ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইমতিয়াজ আহমাদ

টেস্ট ক্রিকেটে উন্নতির জন্য যা প্রয়োজন!

প্রকাশিত: ২৩:৪৯, ৩ মার্চ ২০২১

টেস্ট ক্রিকেটে উন্নতির জন্য যা প্রয়োজন!

ক্রিকেটারদের মনিটারিং ও প্রশিক্ষণ ॥ বিসিবি প্রায় শতাধিক ক্রিকেটারকে মাসিক বেতন দিয়ে থাকে। কিন্তু এই বেতনপ্রাপ্ত ক্রিকেটারদের মনিটারিংয়ের কি কোন পরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে? তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও সুযোগ-সুবিধা রয়েছে কি? এসব ক্রিকেটাররা এনসিএল সামনে রেখে ১০-১৫ দিন আগে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। কিন্তু এই ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ কি যথেষ্ট? ক্রিকেটারদের অফ সিজন এবং টুর্নামেন্ট শুরুর আগে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। এই নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কোচ, ট্রেইনার, ফিজিও নিযুক্ত করা দরকার। প্রতিটি বিভাগীয় দলের জন্য পৃথক পৃথক কোচিং স্টাফদের কাজ হলো এই ক্রিকেটারদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া। তারা প্রত্যেক ক্রিকেটারের উপর মাসিক প্রতিবেদন তৈরি করবেন ক্রিকেটারদের পারফর্মেন্স, ফিটনেস, সিরিয়াসনেস, প্রশিক্ষণে উপস্থিতির ভিত্তিতে। এই মাসিক প্রতিবেদনগুলো জাতীয় দলের নির্বাচকদের কাছে পাঠাবেন। আমাদের দেশে জুন থেকে অক্টোবর এই ৫ মাস বৃষ্টির জন্য ক্রিকেট খেলা প্রায় বন্ধ থাকে বললেই চলে। এই সময়টায় ক্রিকেটারদের যদি অন্তত ৩ মাস নিবিড় প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেয়া যায় সেটা পারফর্মেন্স, খেলার প্রতি মনোযোগ ও পেশাদারি মনোভাব- এসব উন্নয়নে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। দলীয় শৃঙ্খলা ও দল নির্বাচন ॥ এনসিএল নিয়ে বিভিন্ন গুঞ্জন রয়েছে। যেমন লিগটা হয় পিকনিক পার্টির আমেজে। সিরিয়াসনেস ও পেশাদারিত্বে বড়ই অভাব। এরপর সিনিয়র ক্রিকেটাররা খেলতে অনাগ্রহী। আবার এও শুনেছি কোচের কোন কথাই চলে না। দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের সিদ্ধান্তে চলে দল। কোন দলে আবার উল্টোটা-সেখানে নাকি কোচ নিজের পছন্দের ক্রিকেটার খেলান। এসব থেকে বুঝা যায় যে জাতীয় লীগে প্রতিটি দলের উপর বিসিবির কড়া নজরদারি দরকার। এসব পরিস্থিতি আর যেন কোন অস্তিত্ব না থাকে সেই লক্ষ্যে বিসিবির কাজ করা দরকার। উপরের অভিযোগগুলো দল নির্বাচনে নিরপেক্ষতা, টিম ম্যানেজমেন্টের দলের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক ক্রিকেট কালচার বা সংস্কৃতি সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আর এগুলোর থেকে উত্তরণের জন্য দলের কোচ এবং ম্যানেজার হিসাবে দেশের দক্ষ ও অভিজ্ঞজনদের নিয়োগ করা দরকার। দলের হেড কোচ ও ম্যানেজার হিসেবে এমন মানুষ দরকার যারা দলের নিয়ম শৃঙ্খলা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণে পটু এবং যাদের ন্যায়পরায়নতা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। এই অভিযোগগুলো থেকে পরিত্রাণের জন্য জাতীয় লীগে যারা সাধারণত দায়িত্বে থাকেন ক্ষেত্র বিশেষে তাদের না রেখে অন্যদের মধ্যে যারা অভিজ্ঞ তাদের দায়িত্ব দেয়া যায়। এতে করে সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে একটা বার্তা পৌঁছে যাবে। সেই সঙ্গে প্রতিটি দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত হেড কোচ ও ম্যানেজারদের সঙ্গে মিটিং করে দল নির্বাচনে নিরপেক্ষতা, দলীয় শৃঙ্খলার ব্যাপারে বিসিবির অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে দিলে ব্যাপারটা বেশ জোরালো হবে। টুর্নামেন্টকে আকর্ষণীয় করে তোলা ॥ টেস্ট ক্রিকেটে উন্নতি করতে বিসিবির সর্বপ্রথম জাতীয় লীগটাকে কাজে লাগাতে হবে। কাজে লাগানোর অর্থ হলো একে কার্যকরী করা। একে কার্যকরী করতে হলে প্রথমেই এর জৌলুস ও আড়ম্বর বাড়াতে হবে। ম্যাচ ফিসহ অন্যান্য ভাতাদি ক্রিকেটারদের আন্দোলনের পরই বাড়ানো হয়েছে। তারপরও এগুলো আরেকদফা পর্যালোচনা করলে মন্দ হবে না। কেউ কেউ ভাবতে পারেন এত টাকাকড়ি, সুবিধা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। ক্রিকেটটাকে পেশার পর্যায়ে না নিতে পারলে প্রকৃত উন্নয়ন আসবে না। আর এজন্যই সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর চিন্তা। তাই সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করে নেয়া যেতে পারে। অনেকেই বলবেন বিসিবিতে তো আব্দুর রাজ্জাক এবং শাহরিয়ার নাফিস আছেন। ওদের সাঙ্গে কথা বলে নিলেই তো হয়। এই আলোচনার দ্বারা ক্রিকেটাররা যেমন অনুপ্রাণিত হবেন, ঠিক তেমনি বিসিবির সঙ্গে ক্রিকেটারদের সম্পর্কটা আরও জোরদার হবে। এত গেল সুযোগ-সুবিধা। এনসিএলের পাইপলাইন ॥ আমাদের দেশে বর্তমানে বেশ অনেক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন হলেও লঙ্গার ভার্সন মাত্র দুটি। জাতীয় ক্রিকেট লীগ আর বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগ। যদিও বিসিবির বয়সভিত্তিক খেলাগুলোতে চূড়ান্ত রাউন্ডে লঙ্গার ভার্সন খেলা হয়। কিন্তু সেটা কয়েকটা ম্যাচ মাত্র। এদেশের ক্রিকেটাররা লঙ্গার ভার্সন বা ৩/৪ দিনের ম্যাচ বেশি খেলার সুযোগ পান না। আর তাই ক্রিকেটারদের লঙ্গার ভার্সন ক্রিকেটে আরও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য খুব ভাল একটা উদ্যোগ হতে পারে অনুর্ধ-২৩ জাতীয় লীগ। জাতীয় লীগের আদলে আন্তবিভাগীয় টুর্নামেন্ট হবে এটা। এতে দেশের ক্রিকেটারদের লঙ্গার ভার্সন ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ও মেজাজ তৈরি হবে, যা কিনা দেশের ক্রিকেট কালচার তৈরিতে সাহায্য করবে। ৪/৫ দিনের ম্যাচের মেজাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনুর্ধ-২৩ জাতীয় লীগ এই টুর্নামেন্টটা মূল জাতীয় লীগের পাইপলাইন হিসাবে কাজ করবে এবং এর মান বাড়াতে সাহায্য করবে। ফলে দেশে লঙ্গার ভার্সন টুর্নামেন্ট দাড়াবে তিনটা। বিসিএল, এনসিএল এবং অনুর্ধ-২৩ জাতীয় লীগ। বিসিবিকে এই প্রতিটা টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে হবে পেশাদারিত্বের সঙ্গে এবং পুরো আয়োজনটা রাখতে হবে নিবিড় নজরদারিতে। যাতে করে এখানে কোন অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অপেশাদারিত্বের সুযোগ না থাকে। এদেশে পারফর্মেন্সের একটি বিশেষ অন্তরায় হলো টুর্নামেন্টগুলো বছরের নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত না হওয়া। অর্থাৎ একেক বছর একেক সময়ে টুর্নামেন্টগুলো আয়োজিত হয়। এটা নিশ্চিত করা জরুরী যে বিসিএল, এনসিএল এবং অনুর্ধ-২৩ জাতীয় লীগ প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত হবে। সেই সঙ্গে যে উইকেটগুলোতে এই টুর্নামেন্ট খেলা হয় সেগুলোর মান নিশ্চিত করতে হবে। উইকেটগুলোর মান যদি ভাল না হয় তাহলে পরিশ্রম বিফলে যাবে। খেলার মান বাড়ানোর জন্য এনসিএলের প্রতিটি দলে একজন করে বিদেশী খেলোয়াড় খেলানোটা পুরো লীগটাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে পারে। প্রত্যেক দলে একজন করে বিদেশী ফাস্ট বোলার খেলালে আমাদের ব্যাটসম্যানদের জন্য খুব ভাল প্র্যাকটিস হয়ে যাবে। অবশেষে বলব টেস্ট ক্রিকেটে মুন্সিয়ানা দেখানোর জন্য সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত কার্যক্রম প্রয়োজন। যথারিতি যেভাবে চলছে ঠিক সেভাবে এগোলে আর যাই হোক টেস্ট ক্রিকেটে উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর তাই দেরি না করে অতি শীঘ্রই এই পদক্ষেপগুলো নিলে ক্রমান্বয়ে আমাদের ক্রিকেটারদের টেস্ট ক্রিকেট খেলায় এবং ভাল পারফর্ম করায় পারদর্শী হয়ে উঠবে। লেখক : সাবেক ক্রিকেট কোচ, (বিকেএসপি)
×