ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিংড়ানো শব্দে অনুরণিত পয়ার

প্রকাশিত: ০০:৩২, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

নিংড়ানো শব্দে অনুরণিত পয়ার

‘মৃত্যুর পর নিশ্চিত একটা বই হয়ে যাব আমি/আমাকে পড়বে, স্পর্শ করবে, হাসবে এবং কাঁদবে-/বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়াবে তোমরা/আমার প্রতিটি রক্তকণিকা হঠাৎ রঙ বদলিয়ে/হয়ে যাবে কালো কালো নিথর বর্ণমালা।’ (রূপান্তর, মুঠো জীবনের কেরায়া)। রফিকুজ্জামান রণির নতুন কবিতার বই ‘মুঠো জীবনের কেরায়া’ (প্রকাশ : নবেম্বর-২০২০ইং)। বইটি পাঠ শেষে অনুভূত হলো, এ যেন ভিন্ন বাঁকে নতুন স্বরের নিনাদিত হওয়া। পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় যেন নিংড়ানো শব্দে অনুরণিত পয়ার; সময়, সময়ের নির্মম নির্দয়তার ঘাত-প্রতিঘাত, প্রতিবাদ-প্রতিবিম্বের স্বচিত্র প্রতিবেদন। এ যেন চলমান-ঘটমান আর অতীত-স্পর্শী ভবিষ্যত ভাবনার মিহি বাস্তবতার আলেখ্য। প্রতিটি কবিতার গায়ে চ্যুতি-বিচ্যুতি-প্রেম-স্খলন-স্বপ্ন-বিচ্ছেদ-উদ্ভূত পরিস্থিতির নানান আঙ্গিক সযত্নে অঙ্কিত। ‘মুঠো জীবনের কেরায়া’ কবি রফিকুজ্জামান রণি’র দ্বিতীয় ও মৌলিক কবিতার বই। কবিতায় কবি রফিকুজ্জামান রণি তারুণ্যের প্রদীপ্ত পথের পরিশ্রমী পথিক। সাময়িকীতে, ছোট-কাগজে, সাহিত্য আড্ডায় চর্চা করছেন নিয়মিত। রোজ নিজেকে ভেঙ্গে উত্তীর্ণ ছাচে নিজেকে গড়ার প্রত্যয়ে প্রমাণ রাখছেন কর্মে। বয়স কিংবা বই নয়, তার কবিতা কথা বলে মনোযোগী কবিতা-কামারের মতো। আগুনে পুড়িয়ে আত্মোপলব্ধির হাতুড়ি পিটনে তিনি লোহাকে ছুরি অথবা কাচিরূপ শব্দ, বাক্য, দৃষ্টি, ভাব, ভাবনাকে কাব্যে রূপান্তরিত করেন- প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা, উত্তর, প্রতিউত্তরের ভেতর দিয়ে দায় কিংবা দায়িত্বের ভার নিয়ে। এই বইয়ের কবিতাগুলো অন্য ভিন্ন নয়। ‘এক টুকরো জ্যোৎস্না ভাগাভাগি করে নিতে পারতাম আমরা/আমাদের একটা চাঁদ থাকতে পারত/ছাদ থাকতে পারত।/তোমার লোভ-লালসা, চাতুরিপনা এবং মিথ্যা পয়ার-/একটা চাঁদকে হত্যা করেছে/একটা ছাদকে ভেঙ্গে খানখান করে দিয়েছে/পৃথিবীর সমস্ত জ্যোৎস্নাকে অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছে।’ (চাঁদ হত্যা, সৌরভবিহীন জীবন)। এই কবির কবিতায় লক্ষ্য করা যায়- প্রচল কালের নিগৃহীত আল-পথ, অসুন্থ মন-মগজ, অনৈতিক বাস, কলুসিত যাপন, বিনাশপ্রবণ মহাসড়কের উল্টো দিকে সজাগ, সচেতন, উজ্জ্বল স্বর। তার কবিতা পড়তে যেয়ে হোঁচট খেতে হয় না কোথাও; কবিতায় অতি গভীরতা, অযাচিত অলঙ্কার, প্রতীক-উপমার ঘুরপাক, শব্দ কঠিন্যের দুর্বোধ্যতা নেই। সরল করে বর্ণিত হয়েছে বক্তব্য। কথা বলার মতো কবিতাগুলোর ঢং সাধারণ পাঠককেও বুঝতে সাহায্য করে সহজভাবে। মোট আটচল্লিশটি কবিতা কবি গ্রন্থিত করেছেন তার ‘মুঠো জীবনের কেরায়া’ বইটিতে। একটি একটি কবিতা ধরে ধরে পড়লে স্পষ্টত প্রত্যক্ষ হয়- কবিতাগুলো কয়েক বছরের জমানো সঞ্চয় নয় বরং কয়েক বছর বা তারও বেশি সময়ে সঞ্চিত অভিজ্ঞানে সমকালে রচিত কবিতা। এই বইয়ে যেমনি পাই করোনা নিয়ে কবিতা (করোনা ট্রাক, মাস্ক) তেমনি পাই সুষমবণ্টনহীন, সাম্যহীন ঘোরতর যুদ্ধ, হিংসায় খোদায়িত এইসব দিন-রত্রির কবিতা। ‘আমাদের হাসিগুলো পুষ্টিহীন হলুদ পাতার মতো ঝরে পড়ে/ কখনও মহামারী, কখনও-বা যুদ্ধ, কখনও প্রতিহিংসা/ ভীষণ নিষ্পেষিত করে দেয় এখানকার জনজীবন।’ (অশুদ্ধ জীবন)। রফিকুজ্জামান রণি তার এই বইটিতে কেবল বাস্তব সময়-বাস্তবতার দিকে নজর রেখে বইটি রচনা করেচেন এমন নয়। মনোদৈহিক, জাগতিক, প্রেম, নিরাশা, হতাশা, ভবিষ্যত, পৃথিবী, মৃত্যুচিন্তার কবিতাও এখানে সন্নিবেশিত। পাঠ করলে, কবিতাগুলোর ভেতরে প্রবেশ করতে পারলে তা আর কবিতা থাকে না, মনন ভেতরে ভেসে ওঠে পরিচ্ছন্ন জীবন ও জীবনযাত্রার ছবি হয়ে; যা আমি জানি, যা আমি দেখি, যা আমি শুনি অর্থাৎ আমার জ্ঞাত-অজ্ঞাত পৃথিবীর অনেক ঘটনা, চরিত্র, সত্য, বিগ্রহ, মানবিক পতন, অবক্ষয় জ্বলজ্বল করে ওঠে এখানে চোখের সামনে। আমার মনে হয় এই জায়গাটিতেই এই কবির সফলতা। কয়েকটি বানান ভুল, দুতিনটি ভুল শব্দের ব্যবহারের বিপরীতে সচেতন খেয়াল ও কবিতায় আর-একটু অতলস্পর্শী স্বাদ প্রত্যাশা করে এও বলি, রফিকুজ্জামান রণির কবিতায় ঘনঘোর না থাকলেও সেই স্পর্শানন্দ আছে, যা অল্প সময়ের হলেও ভাবনার গভীরকে আচ্ছন্ন করে। প্রকাশ-স্পষ্টতা, বর্ণনায় নিরাবরণ, বাস্তব ছবিটাই রফিকুজ্জামানের রণির কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য বলে কবিতায় বলিষ্ঠতা প্রবল।
×