ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা অব্যাহত রাখার সুপারিশ

প্রকাশিত: ২২:১৫, ২১ ডিসেম্বর ২০২০

শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা অব্যাহত রাখার সুপারিশ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণ দেশের জন্য সম্মানজনক। তবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রফতানি বাণিজ্যে। পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা আর থাকবেনা। এ কারণে রফতানি আয় অন্তত ১৪ ভাগ কমে যেতে পারে। এই অভিঘাত থেকে সুরক্ষা পেতে এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা অব্যাহত রাখার বিষয়ে জোর দিতে হবে। জোটগত প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং অন্য প্রচলিত-অপ্রচলিত সব বাজার হিসেবে পরিচিত সব দেশ ও সরকারের সঙ্গে দর কষাকষির কাজটি চালিয়ে যেতে হবে। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে এ রকম উদাহরণ আছে। রবিবার ‘এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সরকারের প্রতিনিধিরা। শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা অব্যাহত রাখতে আঞ্চলিক জোট, বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। কোন কোন দেশ ও জোটের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) কিংবা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করার কথাও বলেছেন তারা। এছাড়া ইতোমধ্যে গঠিত জোটের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ খুঁজতে হবে। এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) এবং চীনা নেতৃত্বাধীন রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের (আরসিইপি) উদাহরণ দিয়েছেন তারা। অর্থনীতি বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (্ইআরএফ), গবেষণা সংস্থা রিসার্চ এ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র‌্যাপিড) ও এশিয়া ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এই আয়োজন করেছে। জুম প্ল্যাটফর্মে আয়োজিত এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম, বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন। বিষয়ের ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক। ইআরএফ সভাপতি শারমিন রিনভীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এতে অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশে এশিয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি কাজী ফয়সল বিন সিরাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম আবু ইউসুফ। ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন ইআরএফ’র সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশেদুল ইসলাম। প্রসঙ্গত, আগামী ২২ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট কমিটির (সিডিপি) এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করবে। ধারণা করা হচ্ছে এলডিসি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের পক্ষে সুপারিশ পাওয়া যাবে। এই সুপারিশের পর ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিশ্ববাণিজ্যে শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা অব্যাহত থাকবে। ২৮ জাতির জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) আরও চার বছর অর্থাৎ ২০২৭ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা থাকবে। এরপর এই সুবিধা আর থাকবেনা। তখন রফতানি অন্তত ১০ শতাংশ কমবে। বর্তমানের তুলনায় রফতানি কমবে ৭০০ কোটি ডলারের মতো। অন্যান্য সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও কিছুটা অসুবিধায় পড়বে বাংলাদেশ। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আছে সরকারের। দীর্ঘদিন এলডিসির মধ্যে পড়ে থাকা দেশের জন্য সম্মানের বিষয় নয়। এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে বাণিজ্য বিঘ্নিত হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তবে সেটা কেবল ২০২৪ সালেই বোঝা যাবে। বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখতে ইইউর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। ব্রেক্সিট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও এই আলোচনা করা যায়। একই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও বাণিজ্য বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। কারণ, আমদানি-রফতানিতে সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ের সুযোগ আছে প্রতিবেশীদের সঙ্গে বাণিজ্যে। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, এলডিসি নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তবে যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে। ব্যবসা বাণিজ্য সহজ করার জন্য বিডার বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন তিনি। বাণিজ্য সচিব বলেন, এলডিসি উত্তরণের পরও অতিরিক্ত আরও কয়েক বছর শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা পাওয়ার বিষয়ে চেষ্টা করছেন তারা। ইইউতে জিএসপি প্লাস সুবিধা নিয়ে আলোচনা চলছে। এলডিসিভুক্ত দেশগুলো নিয়ে সম্মিলিতভাবেও চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। ভুটানের সঙ্গে পিটিএ হয়েছে। নেপালের সঙ্গে হবে আগামী মাসে। এরকম ১১টি দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির বিষয়ে আলোচনা চলছে। মূল প্রবন্ধে ড. রাজ্জাক বলেন, মোট রফতানির ৭৫ শতাংশ এখন শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় আছে। এলডিসি থেকে উত্তরণে শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা হারানোর পাশাপাশি পণ্যে প্রণোদনা দেয়া যাবেনা। শুল্ক বাড়বে গড়ে ১৪ শতাংশ। সবচেয়ে বড় বাজার ইইউতে বাড়বে ৯ শতাংশ, কানাডায় ১৭, চীনে ১৬ দশমিক ২ ও জাপানে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। ফলে রফতানি কমে যেতে পারে ৭০০ কোটি ডলারের মতো। সবচেয়ে বড় বাজার ইইউ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভিয়েতনামের সঙ্গে জোটের এফটিএ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশটির শুল্ক কমছে ইইউতে। ২০২৭ সাল নাগাদ ভিয়েতনামের পণ্য যাবে বিনা শুল্কে। যেখানে বাংলাদেশের পণ্যে ১০ শতাংশ শুল্কারোপ হবে। তখন কঠিন অবস্থায় পড়বে বাংলাদেশ। শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা অতিরিক্ত তিন বছর বাজার সুবিধা প্রলম্বিত করার আলোচনা শুরুর পরমার্শ দেন তিনি। আগামী ২০২৩ সালে ইইউ জিএসপি পর্যালোচনা হবে। সেই আলোচনা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হতে হবে বাংলাদেশকে। এলডিসি থেকে উত্তরণের অভিঘাত মোকাবেলায় আরও বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেন তিনি। এর মধ্যে উৎপাদন ও রফতানি সক্ষমতা বাড়ানো, খাতভিত্তিক অগ্রাধিকার নির্ধারণ, দ্বিপাক্ষিক কৌশলী অবস্থান নির্ধারণ অর্থাৎ পরিস্থিতি বুঝে কোন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক, কোন জোটভুক্ত হওয়া যেমন, আরসিইপি, টিপিপিতে যুক্ত হওয়া। এছাড়া শুল্ক হার ক্রমান্বয়ে আরোপের সুযোগ নেয়া। ড. রাজ্জাক রফতানির স্বার্থে আমদানি নীতি সংস্কার, জিডিপি অনুপাতে কর বাড়ানোসহ বিভিন্ন পরামর্শ দেন।
×