবে। শুধু কয়েকজন পলাতক খুনীকে আমরা এখনও দেশে এনে দ- কার্যকর করতে পারিনি। সুতরাং বর্তমান সময়টিতে জামায়াত-বিএনপির ক্রীড়নক হেফাজতকে, এর নেতাদের সমুচিত বিচার করে দ- কার্যকর করে জাতি ও দেশকে শান্তি ও স্বস্তি ফিরিয়ে দিতে পারে সরকার। বর্তমান সময়টি সব চাইতে উপযুক্ত বলে জাতি মনে করে। ঝাড়েবংশে দেশের জন্মের, স্বাধীনতার ও জাতির শান্তিপূর্ণ জীবনের শত্রুদের নির্মূলের এটিই উপযুক্ত সময়। সরকারকে এখন কঠোর এ্যাকশনে যেতে হবে। এখন পিছিয়ে এলে শত্রু মাথার ওপর উঠবে। সেটি হতে দেয়া যাবে না। নতুবা তরুণ প্রজন্মকে আমরা কি দিয়ে যাব? আমাদের কি দায়িত্ব নেই নতুন প্রজন্মের জন্য একটি মুক্তিযুদ্ধের শত্রুহীন বাংলাদেশ উপহার দেয়ার? লেখক : শিক্ষাবিদ
×