ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মগত হাইপোথায়রয়েডিজম

প্রকাশিত: ২৩:৫২, ২৪ নভেম্বর ২০২০

জন্মগত হাইপোথায়রয়েডিজম

জন্মগত হাইপোথায়রয়েডিজম বলতে থায়রয়েড হরমোনের ঘাটতি জনিত সমসাকে বুঝাই, যা নবজাতকের জন্মের আগে থেকেই বা জন্মের সময় সংঘটিত হয়েছে। এসব শিশু যদি জন্মের ২ বছরের মধ্যে পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পাই তা হলে দৈহিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বৃদ্ধি মারত্মকভাবে ব্যাহত হয়। থায়রয়েড হরমোন তৈরির কাঁচামাল হলো আয়োডিন, যা আমরা খাবারের সঙ্গে পেয়ে থাকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) তথ্য মতে এখনও পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেরই কম-বেশি এলাকা আয়োডিন ঘাটতিতে আক্রান্ত। অনেক দেশ সামগ্রিক আয়োডিন অবস্থার উন্নতি করতে পারলেও নেপাল, ভুটান, ইন্দোনেশিয়া, পেরু, জায়ের, চীনের পার্বত্য এলাকাসমূহ, ভারতে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং বাংলাদেশের কিছু কিছু অংশ আয়োডিনের ঘাটতি প্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। শিশু মাতৃগর্ভে বেড়ে উঠার সময় কালের সাধারণত চতুর্থ থেকে দশম সপ্তাহের মধ্যে তার থায়রয়েড গ্রন্থিটি তৈরি হতে থাকে। যদিও সকলের ক্ষেত্রে ঘটে না, কিন্তু কিছু কিছু গর্ভস্থ শিশুর থায়রয়েড গ্রন্থিটি সঠিকভাবে তৈরি হতে ব্যর্থ হতে পারে ‘কারও কারও ক্ষেত্রে অপূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হয়’ কোথাও কোথাও গ্রন্থির কাঠামোগত ত্রুটি থাকতে পারে। কোথাও কোথাও জিনগত ত্রুটিও থাকতে পারে। যদি গ্রন্থিটি সঠিকভাবে তৈরি হয়, তাহলে ১০-১১ সপ্তাহের গর্ভকালীন সময়েই এ গ্রন্থিটি থায়রয়েড হরমোন উৎপাদন করতে সমর্থ হয় এবং ১৮-২০ সপ্তাহের মধ্যেই গর্ভস্থ শিশুটির রক্তে থায়রয়েড হরমোনের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রাই পৌঁছাতে পারে। যদি কোন সমস্যা না থাকে, তাহলে এ শিশুটির পিটুইটারি-থায়রয়েড অক্ষ স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম হবে। জন্মগত অন্যান্য ত্রুটিও এখানে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। মায়ের রক্তের থায়রয়েড হরমোনের পরিমাণ সাধারণত: গর্ভস্থ শিশুর থায়রয়েড গ্রন্থিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত নাও করতে পারে। কিন্তু মায়ের থায়রয়েড গ্রন্থির সমস্যা শিশুর থায়রয়েড গ্রন্থির গঠনের ওপরে বা কার্যকারিতার ওপরে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বিশেষ করে মায়ের যদি অটোইমিউন থায়রয়েড রোগ থেকে থাকে। যেখানে মায়ের রক্তে ওমএ অঁঃড় ঊহঃৎু নড়ফু চষধপবহঃধ বা গর্ভফুল পার হয়ে শিশুর রক্তে প্রবাহে পৌঁছে যায়, যা শিশুর থায়রয়েড হরমোন তৈরিতে বাধা দিতে পারে। আবার এ প্রভাবটি সাময়িকও হতে পারে। রেডিও এক্টিভ আয়োডিন চিকিৎসা যদি গর্ভকালীন মহিলাকে দেয়া হয়, তবে তা শিশুর থায়রয়েড গ্রন্থিকে স্থায়ীভাবে অকার্যকর করে ফেলে। থায়রয়েড হরমোন শিশুটির স্নায়ুতন্ত্র তৈরিতে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যা বহু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। আয়োডিনের ঘাটতি জনিত এলাকার (বাংলাদেশ ও ভারতে কিছু অংশসহ) নবজাতকদের ৫-১৫ শতাংশ জন্মগত হাইপোথায়রয়েডিমে ভুগতে পারে। অন্যান্য এলাকায় বিশেষ করে আয়োডিন পর্যাপ্ত অঞ্চলসমূহে এ রোগের প্রাদুর্ভাব কম দেখা যায়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি চার হাজার জীবিত শিশুর মধ্যে একজন শিশু এরোগে আক্রান্ত হতে পারে। পৃথিবীর কোন কোন অঞ্চলে ২-৩ হাজার জীবিত নবজাতকের একজনকে এ সমস্যায় আক্রান্ত হতে দেখা যায়। একটি গবেষণায় বাংলাদেশে প্রতি ৪০০ (চার শ’) জন নবজাতকের একজন জন্মগত হাইপোথায়রয়েডিজমে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা ব্যক্ত করা হয়েছে। জন্মগত হাইপোথায়রয়েডিজমে আক্রান্ত নবজাতক বা শিশুদের সুগভীর ও অপূরণীয়ভাবে মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। স্নায়ুবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়াটা প্রথমত: বুদ্ধি বৃত্তিক বৃদ্ধিহীনতা বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে লক্ষণীয় হতে পারে। ক্রমশ: দৈহিক কাঠিন্যের ঘাটতি বা থলথলে ভাব, অঙ্গপ্রতঙ্গের অস্বাভাবিক নড়াচড়া, কথা বলা বা শব্দ শুনতে অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হতে পারে। এ সময় শিশুটির থায়রয়েড হরমোনের মাত্রা পরিমাপ করলে স্বাভাবিক পাওয়া যেতে পারে, এমনকি শিশুর দৈহিক বৃদ্ধিও অনেকটা স্বাভাবিক মনে হতে পারে। এ ঘটনাটি সাধারণত: মাতৃগর্ভকালীন সময়ের প্রারম্ভিক সপ্তাহগুলোতে মায়ের রক্তে আয়োডিনের ঘাটতির কারণে হতে পারে। শিশুরও অনেক ক্ষেত্রে মিগজিমা হতে পারে, যেখানে শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হবে, থলথলে চামড়া থাকবে, শিশুটি হাবাগোবা হবে, তবে স্নায়ুবিক সমস্যা নাও থাকতে পারে। নবজাতকের এ সমস্যাগুলো ছেলে শিশুর চেয়ে মেয়ে শিশুকে দ্বিগুণ হারে আক্রান্ত করে। দীর্ঘদিন যাবত যেসব এলাকায় আয়োডিনের ঘাটতি বিরাজ করছে, সেখানে ক্রেটিনিজম ধরনের জন্মগত থায়রয়েড হরমোন ঘাটতি জনিত রোগ দেখা যায়। এসব শিশু সাধারণত: স্বাভাবিক গর্ভকালীন পূর্ণ করে অথবা এ সময়কাল অতিক্রম করে জন্মগ্রহণ করে। এরা অতিশয় কম নড়াচড়া করে, কপালের উপর দিকের অংশটা বৃহৎ আকার থাকে, খাদ্য গ্রহণে অনীহা থাকে, দৈহিক বৃদ্ধি কম হয় বা ক্ষুদ্রাকৃতির হয়, মাংশপেশীগুলো খুব নরম হয়, কোষ্ঠকাঠিন্য থাকে এবং অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বর থাকে যা অনেক সময় বিড়ালের মিউ মিউ শব্দের মতো মনে হতে পারে। এদের প্রথাগতভাবে (বিশেষ করে বাংলাদেশে) খুব ভাল শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হতে পারে। জন্মগত হাইপোথায়রয়েডিজমে আক্রান্ত শিশুরা ২৫০ গ্রামের কম বা ৪৫০ গ্রামের বেশি দৈহিক ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে থাকে। এসব নবজাতকের জিহ্বা বৃহদাকার হতে পারে আইকিউ পরিমাপ করলে কাক্সিক্ষত মাত্রায় চেয়ে ১০-২০ পয়েন্ট কম পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে মায়ের থায়রয়েড রোগে ভোগার ইতিহাসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে। যেসব শিশুর মাঝে উপরিউক্ত লক্ষণসমূহ পাওয়া যাবে তাদের রোগ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে রক্তের থায়রয়েডের হরমোন (ঞ৪) এবং ঞঝঐ পরিমাপ করা হয়। সাধারণত: ঞ৪ কম পাওয়া যায় এবং ঞঝঐ বেশি থাকে। মায়ের থায়রয়েড হরমোনে অস্বাভাবিকতা যেহেতু অনুমেয়, মায়ের রক্তে থায়রয়েড হরমোনের মাত্রা (ঋঞ৪, ঞঝঐ, ঊহঃৎু ঞযুৎড়রফ ঊহঃৎুনড়ফু) পরিমাপ করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে নবজাতকের থায়রয়েডের আল্ট্রাসনোগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে। মায়ের থায়রয়েড গ্রন্থির আল্ট্রাসনোগ্রামও অনেক সময় দরকার হয়। রোগ শনাক্ত করার পর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা খুব সোজাসাপটা। শিশুটির দৈহিক ওজন মেপে থায়রয়েড হরমোন ট্যাবলেট খাবার জন্য চিকিৎসক পরামর্শ দেবেন। তবে আয়োডিনের ঘাটতি জনিত এলাকাসমূহে শিশুটির এবং মায়ের খাদ্য থেকে পর্যাপ্ত আয়োডিন পাবার ব্যাপারে জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে আয়োডিন সমৃদ্ধ মাছ, আগাছা এবং আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এসব শিশুদের বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে শারীরিক কর্মকাণ্ডের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিশেষায়িত শারীরিক শ্রমের ব্যবস্থা করতে হবে। মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়ে থাকতে, সেক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়াটা জরুরী। থায়রয়েড হরমোন খাওয়ানো শুরু করার ৪-৬ সপ্তাহ পরে ঋঞ৪, ঞঝঐ পরিমাপ করে ওষুধের পরিমাণ সমন্বয় করতে হবে। এভাবে পরবর্তী জীবন ওষুধ সমন্বয় করে পার করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে জন্মগত হাইপোথায়রয়েডিজমের লক্ষণগুলো খুব সুস্পষ্ট নাও হতে পারে। কিন্তু ক্ষতিকর প্রভাব খুব মারাত্মক হওয়ার কারণে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই নবজাতকদের স্ক্রিনিং করার ব্যবস্থা আছে। যাতে দ্রুত রোগ শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে তা নেই। কিন্তু কোনভাবেই এটিকে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। তাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এবং ব্যাপক গুরুত্বসহকারে নবজাতকদের হাইপোথায়রয়েডিজমের স্ক্রিনিং করার ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। লেখক : সহকারী অধ্যাপক হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। Email:[email protected]
×