ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালীর মধুময় ছন্দের সুর

এবার কৃষ্ণের নীপবনে নয়, বাঁশি বাজবে বিশ্ববিদ্যালয়ে

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১

এবার কৃষ্ণের নীপবনে নয়, বাঁশি বাজবে বিশ্ববিদ্যালয়ে

সমুদ্র হক ॥ বাঁশি। বাঙালীর হৃদয়ের চিরন্তন ঐতিহ্যের সুর। চিত্রপটে প্রথমে ভেসে আসে; ভরদুপুরে কোন রাখাল গাছের ছায়ায় বসে ঠোঁটে বাঁশি নিয়ে সুর তুলেছে। কখনও ভেসে আসে পৌরাণিক উপাখ্যানের কৃষ্ণ নীপবনে বাঁশি বাজিয়ে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে রাধাকে। বাঁশির ১২ টি স্কেলের সব স্বর এখন শেখানো হবে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ^বিদ্যালয়ের ললিতকলা অনুষদের সঙ্গীত বিভাগে। দেশে এই প্রথম বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে বাঁশি একটি বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। সূত্র জানিয়েছে, দেশের একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বাঙালীর বাঁশি ঐতিহ্যকে চিরন্তন করে রাখতে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন। বলা হয়, বাঙালীর নিজস্ব ছয় শ’ ধরনের বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে বাঁশি অন্যতম। সমৃদ্ধ সুরের এই বাঁশিকে শিক্ষা কার্যক্রমে রাখার অনুরোধ জানান তিনি। বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। দ্রুত পদক্ষেপ নিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিবকে নির্দেশ দেন। বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকেও নির্দেশ দেয়া হয়। সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপসচিব মোঃ নূর ই আলম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে দেশের সকল পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ে ললিতকলা অনুষদের সঙ্গীত বিভাগে বাঁশিকে সাবেজক্ট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদিষ্ট হয়ে অনুরোধ জানানো হয়। এদিকে দেশের বাঁশিওয়ালারা এখন খুবই ব্যস্ত। সামনেই বাঙালীর নববর্ষ। বাঁশি বানিয়ে স্কেলের ধাপগুলো ঠিক আছে কিনা সুর তুলে তা মিলেয়ে নিচ্ছেন। এরই মধ্যে বিশ^বিদ্যালয়ে এখন শুধু বাঁশি বাজানো নয়, দেশ- বিদেশে বাঁশির ইতিহাস, সুর, নানা বিষয়ে পাঠ দেয়া হবে। এখন থেকে বাঁশির ওপর সর্বোচ্চ ডিগ্রী নেবে দেশের সঙ্গীত পিপাসু শিক্ষার্থীরা। বাঁশির আকর্ষণ ও বৈচিত্র্য হলো বাঁশের বাঁশি। এই বাঁশিকে নিয়ে রচিত হয়েছে কবিতা, গান, প্রবাদ। গানে আছে ‘কে বিদেশী মন উদাসী বাঁশের বাঁশি বাজায় বনে...’। লতা মুঙ্গেশকরের কণ্ঠের গান ‘বাঁশি কেন গায় আমারে কাঁদায়...’। বাংলাদেশের শিল্পী মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর কণ্ঠের গান ‘বাঁশি বাজে ওই দূরে চেনা কি অচেনা সুরে এ লগনে মন মোর....’। গানের সুরে এসেছে ‘মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি।’ বাঙালীর ঐতিহ্যের যত সুর আছে তার মধ্যে বাঁশির সুরের মতো মধুমাখা সুর খুঁজে পাওয়া যায় কি! গভীর রাতে কোন বাঁশিওয়ালা সুর তুললে মানব হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। গভীর রাতের বাঁশির সুর আর বেহালার সুর সমার্থক হয়ে যায়। বাঁশি বাঁশরি ও মোহন বাঁশি নামেও পরিচিত। বিদেশে নাম ফ্লুট। উপমহাদেশে বাঁশির জন্য উপযুক্ত তরলা বাঁশ। এ ছাড়া বিশেষ ধরনের মুলি বাঁশ বা নল বাঁশ; যার উভয়দিকে বেড় বা পুরুত্ব একই সমান। পুরুত্ব পাতলা হলে মিষ্টি সুর ওঠে। এই বাঁশ রোদে শুকিয়ে বাঁশির মাপ অনুযায়ী কেটে রাখা হয়। বাঁশিতে ৩ থেকে ৭ টি ছিদ্র থাকে। একটি ছিদ্র ঠোঁটে ধরে ফুঁ দিয়ে এবং বাকি ছিদ্রগুলোতে দুই হাতের আঙুলে উপর নিচ করে সুর গেঁথে নিতে হয়। বাঁশির অনেক ধরন আছে। যেমন মোহন বাঁশি, আঁড় বাঁশি, বীণ বাঁশি, বেলুন বাঁশি, খানদানি কোকিল বাঁশি, তোতা, ফেন্সি বাঁশি। তবে বাঁশির রানী মোহন বাঁশি। একটি বাঁশি বানাতে অন্তত ১৪ টি ধাপ পাড়ি দিতে হয়। প্রথমে মুলি বাঁশ কেটে রোদে শুকাতে হয়। পরে বাঁশের ছাল তুলে ফেলতে হয়। প্রতিটি ছিদ্র করার সময় স্কেল টেনে চিহ্ন করে সমান্তরাল রাখতে হয়। চোখা শিক দিয়ে ছিদ্র করার সময় কয়লার আগুন দরকার। আঁড় বাঁশির জন্য বাঁশের ছাল তুলতে হয় না। কাঁদামাটি দিয়ে নানা ধরনের নক্সা করে আগুনে সেঁকে শুকানোর পর নক্সা ফুটে ওঠে। বাঁশির মুখে মান্দাল কাঠের কটি দেয়া হয়। বাঁশি তৈরির প্রক্রিয়ায় অনেক নারী কাজ করে। বাঁশির সুরের স্কেলের কয়েকটি সার্প আছে। এ বি সি- এ সার্প, বি সার্প, সি সার্প ও জি সার্প। সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি ৭টি ও সংযুক্ত ৫টি স্বর মোট ১২টি স্বরে বাঁশি বাজে। যারা ভাল বাঁশি বাদক তাদের কাছে ১২ টি স্বরের ১২টি আলাদা বাঁশি থাকে। উদারা, মুদারা ও তারা সপ্তকের সুরেই বাঁশির প্রাণ। অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রে সাতটি সুরের স্কেল একসঙ্গে রাখা যায়। বাঁশিতে সরাসরি সাতটি এবং সহযোগী পাঁচটি স্কেল মিলে ১২ টি স্কেলের জন্য ১২টি আলাদা বাঁশি প্রয়োজন। বাঁশিওয়ালা ফটিকচন্দ্র দেবনাথের সঙ্গে দেখা। নিবিড় মনে মিষ্টি সুর তুলেছেন। লোকজন ভিড় করছে। কেউ বাঁশি কিনছে দেড় শ’ টাকায়। বললেন, যারা বাঁশি বানায় তারা বাঁশিওয়ালা। যারা বাজায় তারা শিল্পী। দেশে বাঁশি শিল্পীর সংখ্যা কম। যারা আছেন তাদের কালেভদ্রে মঞ্চে দেখা যায়। বাঙালীর চিরন্তন ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও বিশ^বিদ্যালয়ের অনেক মেয়ে বাঁশি বাজিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। বিশ^বিদ্যালয়ে বাঁশি বাজানো শেখানো হবে এমনটি শুনে তিনি মহাখুশি। বগুড়া সরকারী আজিজুল হক কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ত্বাইফ আল মামুন বিশ^বিদ্যালয়ে ললিতকলা অনুষদে সঙ্গীত বিভাগে বাঁশি সাবজেক্ট করায় সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। একই কথা বলেছেন সংস্কৃতজন সৈয়দ সুলতান আলম। বাঁশের বাঁশি বাঙালীর পরিচিতির বড় অংশ হয়ে আছে। দূর অতীতে গ্রামের অনেক শিশু-কিশোর আম খাওয়ার আঁটি দ্বিখণ্ডিত করে তার মধ্যে ছোট পাতা ভরে ফুঁ দিয়ে বাজাত। বলা হতো আমের আঁটির বাঁশি। শিশুরা তালপাতায় বাঁশি বানিয়ে বাজাত। কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশি বিশ^খ্যাতি এনেছে। ইউরোপ ও আমেরিকার ২৫টি দেশে বাংলাদেশের বাঁশি যাচ্ছে। বাঁশের বাঁশি। বাঙালীর জীবনের মধুময় ছন্দের এক সুর। মানুষে মানুষে মেলবন্ধনের পালায় যে সুর ভেসে যায় দূর, বহুদূর....।
×