ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দু’পক্ষের দ্বন্দ্বে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সঙ্কটে

প্রকাশিত: ২৩:৫০, ৪ ডিসেম্বর ২০২০

দু’পক্ষের দ্বন্দ্বে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সঙ্কটে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ‘মূল উদ্যোক্তা’র দাবি নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধে সঙ্কটে পড়েছে পর্যটন শহর কক্সবাজারের একমাত্র বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ‘কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।’ পর্যটন নগরীর একমাত্র এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিদের অনিয়ম ও বিরোধে ভয়াবহ সঙ্কটে পড়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। এই বিরোধের মধ্যেই বুধবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে ‘মূল উদ্যোক্তা’ দাবিদার সালাহউদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে প্রতিষ্ঠান দখলের চেষ্টার অভিযোগ এনেছেন ট্রাস্টি বোর্ডের সেক্রেটারিসহ কয়েকজন সদস্য। এদিকে মূল উদ্যোক্তা নির্ধারণ করে শিক্ষা কার্যক্রম ঠিক করতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশন (ইউজিসি)। কমিশন শিক্ষার্থীদের স্বার্থের কথা ভাবতে ট্রাস্টিদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে। ২০১৩ সালে অনুমোদন পায় কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (সিবিআইইউ)। জেলায় অন্য কোন পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় প্রতিষ্ঠার পরই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে প্রতিষ্ঠানটি। প্রয়োজনীয় অবকাঠানো, শিক্ষক-কর্মকর্তাসহ শিক্ষার স্বাভাবিক নিশ্চিত না হলেও কেবল অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় ওই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠানটি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু মালিকানা নিয়ে ট্রাস্টিদের বিরোধ ও অনিয়মে আজ অনেকটাই অচল প্রতিষ্ঠানটি। নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে ট্রাস্টি বোর্ড। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন লঙ্ঘন করে তহবিল থেকে বিধিবহির্ভূত সুবিধা নেয়া, অবৈধ নিয়োগসহ নানা অভিযোগত আছেই। এসব কাজের কর্তৃত্ব নিয়ে এখন দুই পক্ষের বিরোধ চরমে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাময়িক অনুমোদনের প্রথম শর্তই হলো অনধিক ২১ ও ন্যূনতম ৯ সদস্যের একটি বোর্ড অব ট্রাস্টিজ (বিওটি) গঠন। সে অনুযায়ী ১০ সদস্যবিশিষ্ট কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ট্রাস্টের অনুকূলে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে সিবিআইইউর অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাকালীন বোর্ড ও ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ছিলেন সালাহউদ্দিন আহমদ। আর সেক্রেটারি ছিলেন লায়ন মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান। বাকি আট সদস্যের প্রায় সকলেই ট্রাস্টিজের সেক্রেটারির নিকটাত্মীয়। এজন্য মূলত চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন আহমদ ও সেক্রেটারি লায়ন মোহাম্মদ মুজিবুর রহমানের নিয়ন্ত্রণেই পরিচালিত হচ্ছিল প্রতিষ্ঠান। তবে আইন লঙ্ঘন করে অনৈতিক সুবিধা ও প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন আহমদ ও সেক্রেটারি লায়ন মোহাম্মদ মুজিবুর রহমানের মধ্যে বিরোধ এখন তুঙ্গে। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করছেন ট্রাস্টি সদস্যরা। বিরোধের জের ধরে কিছুদিন আগে ট্রাস্টি বোর্ডের সভা করে সালাহউদ্দিন আহমদকে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ না করা ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের রক্ষা করার জন্য চাপ প্রয়োগের অভিযোগ আনা হয়। তার স্থলে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান করা হয়েছে কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলমকে। সালাহউদ্দিন আহমদ ইতোমধ্যেই বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী উখিয়ার জনসভায় এসে আমাকে এ বিশ্ববিদ্যালয় দেয়ার ঘোষণা দেন। আমিই এ বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাওয়ার জন্য আবেদন করি। রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক কাজে ব্যস্ত থাকায় মুজিবুরকে বিশ্বাস করে যোগাযোগকারী হিসেবে নিয়োগ করি। কিন্তু সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করে নিজের মতো ট্রাস্ট গঠন করে। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে নিজেকে উদ্যোক্তা করেছে মুজিবুর। এ বিষয়টি সংশোধনের জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষিত তহবিল ও স্থায়ী ক্যাম্পাসের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মুজিবুর। এ নিয়ে আদালতে মামলাও রয়েছে। তবে লায়ন মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান বলেছেন, আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা, প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তা। সালাহউদ্দিন আহমদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আগ্রহ প্রকাশ তাকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে ট্রাস্টের চেয়ারম্যান করা হয়। কিন্তু গত সাত বছরে বিশ্ববিদ্যালয় তার কাছ থেকে কোন ধরনের সহায়তাই পাইনি। উল্টো নানা খাত দেখিয়ে লাখ-লাখ টাকা নিয়েছেন। এখন প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দখলের অপচেষ্টা করছেন। ট্রাস্টিদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার পরও অবৈধভাবে নিজেকে বিওটি চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা বলে পরিচয় দিচ্ছেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রপোজাল বুকে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমার নামই রয়েছে। সরকার উদ্যোক্তা হিসেবে আমার নামেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে। প্রতিষ্ঠাকালীন সব ধরনের ব্যয়ভার আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা বহন করেছেন। সালাহউদ্দিন আহমদ একটি টাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় খরচ করেনি। বুধবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে ‘মূল উদ্যোক্তা’ দাবিদার ট্রাস্টি বোর্ডের সেক্রেটারি লায়ন মোঃ মুজিবুর রহমানসহ কয়েক সদস্য সংবাদ সম্মেলন করেও একই অভিযোগ এনেছেন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মাহবুবা সুলতানা। আরও উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ট্রাস্টের সেক্রেটারি লায়ন মোঃ মুজিবুর রহমান, ট্রাস্টি সদস্য আবদুস সবুর ও ট্রাস্টি সদস্য আবদুল মাবুদ। মুজিবুর রহমান বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি প্রপোজাল বুক জমা দিতে হয়। একটি ট্রাস্ট গঠন করতে হয়। প্রপোজাল বুকে প্রতিষ্ঠাতার নাম ও জীবনবৃত্তান্ত বিস্তারিত দেয়া থাকে। ডিড অব ট্রাস্টেও উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতার নাম স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যে অর্থ ব্যয় হয়েছে সেটিও আমি করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন দেয়া ইউজিসির পরিদর্শন প্রতিবেদনে এগুলোর প্রমাণ রয়েছে। গত সাত বছরে মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সব চিঠি উদ্যোক্তা হিসেবে আমার নামেই এসেছে। সুতরাং এ বিষয়ে কোন বিতর্কের সুযোগ নেই। আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা, প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তা। সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনগত কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দিপু মনি দৃষ্টি আকর্ষণও করেছেন মূল উদ্যোক্তা দাবিদারদের এক পক্ষের প্রধান মুজিবুর রহমান। এদিকে একটি তদন্ত কমিটি করে পরিস্থিতির সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে ইউজিসি। ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহিদুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলছিলেন, কক্সবাজারের একমাত্র ইউনিভার্সিটি ট্রাস্টিদের বিরোধে সঙ্কটে। দুই পক্ষই নিজেদের মূল উদ্যোক্তা দাবি করছেন। পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলাও দিয়েছেন। এমন বিরোধের মধ্যে কোথাও পড়লেখা হওয়ার কথা না। শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
×