ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন রায়

ব্যাংক ব্যবস্থাপনার আদর্শ খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

প্রকাশিত: ২০:১৯, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১

ব্যাংক ব্যবস্থাপনার আদর্শ খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ও একাধিক বাণিজ্যিক ব্যাংকে প্রধান নির্বাহী পদে দায়িত্ব পালনকারী এবং দেশের ব্যাংকিং খাতের খুবই পরিচিত মুখ খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি মরণব্যাধি করোনাকে জয় করতে পারলেও শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেন বার্ধক্যজনিত নানান রোগের জটিলতায়। তাইত তিনি গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইফ সাপোর্টে থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং সেইসঙ্গে তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি জানাই সমবেদনা। ইব্রাহিম খালেদ ছিলেন একাধারে কেন্দ্রীয় এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকার। ব্যাংকিং জগতের মার্কেট প্লেয়ার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই উভয় খাতের সমান পারদর্শিতা তাকে দেশের একজন প্রথিতযশা ব্যাংকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তিনি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নরের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সেখানে শক্ত প্রশাসক হিসেবে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, কিভাবে কঠোরহস্তে দেশের ব্যাংকিং খাতকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আবার তিনি সরকারী-বেসরকারী মিলে বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বও পালন করেছেন যথেষ্ট সফলতার সঙ্গেই। এখানেও তিনি দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন যে, কিভাবে নিয়মনীতি মেনেও মুনাফা অর্জনকারী বাণিজ্যিক ব্যাংককে সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায়। ব্যাংকিং-এর এই উভয়ক্ষেত্রে তার দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং পারদর্শিতার কারণে তাকে সমসাময়িক ব্যাংকিং-এর গুরু বললেও কম বলা হয়। ইব্রাহিম খালেদের জন্য পদ-পদবী নিশ্চয়ই তেমন কোন বিষয় নয়। কেননা অনেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর বা বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ইব্রাহিম খালেদের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো তিনি দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে ভাবতেন এবং এর সার্বিক উন্নতির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। তিনি তার অভিজ্ঞতা দিয়ে স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলেন যে, দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই খাত সঠিকভাবে চলছে না এবং ক্রমশই নানান অনিয়ম এই খাতের সর্বনাশ ঘটিয়ে চলেছে। তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে, দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত করতে হলে সুস্থ ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই। ফলে তিনি দেশে সুস্থ ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বলা যায় একাই লড়ে গেছেন। যখনই তিনি সুযোগ পেয়েছেন তখনই তিনি এই বিষয়ে কথা বলেছেন এবং জোরালো বক্তব্য ও লেখালেখির মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, দেশের ব্যাংকিং খাতের একটি সংস্কার প্রয়োজন এবং তার মতে এই কাজটি না করলে দেশে সুস্থ ধারার ব্যাংক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। ইব্রাহিম খালেদ অবশ্য অন্য সকলের মতো সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে বা ব্যাংকিং খাত রসাতলে গেছে বলে চিৎকার করে সমালোচনার স্বার্থে সমালোচনা করেননি। তিনি একজন পেশাদার ব্যাংকার হিসেবে এই খাতের উন্নতির জন্য ক্রমাগত ভুলত্রুটিগুলো তুলে ধরেছেন এবং তা সংশোধনের জন্য সুপারিশ করে গেছেন। তার লেখালেখি এবং বিভিন্ন টেলিভিশন টকশোর আলোচনার মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করে বোঝাতে চেয়েছেন যে, কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারলেই দেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় সুস্থ ধারা নিশ্চিত করা সম্ভব। তার মতে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অধিকতর ক্ষমতা প্রদান এবং এই প্রতিষ্ঠানের অধিক স্বনির্ভরতা, ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের মাধ্যমে খারাপ ঋণ প্রদান বন্ধ করা, ক্রমান্বয়ে খেলাপী ঋণ সমস্যার সমাধান, ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করার মতো বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে পারলেই আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত ঘুরে দাঁড়াবে এবং এখানে সুস্থ ধারার ব্যাংকিং নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এগুলো যে শুধু ইব্রাহিম খালেদের ভাবনা তা নয়, বরং সকল শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যাংকারেরই এমনটা ধারণা। পার্থক্য হলো, অনেকেই শুধু ভাবেন কিন্তু প্রকাশ করেন না, অথচ ইব্রাহিম খালেদ ভেবেছেন এবং প্রকাশ করেছেন। আমি নিজেও অবশ্য এমনটাই বিশ্বাস করি এবং এ বিষয়গুলো নিয়ে স্থানীয় পত্রিকায় অনেক লিখেছিও। ইব্রাহিম খালেদের কাছ থেকে ধারণা পেয়ে এবং বিশ্বের অনেক দেশের খেলাপী ঋণ সমস্যা সমাধানের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি আমাদের দেশের খেলাপী ঋণ সমস্যা সমাধানের উপায় উল্লেখ করে স্থানীয় একটি ইংরেজী পত্রিকায় ছয় পর্বের লেখা লিখেছিলাম। কিন্তু সেসব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হয়েছে বলে মনে হয় না। অনেকের মতো ইব্রাহিম খালেদেরও আস্থা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ব্যাংকিং খাত এখন যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে তা কোন একটি ব্যাংকের মালিক বা বাংলাদেশ ব্যাংক বা কোন মন্ত্রী মহোদয়ের একার পক্ষে এই সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান সম্ভব নয়। আবার তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন যে, প্রধানমন্ত্রী যদি নিজে এদিকে নজর দেন এবং এই খাতের বিরাজমান সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেন তাহলে এটি খুব সহজেই সমাধান করা সম্ভব। আমি নিজেও এটি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। যদিও এই দায়িত্বটি মোটেই প্রধানমন্ত্রীর নয়, বরং অর্থ মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু বাস্তব অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া দেশের ব্যাংকিং খাতে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনা মোটেও সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থা দাঁড়িয়েছে যেন তিনি জাদুর কাঠির মতো। তিনি যেখানে যে উদ্যোগ নেন সেখানেই শতভাগ সফলতা। দেশের বিদ্যুত খাত, পদ্মা সেতুসহ অসংখ্য মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন, সর্বশেষ মহামারী করোনা ব্যবস্থাপনা এবং এর ভ্যাকসিন প্রয়োগের মতো অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন প্রধানমন্ত্রী একক নেতৃত্বে। এ কারণেই ব্যাংকিং খাতে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি উদ্যোগের প্রত্যাশায় থেকে থেকে ইব্রাহিম খালেদ চলেই গেলেন। আমরা অবশ্য এখনও প্রধানমন্ত্রীর দিকেই তাকিয়ে থাকব দেশের ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য তার সরাসরি উদ্যোগ গ্রহণের অপেক্ষায়। ইব্রাহিম খালেদ নিয়মের প্রতি ছিলেন অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল। নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে তিনি কোন কাজ করেননি। এমনকি কোন অন্যায় আবদার বা কোনরকম হুমকি-ধমকির কাছে মাথানত করেননি। নিয়মের প্রতি অবিচল থেকে দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন যথেষ্ট পারদর্শী। দেশের শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির কারণ অনুসন্ধানের তদন্তভার দেয়া হয়েছিল ইব্রাহিম খালেদের ওপর এবং এই দায়িত্ব পালন করার সময় তিনি যথেষ্ট প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু তাতে তিনি মোটেও বিচলিত হননি, বরং সকল প্রকার ভয়ভীতির উর্ধে থেকে তার তদন্ত সম্পন্ন করে রিপোর্ট দিয়েছেন। এমনকি নিজের পদ-পদবী ধরে রাখার জন্য তিনি কোনরকম আপোস করেননি। শেষের দিকে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেখলেন যে, তিনি সবকিছু নিয়ম মেনে করতে গিয়ে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। আর তখনই তিনি স্বেচ্ছায় সেই পদ থেকে সরে গেলেন, যা আমাদের ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে একটি বিরল ঘটনা। আমাদের দেশে নিজের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ একটি নিয়মিত ঘটনা এবং অনেকে আবার নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে এই অভিযোগকে দারুণভাবে ব্যবহারও করে থাকেন। কোনরকম রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বা ভয়ভীতির তোয়াক্কা না করেও যে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা যায় তার বড় দৃষ্টান্ত হলেন ইব্রাহিম খালেদ। ইব্রাহিম খালেদ ছিলেন একজন গুণী ব্যাংকার এবং দেশের ব্যাংকিং খাতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের বাংকিং খাতের উন্নতির জন্য সব সময় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন এবং জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। এরকম নিবেদিতপ্রাণ ব্যাংকার আমাদের দেশে খুব কমই আছেন। দেশের ব্যাংকিং খাতে তার এই অসামান্য অবদানের স্বীকৃিত যে তিনি খুব একটা পেয়েছেন তেমন নয়। বাংলা একাডেমির একটি সম্মানসূচক ফেলোশিপ ছাড়া তেমন কোন পুরস্কার বা স্বীকৃত তিনি পেয়েছেন বলে জানা নেই। তবে আক্ষরিক পুরস্কার বা স্বীকৃতি না পেলেও তিনি আমাদের মতো সকল পেশাদার ব্যাংকারের কাছে ছিলেন ব্যাংকিং-এর গুরু। তার আদর্শ দেশের ব্যাংকার সমাজের কাছে অটুট থাকবে দীর্ঘদিন এবং এটিই তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। ইব্রাহিম খালিদ সুদীর্ঘ এক বর্ণাঢ্য ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শেষ করে পরিণত বয়সেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে, সেখানে তিনি ভালই থাকবেন। লেখক : ব্যাংকার, টরেনটো, কানাডা [email protected]
×