ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্মরণ ॥ গরিবের বন্ধু আলী আহাম্মদ চুনকা

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

স্মরণ ॥ গরিবের বন্ধু আলী আহাম্মদ চুনকা

নিজের মনের অজান্তে বালক বয়সে লড়াইটা শুরু হয় আলী আহাম্মদ চুনকার। তখন নারায়ণগঞ্জের নদীবন্দর ছিল ভারতবর্ষের অন্যতম একটি আমদানি রফতানির কেন্দ্র। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার এই বন্দর ঘাটের পাশেই যাত্রী পরিবহনের স্টিমারও নোঙ্গর করত। স্টিমারের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ ছিল নারায়ণগঞ্জ দিয়ে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে। খেলাধুলা নিয়ে মেতে থাকা বালক চুনকা একদিন খবর পেল গোয়ালন্দ ঘাট থেকে যে স্টিমার ছেড়ে আসছে, সে স্টিমারে একজন বড় মাপের নেতার আগমন ঘটতে যাচ্ছে। সেই নেতার নামও জানা হয়ে গেল, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। নেতাকে দেখার আকর্ষণ জাগল তার (চুনকা) ভেতর। সময় জেনে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে স্টিমার ঘাটে ছুটে গিয়ে দেখেন সেখানে শত শত লোকের ভিড়। স্টিমার থেকে যাকে স্বাগত জানিয়ে নামিয়ে আনা হলো তিনি একজন হৃষ্টপুষ্ট মানুষ। তাকে দেখেই কিশোর চুনকার মন ভরে যায়। সমাগত মানুষের বলাবলি থেকে চুনকা জানতে পারেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে যিনি স্বাগত জানিয়ে সম্মানের সঙ্গে নিয়ে গেলেন, তাঁর নাম খান সাহেব ওসমান আলী। তিনি নারায়ণগঞ্জেরই লোক। রাজনীতির সঙ্গে আছেন। থাকেন নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায়। আর আলী আহাম্মদ চুনকার বাড়ি শহরের দেওভোগ এলাকায়। দেওভোগ থেকে চাষাঢ়া খুব একটা দূরে নয়। হেঁটে যাওয়ার পথ। আলী আহাম্মদ চুনকা বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ওসমান পরিবারের সঙ্গেও কিছুটা সম্পৃক্ততা গড়ে তোলেন। মনোযোগ দেন খেলাধুলা ও সমাজ সেবায়। সমাজের অনিয়ম অনাচারের প্রতি রুখে দাঁড়ানোর মানসিকতায় তিনি রাজনীতির মাঠেও কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠেন। সমাজ সেবায় তিনি গরিব অসহায় মানুষের অন্তরে জায়গা করে নেন। তিনি ছিলেন শত ভাগ নিরহঙ্কার একজন খাঁটি সেবক। ঋষি, মুচি, মেথর, ঝাড়ুদার, রিক্সাচালক, নৌকার মাঝি কেউই তার কাছে ছোটজাত বলে গণ্য হতো না। জাতপাতকে তিনি কখনও আলাদা করে দেখতেন না। মুচি মেথর রিক্সাচালকদের সঙ্গে বসে গল্প জুড়ে দিতেন। চা খেতেন। তাদের ভালমন্দ খোঁজ নিতেন। সমস্যা থাকলে সেটির সমাধানও খুঁজে বের করতেন। এভাবে সমাজের অনেক ভাল-মন্দ দেখার দায়দায়িত্ব তার ওপর এসে পড়ে। যৌবনে ফুটবল, খেলাধুলা এবং কাবাডি খেলায় পারদর্শী ছিলেন আলী আহাম্মদ চুনকা। তার খেলা দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ক্রীড়ামোদীরা আসত। আবার নারায়ণগঞ্জের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিভিন্ন জায়গায় খেলায় অংশ নেয়ার জন্য আলী আহাম্মদ চুনকাকে হায়ার করে নেয়া হতো। খেলোয়াড় হিসেবে যেমন দলগতভাবে মাঠে থাকতে হয়, তেমনি সামাজিক কর্মকাণ্ডেও দলীয় ঐক্যের কারণে তার সফলতা অর্জন সুগম হয়। সমাজের মানুষের দুর্দশা, নানা রকম সমস্যয় মানুষের খেদমত এবং সাহায্য সহযোগিতা করা তার ব্রত হয়ে দাঁড়ায়। রাজনীতিতে প্রবেশের আগে সমাজ তাকে একজন জনদরদি ও ভাল মানুষ হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। বিপদ আপদে এলাকাবাসী চুনকার কাছে ছুটে যায় সহায়তা চাইবার জন্য। সহায়তা চাইতে গিয়ে কেউ নিরাশ হয়ে ফেরে না। মানবসেবা, সমাজসেবার ভেতর দিয়েই আলী আহাম্মদ চুনকা রাজনীতির গণ্ডিতে পা রাখেন। আলী আহাম্মদ চুনকার জন্ম নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকায় ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ ১৬ ডিসেম্বর। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি। তার বাবার নাম জাহেদ আলী। মা গুলেনূর বেগম। নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলে পড়েছেন তিনি। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক ও বিশিষ্ট লেখক ফজলে রাব্বীর লেখা থেকে যতটুকু জানা যায়, ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন চুনকা। তারপর ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ৬ দফা আন্দোলনেও তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। এভাবে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলন এবং ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে আলী আহাম্মদ চুনকার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেও কাজ করেছেন। ছাত্র আন্দোলন, ৬ দফা বাস্তবায়নের আন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থানে কাজ করতে করতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলী আহাম্মদ চুনকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার চৌকস ও বুদ্ধিদীপ্ত মানসিকতায় বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন, এই যুবক একদিন সফল নেতৃত্বের জায়গায় পৌঁছতে পারবে। বঙ্গবন্ধু জেনেছেন, আলী আহাম্মদ চুনকা নিজ এলাকায় সামাজিক কাজকর্ম করে ইতোমধ্যেই মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে। গরিব খেটে খাওয়া মানুষও তাকে ভালবাসে। সম্মান করে। সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে তার সম্পর্ক বন্ধুসুলভ। এলাকার সকল শ্রেণীর নাগরিক চুনকাকে নেতা হিসেবে মানতে শুরু করেছে। হেমিলনের বাঁশিওয়ালার মতো জাদুকর যেন আলী আহাম্মদ চুনকা। তিনি নারায়ণগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন। ভাষা ব্যবহারের কারণে সহজে সাধারণ মানুষের মন জয় করতে পেরেছেন। লেখক ও কবি অধ্যাপক বুলবুল চৌধুরী তার লেখায় আলী আহাম্মদ চুনকাকে নিয়ে বর্ণনা করেছেন, প্রতি সকালে তিনি নগরীর বোস কেবিনে আসতেন। তবে তিনি বোস কেবিনে আড্ডায় বসতেন না। আলী আহাম্মদ চুনকা বসতেন বোস কেবিনের লাগোয়া (পাশে) শ্রী দুর্গা রেস্তোরাঁয়। সেখানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা জমাতেন এবং চা সিগারেট পান করতেন। পৌরসভার চেয়ারম্যান হওয়ার পরও তিনি ওই আড্ডা অব্যাহত রাখেন। সেখানে অনেক নাগরিক আসত সুবিধা-অসুবিধার কথা বলতে। তিনি কাউকে নিরাশ করতেন না। সকলের কথা মনযোগ দিয়ে শুনতেন। স্বাক্ষর প্রয়োজন হলে তাও দিয়ে দিতেন ওই আড্ডায় বসেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আলী আহাম্মদ চুনকা নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচন করে তিনি প্রথম পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান হন। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে তার দায়িত্ব যেমন বেড়ে যায়, তেমনি কাজের পরিধিও বৃদ্ধি পায়। গণমানুষকে সেবা দেয়ার পথ যেন আরও সুগম হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরকে নতুন করে গড়ে তোলার সংগ্রামে লিপ্ত হন আলী আহাম্মদ চুনকা। সরকারী সহায়তায় দরিদ্র মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ এবং বাসস্থান নির্মাণের কাজও করতে হয় তখন। পাশাপাশি শহরের রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন রকম উন্নয়নের কাজ চলতে থাকে তার হাত দিয়ে। ওই সকল কাজের সুবাদে সাধারণ নাগরিকের খুব কাছাকাছি যেতে হয় চুনকার। আর সে কারণেই বোধহয় আলী আহাম্মদ চুনকা দ্বিতীয় বার নির্বাচন করে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেন। নগরীর উন্নয়নের কাজ তাঁর হাত দিয়ে এগিয়া যাওয়া অব্যাহত থাকে। তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে যায়। জনপ্রিয় এই ব্যক্তিত্বটি মানুষের কাছে নগর পিতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। আলী আহাম্মদ চুনকার শিক্ষার প্রতি যেমন আগ্রহ ছিল, তেমনি সাংবাদিকদের প্রতিও শ্রদ্ধাবোধ এবং ভালবাসা ছিল। ভাষাসৈনিক মমতাজ বেগমসহ একাধিক লেখকের লেখায় জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের বেসরকারী সুধীজন পাঠাগার স্থাপনের জন্য জায়গা চেয়ে পৌর পিতা আলী আহাম্মদ চুনকার কাছে আবেদন করলে তিনি প্রথমে বিভিন্ন স্থানে জায়গা দেয়ার চেষ্টা করেন। প্রায় একই সময়ে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবও পৌর পিতা চুনকার কাছে জায়গা চেয়ে আবেদন করে। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের জন্যই তিনি আন্তরিকভাবে জায়গা দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। পরে বঙ্গবন্ধু রোডে চাষাঢ়া বালুর মাঠে ১৮ শতাংশ জায়গার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। আলী আহাম্মদ চুনকার আন্তরিক প্রচেষ্টায় মন্ত্রণালয় এক টাকার বিনিময় মূল্যে সুধীজন পাঠাগারের জন্য নয় শতাংশ ও নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের জন্য নয় শতাংশ জায়গা বরাদ্ধ দেয়। বলাটা অমূলক হবে না যে, আলী আহাম্মদ চুনকা যেমন যোগ্য ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন, তেমনি তার জ্যেষ্ঠ সন্তান ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভীও একজন যোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে ইতোমধ্যেই নারায়ণগঞ্জ তথা দেশব্যাপী আলোচিত হয়ে উঠেছেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়র হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে এটি তার দ্বিতীয় মেয়াদ চলছে। এর আগে এটি পৌরসভা থাকা অবস্থায়ও ডা. সেলিনা হায়াত আইভী নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। লেখক : সাংবাদিক
×