ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বেপরোয়া গাড়ি চালানোর মানসিকতাই বড় কারণ সিসিটিভি দিয়ে কন্ট্রোল রুম থেকে সড়ক নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ

মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে ॥ যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ সড়কে

প্রকাশিত: ২৩:০৪, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে ॥ যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ সড়কে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সড়ক মহাসড়কে যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ বেড়েছে। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। চলতি মাসের ১৭ দিনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন রাস্তায় গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ৯৮ ভাগের বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা থেকেই এই দুর্ঘটনা। স্থানীয় প্রশাসনসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ বলছে, বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো, চালকের অদক্ষতা, একলেনে গাড়ি চলাচল, স্বল্পগতির যানবাহন এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক মহাসড়কে বিআরটিএসহ জেলা ও হাইওয়ে পুলিশের তদারকি একেবারে নেই বললেই চলে। ফলে চালকরা ইচ্ছেমত যানবাহন চালাচ্ছেন। এ কারণেই বাড়ছে দুর্ঘটনা আর মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রতিদিন আসছে একের পর এক মৃত্যুর খবর। তারা বলেন, এখন সড়কে চালকদের লাইসেন্স দেখার পর্যন্ত কেউ নেই। এ কারণে গোটা পরিবহন সেক্টরে অরাজকতা চলছে। এই প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো, বিশে^র উন্নত শহরগুলোর মতো আমাদের দেশেও সব ধরনের সড়ক সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে হবে। ক্যামেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সড়কের সব রকমের অব্যবস্থাপনার সঙ্কেত দেবে। যার মাধ্যমে রাস্তায় অনেকটাই শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হবে। সেইসঙ্গে যানবাহন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিআরটিএসহ হাইওয়ে এবং জেলা পুলিশের নজরদারি বাড়ানোর বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তারা। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের অন্য কোথাও বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেট বা ইন্সপেক্টর নেই। এ দুই বিভাগে যাও আছে তাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। মূলত এ কারণেই তাদের পক্ষে দেশজুড়ে কোন রকম তদারকি সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের সব জেলা উপজেলায় অভিযানের জন্য জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর নির্ভর করতে হয়। স্থানীয় পর্যায়ের ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের নিয়মিত কাজের পাশাপাশি সুযোগ হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে অভিযান পরিচালনা করেন। এভাবে পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরানো কষ্টকর বলছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। বিআরটিএও বলছে, জনবল সঙ্কটের মুখে সড়ককে নিরাপদ করতে হলে সবার আগে প্রয়োজনে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কার্যকর করার পাশাপাশি মালিক-শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের সচেতনতাই পারে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনতে। তাছাড়া সড়কে বিশৃঙ্খলা এড়ানো ও দুর্ঘটনা কমাতে দক্ষ চালক ছাড়া কেউ যেন লাইসেন্স না পায় তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে সংস্থাটি। শুক্রবার দিনভর সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২৬ জন। এ দিন সকালে সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৮ জনের প্রাণ গেছে; আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৫ জন। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রশিদপুরে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি মোঃ মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন। বলেন, গাড়ির অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে লন্ডন এক্সপ্রেস দ্রুতগতিতে ওভারটেক করতে গিয়ে এনার গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। লন্ডন এক্সপ্রেসের চালক ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কিনা, সেটাও দেখার বিষয় আছে। স্থানীয়রা জানান, লন্ডন এক্সপ্রেসের বাসটি দ্রুতগতিতে এগোতে গিয়ে ভুল লেনে চলে যাওয়ায় ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা হয়। বাসটি রশিদপুর সেতু পার হয়েই বিপরীত দিক থেকে আসা এনা বাসের সামনে পড়ে যায়। তাতেই পূর্ণগতিতে থাকা দুই বাসের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটে। লন্ডন এক্সপ্রেসের বেঁচে যাওয়া এক যাত্রী জানান, ঢাকা থেকে আসার পথে বার বার গাড়ির চালক অন্য গাড়িকে বেপরোয়া গতিতে ‘ওভারটেক’ করছিলেন। যাত্রীরা কয়েকবার সতর্ক করার পরও চালক কানে তোলেননি। সিলেটে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক কোবাদ আলী সরকার বলেন, দুর্ঘটনা ঘটেছে সিলেট থেকে ঢাকাগামী যানবাহনের লেনে। লন্ডন এক্সপ্রেসের গাড়িটি ওই লেনে যাওয়ার কথা নয়। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, লন্ডন এক্সপ্রেসের ভুলেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এদিকে একই দিন বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের দপদপিয়া সেতুতে বালুবাহী ট্রাকের সঙ্গে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত হয়েছে। শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে এই দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পরপরই ঘাতক ট্রাকের চালক ও হেলপারকে পুলিশ আটক করেছে। বগুড়ায় শাজাহানপুরে বাসের চাপায় সিএনজিচালিত অটোরিক্সার ৪ যাত্রী নিহত হয়েছেন। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার মেকিয়ারকান্দা বাজারের কাছে এ মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটে। পুলিশ জানায়, ট্রাক ও মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ধোবাউড়াগামী রডবাহী ট্রাকের সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা মোটরসাইকেলের সংঘর্ষ হলে ট্রাকটি পাশের খাদে পড়ে যায়। শুক্রবার দিনভর যে কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে এর বেশিরভাগই দেখা গেছে যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষে। এত মুখোমুখি সংঘর্ষ কেন। জানতে চাইলে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বিআরটিএ নবনিযুক্ত সচিব মোঃ সরওয়ার আলম বলেন, সংস্থার পক্ষ থেকে সারাদেশের সড়ক মহাসড়ক দেখভালের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নেই। তিনি বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো ও দুর্ঘটনা রোধে বিআরটিএ আন্তরিকভাবে কাজ করার চেষ্টা করছে। অদক্ষ চালকরা যেন কোন অবস্থাতেই লাইসেন্স না পান সেজন্য বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ আরও কঠোর অবস্থানে। বিআরটিএ সকল অফিসগুলোকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দুর্ঘটনা হ্রাস ও সড়কে শৃঙ্খলা আনতে সড়ক মহাসড়কে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ক্যামেরা বসানো হলে ঘরে বসেই সড়কের অনেক কিছুই দেখভাল করা সম্ভব। মালয়েশিয়াসহ অন্য দেশের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, উন্নত অনেক শহরে দেখেছি রাস্তায় ট্রাফিক নেই। কোন চালক বেপরোয়া চালালে বা দুর্ঘটনা ঘটালে এমনকি ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলে সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালে কন্ট্রোল রুম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। চালকদের দোষ থাকলে লাইসেন্সের পয়েন্ট কাটা, লাইসেন্স স্থগিত-বাতিলসহ নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আমাদেরও এই পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। তাছাড়া হাইওয়েতে ডাকাতি, গাড়ি চুরি রোধসহ রাস্তায় যে কোন অপরাধ দমনে সিসি ক্যামেরা অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিবহন মালিক শ্রমিকদের আরও আন্তরিক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের সকলের সহযোগিতা নিয়ে এই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে। ১৫দিন দুর্ঘটনা না ঘটলে মনে করার কোন কারণ নেই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বিআরটিএতে জনবল বাড়ানো ও দক্ষ জনবলের অভাবের কথা উল্লেখ করে সচিব বলেন, দক্ষ জনবল বাড়ানো সম্ভব হলে আমাদের অনেক বিষয়ে উন্নতি হবে। যার সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব দেখতে পাব সড়কে শৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা হ্রাসে। বেশিরভাগই মুখোমুখি সংঘর্ষ ॥ ২৭ ফেব্রুয়ারি শনিবার কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়ায় ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে পৃথক দুই সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী ও মাইক্রোবাস চালকসহ চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। দুটি ঘটনাই যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষে হয়েছে। নীলফামারীতে বাস ও অটোরিক্সার মুখোমুখি সংঘর্ষে মশিউর রহমান (৪০) নামের এক যাত্রী নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ১১ যাত্রী, তাদের মধ্যে অন্তত তিন জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। শনিবার সকাল পৌনে ৭টার দিকে নীলফামারী-সৈয়দপুর সড়কের সংগলশী কামারপাড়া এলাকায় ওই ঘটনা ঘটে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি দেশের বিভিন্ন সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে অন্তত ১৩ জনের। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম মহাসড়কে সিরাজগঞ্জের কোনাবাড়িতে মঙ্গলবার সকালে বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে পাঁচ বাসযাত্রী নিহত হন। একইদিন রাজশাহী সিটি হার্টসংলগ্ন বাইপাস সড়কে বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ট্রাকচালক নিহত হন। চাপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ মহাসড়কে রশিকনগর বাবু মোড়ে ট্রাক ও মোটরসাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষে ২জন নিহত হন। ২৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে মোটরসাইকেল ও অটোরিক্সার মুখোমুখি সংঘর্ষে একজন নিহত হন। মঙ্গলবার মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আহত হয়েছেন দুইজন। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলায় ট্রাক চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী জাহিদ হাসান রাসেল (৩২) ও শহীদুল কায়সার রনি (৩৪) নামে দুই বন্ধুর মৃত্যু হয়েছে। বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় যাত্রীবাহী বাস ও পাথরবোঝাই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৬ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৫ যাত্রী। রবিবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সকাল ছয়টার দিকে উপজেলার ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের পৌরশহরের কলেজ রোড এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় বাস-ট্রাকের সংঘর্ষে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ১০ জন নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরও অনেকে। গত বুধবার উপজেলার বারবাজার এলাকার কাছে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের এ দুর্ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, খুলনা থেকে কুষ্টিয়াগামী গড়াই পরিবহনের একটি বাস ওভারটেক করতে যেয়ে বারবাজার তেল পাম্পের কাছে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মহাসড়কের ওপর উল্টে যায়। এ সময় কুষ্টিয়া থেকে যশোরের দিকে যাওয়া দ্রুতগামী একটি ট্রাক বাসটিকে আঘাত করলে ঘটনাস্থলে বাসের নয় যাত্রী নিহত হন। এ সময় আহত হন আরও ১৫ থেকে ২০ বাসের যাত্রী। কক্সবাজারের টেকনাফে যাত্রীবাহী মিনিবাস ও মুখোমুখি সংঘর্ষে ৪ জন নিহত হয়েছেন। গত বুধবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার- টেকনাফ সড়কের হোয়াইক্যং লম্বাবিল এলাকায় এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তদন্ত আব্দুল আলীম জানান, একটি যাত্রীবাহী মিনিবাসের সঙ্গে টেকনাফমুখী যাত্রীবাহী সিএনজির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
×