ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ছয় মানবপাচারকারীর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিস

প্রকাশিত: ২২:৪৬, ১ ডিসেম্বর ২০২০

ছয় মানবপাচারকারীর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিস

আজাদ সুলায়মান ॥ লিবিয়ায় মানবপাচারকারী চক্রের ভয়ঙ্কর ৬ সদস্যের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিস জারি করা হয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের অনুরোধে এ নোটিস জারি করে ইন্টারপোল। যাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি করা হয়েছে তারা হলো- মিন্টু মিয়া, স্বপন, শাহাদাত হোসেন, নজরুল ইসলাম মোল্লা, ইকবাল জাফর ও তানজিরুল। এ বিষয়ে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ জিসানুল হক জানান, সিআইডির অনুরোধে মানবপাচারকারী চক্রের ৬ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি করেছে ইন্টারপোল। তারা ভাল বেতনে চাকরি দেয়ার কথা বলে বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য নারী-পরুষকে বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। মানবপাচারকারী চক্রের বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতারের পর তাদের সম্পর্কে জানা যায়। এ বিষয়ে বিস্তারিত আজ (মঙ্গলবার) সিআইডি সদর দফতরে সিআইডি প্রধান ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান জানাবেন। কিসের ভিত্তিতে এ ছয়জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে জানতে চাইলে সিআইডির একটি সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছর করোনা তাণ্ডবের মাঝে গোটা বিশ্ব যখন টালমাটাল তখন লিবিয়ায় ঘটে যায় স্মরণাতীত কালের ভয়ঙ্কর হামলা। যার শিকার হন ২৬ হন নিরীহ বাংলাদেশী শ্রমিক। দেশ-বিদেশী গণমাধ্যমের মতে লিবিয়ায় মানবপাচারচক্রের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি চাইতে গিয়ে ভয়ঙ্কর হামলায় ২৬ জন বাংলাদেশী শ্রমিক নিহত হয়। ২৮ মে সকালে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে প্রত্যন্ত মিজদা অঞ্চলে মানবপাচারকারীদের কাছ থেকে অপহরণের শিকার হন ৩৮ জন বাংলাদেশী। পরে অপহরণকারীদের গুলিতে ২৬ জন বাংলাদেশী নিহত হন। আহত হন আরও ১১ জন। এ ঘটনা দেশে-বিদেশে তোলপাড় হয়। লিবিয়ার মিজদা অঞ্চলে অপহরণকারীদের গুলিতে ২৬ জন বাংলাদেশী নিহত হন। এ ঘটনায় মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ঢাকায় কামালউদ্দিন নামের একজন আদম ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে র্যা পিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন। যে ২৬ জন বাংলাদেশীকে লিবিয়ায় হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে কয়েকজনকে কামালউদ্দিন পাঠিয়েছিলেন। কামালউদ্দিন মানবপাচারকারীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত সন্দেহে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সেই কামালকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য। র্যা ব ও সিআইডির যৌথ তদন্তে এ ঘটনার প্রকৃত দোষীদের তথ্য ওঠে আসে। তবে মানবপাচারের মতো এ ধরনের জঘন্য অপরাধে ক’জন নিরীহ ও নির্দোষ ব্যবসায়ীকেও ফাঁসিয়ে দেয়ার মতো হীনতৎপরতায়ও সক্রিয় হয়ে ওঠে স্বার্থান্বেষী মহল। বিশেষ করে লিবিয়ার ঘটনায় ডামাডোলের সুযোগে প্রতিপক্ষের ব্যবসা হাতিয়ে নেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে- লিবিয়া হয়ে মানবপাচারে দেশী-বিদেশী শতাধিক ভয়ঙ্কর পাচারকারী জড়িত। আন্তর্জাতিক অর্গানাইজড ক্রাইম সিন্ডিকেটে এসব মানবপাচারকারী সরাসরি জড়িত। এদের খুঁটি এতটাই শক্তিশালী যে, অতীতে ত্রিপলিতে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে। দূতাবাসের স্থানীয় কর্মীদের আটকে রাখার মতো সাহস দেখিয়েছে। যার ধারাবাহিতকতায় মিজদা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। মানবপাচারের এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে বিভিন্ন দেশ এবং জাতিসংঘের মতো সংস্থাকে নিয়ে বাংলাদেশকে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এ বিষয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া তথ্যমতে মানবপাচারের শিকার হওয়া যেসব অভিবাসন প্রত্যাশী মানুষ ধরা পড়েছেন, তারা সবাই জানেন কোন্ দালালকে কত টাকা দিয়েছেন। কার মাধ্যমে দিয়েছেন। বাংলাদেশের কোন ব্যাংক হিসাবে তা জমা হয়েছে। এই হিসাবও কিন্তু অতীতের সরকাঈ কর্মকর্তাদের কাছে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, লিবিয়ায় যে ২৬ জন বাংলাদেশী নিহত ও ১১ জন আহত তাদের পাচারকারী দালালরাও দেশের কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলের। অতীতেও মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুরসহ বৃহত্তর ফরিদপুর এবং সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ এ অঞ্চলের দালালেরা সক্রিয় ছিল। মিজদা কাণ্ডের ওই দালালচক্রই জড়িত। লিবিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভাষ্য হচ্ছে- লিবিয়ার যুওয়ারা, জিনতানসহ বিভিন্ন এলাকা এখনও মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণে। তাই মানবপাচারের বিষয়টিও তাদের নিয়ন্ত্রণে। যেসব লোক ইউরোপ যাওয়ার জন্য লিবিয়ায় আসছেন তারা বেনগাজি দিয়ে আফ্রিকার দেশটিতে প্রবেশ করেন। তাদের লিবিয়ার ভিসা থাকে না। থাকে অন্য দেশের ভিসা। ফলে অবৈধ ওই প্রক্রিয়ার অনেক কিছুই ঠিক করে মিলিশিয়া আর মানবপাচারকারীরা। লিবিয়া কেন এখনও মানবপাচারের ভয়ঙ্কর রুট জানতে চাইলে দেশের শীর্ষ একজন জনশক্তি রফতানিকারক দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালিতে মানবপাচার বেড়ে যাওয়ায় ২০১৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে গৃহযুদ্ধ কবলিত আফ্রিকার দেশটিতে বাংলাদেশের লোকজনের যাওয়া বন্ধ করে দেন আদালত। পরের কয়েক বছর লিবিয়া হয়ে মানবপাচার বন্ধের জন্য কিছু পদক্ষেপও নেয়া হয়। কিন্তু মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে জোরালো কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে পাচারকারীরা। যার করুণ পরিণতি ঘটে মিজদায়। হামলাকারী শুধু লিবিয়ার সঙ্কট নয়, করোনা তাণ্ডবে যখন গোটাবিশ্ব টালমাটাল এমন মুহূর্তটাকেই বেছে নেয়। কারণ মানবপাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ব্যক্তিরা সঙ্কটকালে বেশি সক্রিয় থাকে। এবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তাদের জন্য নতুন সুযোগ করে দিয়েছে। মহামারীর কারণে সারাবিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দায় নিয়মিত অভিবাসনের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ছে। এটাকে পুঁজি করে তারা ভূমধ্যসাগরে মানবপাচারে বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। মিজদায় যেভাবে বাংলাদেশীদের অপরহরণের পর নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হয়েছে তা আমলে নিয়ে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টিকারী ওই হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকায়ও তৎপর হয়ে ওঠে র্যা ব সিআইডিসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। যদিও অতীতেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ত্রিপলিতে বাংলাদেশ দূতাবাস, র্যা ব ও পুলিশের ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট নামে একটি শাখা সমন্বিতভাবে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। বিগত ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত পরিচালিত সমন্বিত ওই উদ্যোগ যথেষ্ট কার্যকর ছিল। পুলিশের ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বৃহত্তর ফরিদপুরের মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি পদক্ষেপ নিয়ে তাদের গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। দূতাবাসের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা সংস্থা বেশ ত্বরিতগতিতে অনেক সফল অভিযান চালিয়েছিল। মানবপাচারকারীর দালালেরা যে দেশগুলো হয়ে লোকজনকে আনে সেখানে বেশ সক্রিয় থাকে। সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, মিজদা হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকায় ব্যাপক তদন্তে এ সম্পর্কে মানবপাচারকারীদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। দীর্ঘ তদন্তের পর প্রায় শতাধিক মানবপাচারকারীর নাম ওঠে আসে যারা দেশ-বিদেশে সক্রিয়। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে ৬ জনকে ভয়ঙ্কর চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিস পাঠানোর আবেদন জানায় সিআইডি। ইন্টারপোল তাতেই সাড়া দিয়ে এদের বিরুদ্ধে জারি করে নোটিস।
×