ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পণ্য রফতানির নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করছে অস্ট্রেলিয়া

প্রকাশিত: ২৩:১৫, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

পণ্য রফতানির নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করছে অস্ট্রেলিয়া

আজাদ সুলায়মান ॥ দীর্ঘ পাঁচ বছর পর বাংলাদেশ থেকে সরাসরি পণ্য রফতানির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। সরকারের ধারাবাহিক কূটনৈতিক তৎপরতা ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের গৃহীত বেশ কিছু পদক্ষেপের দরুন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। আগামী মাসেই এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসছে। বিষয়টি গতকাল দৈনিক জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন-বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোঃ মফিদুর রহমান। মঙ্গলবার ঢাকাস্থ অস্ট্রেলীয় হাইকমিশনার এইচ ই জেরেমি ব্রুূয়ের বেবিচক চেয়ারম্যানের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকালে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় বলে নিশ্চিত করেন। জানতে চাইলে এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন- আজকের বৈঠকে অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার আমাকে জানিয়েছেন, সম্প্রতি তাদের সরকার বাংলাদেশ থেকে সরাসরি পণ্য রফতানির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। বেশ কিছু শর্ত-সাপেক্ষে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে। অবশ্যই আমাদের জন্য এটা একটা বড় সুখবর। বেবিচক সূত্র জানায়, অস্ট্রেলিয়া কিছু শর্ত-সাপেক্ষে এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান শর্ত আরএ৩ কার্যকর করা। মূলত বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে পণ্য রফতানির জন্য আরএ৩ ব্যবস্থাপনায় উত্তীর্ণ হতে হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে কার্গো পরিবহনে নিরাপত্তার এ স্তর কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হয়। যা শুরু থেকে অস্ট্রেলিয়া তা নিশ্চিত করার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। এতে বেসামরিক বিমান চলাচল নিরাপত্তা জোরদার করাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়- যা আন্তর্জাতিক মানের। এতে বছর তিনেক আগে যুক্তরাজ্যও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য শুরুতেই বাংলাদেশ সরকার নানামুখী প্রচেষ্টা চালায়। বিশেষ করে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সার্বিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। তারই ধারাবাহিকতায় গত মার্চে অস্ট্রেলিয়ান প্রতিনিধি দল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রফতানি কার্গোর নিরাপত্তা কার্যক্রম সরেজমিনে পরিদর্শন করে। অস্ট্রেলিয়া সরকারের সঙ্গে ক্যানবেরার বাংলাদেশ হাইকমিশন ও বেবিচকের নিবিড় যোগাযোগ এবং সন্তোষজনক পরিদর্শনের ভিত্তিতে অস্ট্রেলিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে সরাসরি কার্গো পরিবহন সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও বর্তমানে এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিশ্বমানের। নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার কোন যৌক্তিকতা ছিল না। সেজন্য কিছু শর্ত-সাপেক্ষে তারা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা প্রত্যাহারের। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য বড় ধরনের অর্জন। শর্তগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মূলত আরএ৩ মেনে চলা। এটা আমরা অনেক আগেই উত্তীর্ণ হয়েছি। নিরাপত্তাসংক্রান্ত অন্য শর্তাগুলোও আমরা নিশ্চিত করেছি। কাজেই আর কোন অজুহাত নেই। বেবিচক সূত্র জানায়, নিরাপত্তার কারণে অস্ট্রেলিয়ার সরকার ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক আদেশে সিরিয়া, মিসর, বাংলাদেশ, ইয়েমেন ও সোমালিয়া থেকে কিংবা এসব দেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিটের মাধ্যমে আকাশপথে পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অস্ট্রেলিয়ার পরিবহন নিরাপত্তা দফতর, অবকাঠামো ও আঞ্চলিক উন্নয়ন বিভাগ ওই বছরের ১৯ ডিসেম্বর থেকে এই আদেশ কার্যকর করে। তারপর ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে মিসরের শারম আল শেখে রাশিয়ার একটি বিমান বোমা বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হওয়ার পর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ২০টি দেশের ৩৮ বিমানবন্দরকে নিরাপত্তা বাড়ানোর কথা বলে। শাহজালাল বিমানবন্দর ছিল তার একটি। এই ৩৮টি বিমানবন্দর থেকে লন্ডনে সরাসরি বিমান যোগাযোগ বন্ধ থাকে দীর্ঘদিন। যদিও তারও আগে থেকেই যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন থেকে অনুরোধ করে আসছিল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য। এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া ঢাকা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য যুক্তরাজ্যকে দায়িত্ব দেয়। মিসরের ঘটনার পর ব্রিটিশ এভিয়েশনের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের লিয়াজোঁ অফিসার জন লাভসে ঢাকা বিমানবন্দর পরিদর্শনে আসেন। তিনি নিরাপত্তা উন্নয়নের জন্য বেশকিছু সুপারিশ করেন। প্রথম রিপোর্টটি শুধু যাত্রী পরিবহন বিষয়ক নিরাপত্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরে ওই বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তিনি ফের ঢাকা আসেন এবং দ্বিতীয় রিপোর্ট দেন, যেখানে কার্গো পরিবহনবিষয়ক সুপারিশ ছিল। তাতেই বাংলাদেশের ভাগ্যে বিপর্যয় নেমে আসে। যুক্তরাজ্য প্রথম রিপোর্ট দেয়ার পর অস্ট্রেলিয়া এককভাবে বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়াতে কার্গো সার্ভিসের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তখন যুক্তরাজ্যের রিপোর্টে বলা হয়, যাত্রীদের সঠিকভাবে স্ক্যানিং করা হয় না এবং মালামাল ট্যাগ করার যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় না। এছাড়া কার্গো রাখার জায়গায় ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার প্রতিষ্ঠানের বেসরকারী কর্মীদের সরিয়ে নিতে বলা হয়- নিরাপত্তা ট্যাগ লাগানোর মেশিন ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয় এবং কার্গো ওয়ারহাউসের বাইরের সব পণ্য ভেতরে নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এমনকি ব্রিটিশরা তাদের অভিযোগে বলেছে, বিমানবন্দরে যারা স্ক্যান করেন তারা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন, বসে বসে টেলিফোনে কথা বলেন, অন্য লোকের সঙ্গে গল্প করেন, তাদের কোন প্রশিক্ষণ নেই। এছাড়া বিমানবন্দরে এক্সপ্লোসিভ ট্রেসিং মেশিনও কাজ করে না। নিরাপত্তার এমন দৈন্যাবস্থায় ব্রিটিশ সরকার আন্তর্জাতিক মানের কোন নিরাপত্তা সংস্থা দিয়ে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করার নির্দেশ দেয়া হয়। তারপরই যুক্তরাজ্যের রেডলাইন নামের একটি কোম্পানিকে নিরাপত্তা উন্নত করার জন্য পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়। রেডলাইন এয়ারপোর্ট সিকিউরিটির ওপর এখানকার নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও কর্মীদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও বিমানবন্দরে অত্যাধুনিক সব স্ক্যানিং মেশিন স্থাপন করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। এখন শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন ইউরোপ-আমেরিকা মানের। এখানে কার্গো পণ্য স্ক্রীনিংয়ে এ্যাভসেক ও বিজিবির ডগ স্কোয়াড কাজ করছে। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন দিয়েও ডগ স্কোয়াড নামানো হয়। সর্বশেষ সংযোজন করা হয় অত্যাধুনিক এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন সিস্টেম (ইডিএস)। তাতে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন যত শর্ত দিয়েছিল সব শর্ত পূরণ হয়। তৎকালীন ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার ডেভিড এ্যাশলে ওই সময় বলেছিলেন, যুক্তরাজ্য ২০১৭ সালের শেষের দিকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি শর্ত দিয়েছিল ইউকে ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপোর্ট। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- ইউকের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদে দুজন পরামর্শক নিয়োগ, এভিয়েশন সিকিউরিটিতে ইউকে মডেল অনুসরণ করা। এসব বিষয়ে ব্যাপক উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। তারপরই ২০১৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া তারপরও নিরাপত্তা ইস্যুতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এ অবস্থায় চলে কূটনৈতিক তৎপরতা। একই সঙ্গে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ইস্যুতে আরও কার্যকর ও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে।
×