ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাগরপারের অর্থকরী ফসল-পাম জাতীয় উদ্ভিদ

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ১৯ জানুয়ারি ২০২১

সাগরপারের অর্থকরী ফসল-পাম জাতীয় উদ্ভিদ

মেজবাহউদ্দিন মাননু ॥ গোল গাছ। একটি অর্থকরী ফসল। উপকূলীয় সাগরপারের এ জনপদে গোল গাছ সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে পরিচিত। বহুমুখী ব্যবহারে এর বিকল্প নেই। এক সময় (ষাটের দশকে) এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে গোল গাছ ছিল না। বিশেষ করে জোয়ারের পানি প্রবহমান এমন খালের পাড়ে কিংবা বিলে গোলগাছের বাগান ছিল। খাল-বিলের এই অঞ্চলে মাইলের পর মাইল গোল বাগানে পরিপূর্ণ ছিল। গোল গাছের কদর ছিল অনেক বেশি। বিশেষ করে গোলের গুড়ের রয়েছে আলাদা কদর। কৃষিকাজের পাশাপাশি গোলগাছের আবাদ করা যায়। আশির দশক পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষ ঘরের চালের ছাউনি ও বেড়া দিত গোলপাতা দিয়ে। আর গোলের পাতা কাটার পরে গোড়ার অংশ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হতো। কিছুই ফেলনা নয়। এখন গোলগাছ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। ৬০’র দশকে কৃষিজমি চাষাবাদের উপযোগী করতে লোনা পানির প্লাবন ঠেকাতে নদীর পাড় ঘিরে বেড়িবাঁধ করা শুরু হয়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় এবং ধানসহ রবিশস্য ও সবজির আবাদ করতে এই বাঁধ দেয়া হয়। করা হয় বাঁধের ভেতরের খালের সঙ্গে পানি নিয়ন্ত্রণে স্লুইস গেট। লোনা পানিতে বেঁচে থাকার এই গাছ তখন থেকে কমতে থাকে। এখনও সব ক’টি ইউনিয়নে বেড়িবাঁধের বাইরে গোল গাছ রয়েছে। বেড়িবাঁধের অভ্যন্তরে কিছু কিছু গোলগাছের বাগান দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি গোলগাছ রয়েছে নীলগঞ্জ ইউনিয়নে। বিশেষ করে নবীপুর এবং সোনাতলা গ্রামের চাষীরা এখনও গোলগাছের বাগান সংরক্ষণ করে আসছেন। সস্বাদু হওয়ায় গোলের গুড় সংগ্রহ করছেন, বিক্রি করছেন। বাণিজ্যিকভাবে নতুন নতুন বাগানও করছেন কেউ। লাভের মুখ দেখছেন প্রায় এক শ’ পরিবার। এখন গোলের গুড়ের চাহিদা এই অঞ্চল ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয়রা তাদের প্রিয়জনের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে এ গুড় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। গোলগাছ ভারত মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের উপকূলীয় এবং মোহনা এলাকার এক প্রকার পাম জাতীয় উদ্ভিদ। যা নিপা পাম নামে পরিচিত। এটি পামের একমাত্র প্রজাতি, যা ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে পাওয়া যায়। এটা মূল গণনিপা হতে উদ্ভূত একমাত্র প্রজাতি যার উপপ্রজাতি নিপোডিয়া। এই অঞ্চল ছাড়াও বাগেরহাটের মংলার মিঠাখালীতে খোনকার বেড় গ্রামে এক কৃষকের প্রায় দুই বিঘা জমিতে গোলগাছের বাগান রয়েছে। যেখানে কৃষি অফিস পরামর্শ দিয়ে ২০১০ সালের দিকে রস থেকে গুড় তৈরিতে সহায়তা করেছিল। মংলা উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ নুর এ আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে বর্তমানে সেখানকার গোলের গুড় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে গোলগাছ রয়েছে। তবে নীলগঞ্জে বাণিজ্যিকভাবে গুড় সংগ্রহের জন্য কয়েকটি গোলগাছের বাগান রয়েছে। বিশেষ করে নবীপুরের চাষীরা গোলবাগানের বিশেষ পরিচর্যা করেন। গোলগাছ দেখতে গোল নয়। এর পাতা নারিকেল গাছের মতো লম্বা হয়। ১০ ফুট থেকে কোন কোন উর্বর জায়গায় ১৫-১৬ ফুট দীর্ঘ গোলগাছ দেখা যায়। বিশেষ করে শীত মৌসুমের আগেই গোলগাছে ফল ধরে। একটি কাণ্ডে ফল ধরে। যাকে স্থানীয় ভাষায় গাবনা বলা হয়। তাল গাছের ডগার মতো গোলের কাণ্ডে এই গাবনা বা ফল ধরে। এমন ফলওয়ালা কাণ্ড কেটে রস সংগ্রহ করা হয়। নির্দিষ্ট সময় ছড়াসহ গাবনাটি কোন এক পূর্ণিমায় পায়ের লাথিতে কাণ্ডসহ নিচের দিকে বাঁকা করা হয়। কেউ কেউ কাদা মেখে রাখেন। গোল চাষীদের ধারণা বা বিশ^াস নির্দিষ্ট গোনে গাবনাসহ কাণ্ডটি নিচের দিকে বাঁকা করলে বেশি রস পাওয়া যায়। এরপরে ফলটি থোকাসহ এক কোপে কেটে কাণ্ডটি তালের রস সংগ্রহের মতো অল্প অল্প কেটে গোলের রস সংগ্রহ করতে থাকে। গুণগত কারণে গোলের এবং খেজুরের গুড় সহজভাবে আলাদা করা যায়। এরপরে খেজুর গুড়ের মতো আগুনে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। কিছুটা নোন্তা-মিঠার মিশ্রণ এই গুড়। ডায়াবেটিসের রোগীরা খেতে পারে বলে গুড় সংগ্রহকারীদের মতামত। আবার খেজুরের রসের মতো এই রস খেতেও সুস্বাদু। স্বাদের পাশাপাশি গোলের গুড়ের ঔষধি গুণ রয়েছে। কথিত রয়েছে, গোলের গুড় কিংবা রস খেলে পেটের কৃমি বিনাশ হয়। আবার বাসি রস খেলে তাড়ির মতো নেশা হয়। কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক ডাঃ চিন্ময় হাওলাদার জানান, এই গুড়ের এক ধরনের ভিন্নতর স্বাদ রয়েছে। আর যেহেতু এই গুড়ে খনিজ লবণ রয়েছে। যেটি মানুষের জন্য অনেক ক্ষেত্রে উপাকারী। নীলগঞ্জের নবীপুর গ্রামের চাষীরা জানান, নিচু জলাভূমি, খালের পাড়ে কিংবা মরা খালে যেখানে লোনা পানির প্রবাহ থাকে, জোয়ার-ভাটা প্রবহমান সেখানে সহজেই প্রাকৃতিকভাবে গোলগাছ বেড়ে ওঠে। গোলগাছের বাগানকে স্থানীয়ভাবে গোলবাঁওড় বলা হয়। প্রবীণ চাষী হরি নারায়ণ মিত্র (৭৮) জানান, ব্রিটিশ আমল থেকে তার দাদা বৈকুণ্ঠ মিত্র গোলগাছের গুড় সংগ্রহ করতেন। যা তারা আজও ধরে রেখেছেন। অন্তত দুই একর জমিতে এখনও তার বাগান রয়েছে। প্রায় চার শ’ গাছ থাকলেও রস সংগ্রহের মতো রয়েছে প্রায় দুই শ’ গাছ। প্রতিদিন দুই বারে চার কলসি রস সংগ্রহ করেন। গড়ে ৫-৬ কেজি গুড় তৈরি করতে পারেন। অগ্রহায়ণ থেকে প্রায় চৈত্র মাস পর্যন্ত রস সংগ্রহ করতে পারেন। গোলগাছে বৈশাখে গাবনা বা ফল ধরলে অগ্রহায়ণ মাসে কাণ্ডটি পায়ের চাপে রস নিচে ভার করতে নুইয়ে দেয়। কেউ কেউ কাদায় লেপটে রাখে। নোয়ানোর দুই সপ্তাহ পরে গাবনার ছড়ার ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে কাণ্ডের মাথা থেকে ধারালো দা দিয়ে এক কোপে গাবনা কেটে ফেলা হয়। প্রচলিত বিশ^াস, পূর্ণিমায় ডাঁটি (কাণ্ড) থেকে ফল কাটলে রস বেশি হয়। কাটা অংশ তিন/চারদিন শুকানো হয়। এরপরে তিনদিন সকাল-বিকেল দুইবার কাণ্ডের আগা কাটা অংশ পাতলা করে চেঁছে ফেলা হয়। এরপরে কাণ্ডের আগা পাতলা করে দিনে একবার কেটে ছোট্ট হাঁড়ি কিংবা প্লাস্টিকের পাত্র ঝুলিয়ে দেয়া হয়। মানসম্পন্ন গুড় তৈরির জন্য অধিকাংশ চাষী প্রতিদিন রস সংগ্রহের পাত্র ধৌত করেন। রোদে শুকানোর পরে ফের রস সংগ্রহ করেন। একটি কাণ্ড (ডাঁটি) থেকে প্রতিদিন ২৫০-৫০০ গ্রাম পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা যায়। এই রস আগুনে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয় জানান হরি নারায়ণ। ১৯৭৪ সালে এই গুড় ৫-৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন ভাল গুড়ের দাম প্রতিকেজি ১৫০ টাকা। প্রায় ২৫ লিটার রস ভর্তি এক কলসি রস থেকে চার-পাঁচ কেজি গুড় পাওয়া যায়। গোলগাছ চাষ খুবই লাভজনক এবং সহজও। গোলগাছের গাবনা বা বীজ লোনা পানিতে পুঁতে দিলেই চারা গজায়। বেড়ে ওঠে। খরচ কম। চাষে রাসায়নিক সার কিংবা কীটনাশকের ব্যবহর লাগে না। তবে কৃষকের অভিযোগ, ভরাট খালগুলোকে কৃষি জমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত দেয়ায় ওই সব জায়গায় বন্দোবস্ত গ্রহীতারা পুকুর-বাড়িঘর করে গোলবাগান কেটে সাবাড় করে দিচ্ছে। মঙ্গলবার কলাপাড়ার সাপ্তাহিক হাটের দিনে ৩০-৪০ মণ গোলের গুড় বিক্রি হয়। এসব চাষীদের তথ্যে প্রতিবছর অন্তত ৪৫-৫০ লাখ টাকার গোলের গুড় কলাপাড়ায় উৎপাদন হয়। বর্তমানে গোলগাছ অর্থকরী সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে কৃষকের কাছে। কলাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল মান্নান জানান, গোল চাষীদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া গোলের চাষ আরও কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় এমন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বনবিভাগ কলাপাড়ার কর্মকর্তা আব্দুস সালাম জানান, এ বছর আন্ধারমানিকসহ বিভিন্ন নদী তীরের চরভূমিতে তারা এ বছর প্রায় ৬০ হাজার গোলগাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। আরও ব্যাপকভাবে গোলবাগান করার পরিকল্পনার কথা জানালেন।
×