ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দরীর পাঁচালী

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ২০ নভেম্বর ২০২০

সুন্দরীর পাঁচালী

পাকাচুল বাতাসে দোল খাচ্ছিল পঁয়ষট্টি পার হয়ে যাওয়া প্রবীর কুমারের। এখনও শক্তিশালী হৃষ্টপুষ্ট দেহ। ফুলশার্ট গায়ে, ইন করে পরা কালো প্যান্ট। হাতে স্টিয়ারিং, পাশে রিচি বসে আছে। একটা সুন্দর হলুদ ফুল-ফুল ফ্রক পরা। ফুরফুর হাওয়া লাগছে ওরগায়। লোকটিকে মন্দ লাগে না রিচির। পরিচয় ছমাসের। ডুবন্ত শিল্পপতি। নাটকপাড়ায় পরিচয়। এরপর নামী-দামী রেস্তরাঁয় চা-পান, আড্ডা, শাড়ি কিনে গিফ্ট দেয়া। নতুন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া। রোকেয়া হলের বাইরের এই জীবনটা ভীষণভাবে রিচিকে আকৃষ্ট করে। ইংরেজী সাহিত্যে অনার্স শেষ করার পর থেকেই ছবির নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন প্রবীরকুমার। নতুন জগত, ভীষণ ব্যস্ততা থাকবে। শুধু কাজ আর কাজে নাকি ডুবে থাকতে হবে। গাড়ি চালাতে চালাতে আজও সেই স্বপ্ন। ‘বুঝলি রিচি, তোকে কিন্তু ছাড়ছি না। আমার শেষ স্বপ্নটা তোকে পূরণ করতেই হবে।’ ‘স্যার আচ্ছা।’ ছোট হাস্যে রিচি মাথা নাড়লো হাঁ ভঙ্গিতে। ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি, জানিস তো?’ ‘জানি স্যার।’ ‘আচ্ছা, তোকে কত করে বলললাম শুধু স্যার স্যার করবি না। তুই তো কথা শুনছিস না?’ কণ্ঠে বিরক্তি ঝরে প্রবীর কুমারের। ঈষৎ হাসি রিচির ঠোঁটেও। ‘আপনি শিল্পপতি, ব্যবসায়ী। উচ্চশিক্ষিত। টরোন্ট ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন। আর আমি তো গাঁ-গঞ্জ থেকে এসেছি, স্যার। জীবন সবে শুরু।’ ‘শোন্ এসব কখনও বলবি না। তোকে আমার বন্ধু মনে করি। জানিস্, বয়েস কখনও কখনও ফ্যাক্টর তবে সবসময় নয়।’ কথা বলতে বলতে প্রবীরকুমার নীল গাড়িটা ইউটার্ন নিলেন। রিচির দিকে এক পলক চোখ বুলিয়ে নিলেন প্রবীর কুমার। এমন অসাধারণ রূপবতী জীবনে কমই দেখেছেন। যেমন লম্বা তেমনি ঢেউ খেলানো ফিগার। টানাটানা চোখ। গায়ের রং শ্যামলা হলেও ভীষণ আকর্ষণীয়। দৃষ্টিতে কখনও জড়তা উপস্থিত থাকে না। বিশ-একুশের মেয়ে রিচি। ওর সঙ্গ পাবার জন্য আকুলি-বিকুলি করে প্রবীর কুমারের মন। কিন্তু রিচি যে বিষয়টি দারুণভাবে উপভোগ করে তা হয়তো প্রবীরও জানেন না। করোনাকালে ড্রাইভার ছুটি কাটাচ্ছে। প্রবীর কুমারের ধারণা, সে-ইযদি করোনা ছড়ায় তবু দোষ পড়বে নিজের ঘাড়ে। এজন্যেই নিঃসন্তান প্রবীর স্ত্রীর মতে ড্রাইভারের ছুটির পক্ষে ছিলেন। দুই মাসের অগ্রিম বেতন পেয়ে সে মহাআনন্দে বাড়ি গেছে। ফলে গাড়িটি এখন পুরোপুরি প্রবীর কুমারের নিয়ন্ত্রণে। যেখানে গাড়ি থামল এটা রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থল, কাকরাইল। চারদিকে উঁচু ভবন। লাল-নীল-সাদা বাড়ি। গেটে বিরাট করে লেখা ‘মডার্ন হাউজ।’ অতিসুন্দর অফিস। ফ্যান নেই। অথচ কী চমৎকার শীতলতা। দামী-দামী ফুলের টব। সাজানো সোফাসেট, মোলায়েম কাপড়ে বানানো কভার। ডিজাইন করা রঙের কাপে লাল চা, মাঝারি আকারের ট্রেতে সিরামিকের কেৎলি, চিনির বাটি, চামচ, একজোড়া কাপ। রিচিকে মডার্ন হাউসের অফিস সংলগ্ন কক্ষে বসিয়ে রেখে ভেতরে ঢুকলেন প্রবীর কুমার। তিনি রিচিকে জানিয়ে গেছেন বিচারকরা কয়েকজন ভেতরে। সুন্দরী কনটেস্ট হবে এ সপ্তাহের মধ্যে। সুবিশাল কক্ষে ঢুকেই প্রবীর কুমারকে দেখে প্রধান আয়োজক দাঁড়িয়ে গেল। স্যুট-কোট পরা। প্রৌঢ় বয়েসী লোক। স্বাস্থ্যবান, লম্বা-চওড়া। অভ্যর্থনা জানিয়ে বললো, ‘স্যার, আমাদের কী ভাগ্য আপনি এসেছেন। ভেবেছিলাম করোনাকাল তো।’ ‘না না, কাজ করতে হবে। ঘরে বসে থাকলে খাব কী?’ ‘স্যার, অভাবের কথা আপনার মুখে মানায় না।’ ‘মানায়, খুব মানায়।’ ‘স্যার, আপনারই অপেক্ষা করছিলাম। একটু সোফায় বসতে হবে। এরমধ্যেই হাতের কাজটি শেষ করে ফেলব। মাত্র দুয়েক মিনিট সময়।’ আয়োজকের সামনে মুখোমুখি চেয়ারে বসা মধ্যবয়সী লোক, স্যুট-কোট পরা। খুব সতর্কতার সঙ্গে কথা হচ্ছে দুজনের। স্বাস্থ্যবান লম্বা-চওড়া। দরজা বন্ধ হয়ে গেলে ক্লিক করে শব্দ হয়। ইংরেজী এল আকৃতির সোফা। দেয়ালে টাঙানো চিত্রকর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অর্ধদৈর্ঘ্যরে প্রতিকৃতি চিত্রকর্ম মোনালিসা। হাসিহাসি মুখ করে আয়োজক বললো, ‘স্যার, আমার কাজ শেষ। সামনে আসুন।’ চেয়ারে বসতে বসতে প্রবীরকুমার জিজ্ঞেস করেন, ‘সুন্দরী প্রতিযোগিতায় আপনারা কী কী দেখেন!’ আয়োজক চুপ হয়ে থাকল কয়েক সেকেন্ড। এরপর দার্শনিকের মতো বলল, ‘অনেক ঘটনাই, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা মনে হয়। নানা কিছু, অনেক বিষয়।’ ‘তবু, জানতে চাই কোন্ কোন্ বিষয়?’ ‘স্যার, অনেক কিছুই আমাদের দেখতে হয়। শুধু রঙ সুন্দর হলেই হবে? হবে না!’ আয়োজক শিরোমনি যেন কারও জন্য অপেক্ষা করছে। মুখ পড়েই বোঝা গেল। তার মন অন্যদিকে। ‘থেমে গেলেন কেন?’ তাড়া দিলেন প্রবীর কুমার। গায়ের নেভি ব্লু কোট টেনেটুনে সোজা বসে আয়োজক জবাব দিল, ‘কী যে বলেন স্যার, থেমে যাব কেন?’ ‘অর্ধেক ভেতরে রাখেন, অর্ধেক কথা ছাড়েন। এ জন্য বলছি। ক্লিয়ার করেন না কেন?’ খানিকটা বিরক্তিভরা শঙ্করের মুখ। ‘স্যার কী বলব, কমপিটিশনে রেজাল্ট করলে সিনেমায় চান্স পায়। কিন্তু আমরাই এই সুযোগটা করে দিলাম, এ কথা ওরা মনে রাখে না।’ ‘মেয়েরা না ছেলেরা?’ ‘মেয়ে হোক বা ছেলে হোক। সিনেমার নায়িকা না হলেও মেয়েরা টাকাওয়ালা ভাল স্বামী পায়। সুন্দরী মেয়েদের পুরুষরা ভীষণ ভালবাসে। স্ত্রী সুন্দরী হলে প্রথম কয়েক বছর স্বামী দারুণ আকর্ষণবোধ করে। কিন্তু পরে? অন্য পুরুষরা কিন্তু সুন্দরী রমণীকে ভীষণ পছন্দ করে। স্যার, সত্যি বলিনি। বেয়াদবি হলে মাফ করবেন।’ ‘নারীদের তো কোন না কোন যোগ্যতা আছেই।’ আয়োজক মৃদু হেসে বলল, ‘স্যার, আপনার অনেক নাম-ডাক। প্রেমের সিনেমার পাওনিয়ার বলতে গেলে। বহু টাকা সিনেমাতে ইনভেস্ট করে থাকেন। কিন্তু কখনও সুন্দরী প্রতিযোগিতার খোঁজ নিতে দেখিনি।’ ‘যাক এসব। তবে কথা কী, এখন, এটির প্রয়োজন পড়েছে। সুন্দরী কমপিটিশনের দরকার পড়েছে।’ কথা শেষ করে পকেট থেকে রুমাল বের করে চশমা মোছেন প্রবীর। ‘স্যার, গলা ভেজাবেন? দুই পেগ ব্ল্যাক লেভেল নেবেন নাকি?’ চশমা চোখে দিতে দিতে প্রবীরকুমার আপত্তি জানান, ‘এসব খেলে আমার ডাক্তার ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। না, থাক। আজ আর হুইস্কি খাব না।’ ‘করোনা! আমাদের ব্যবসা শেষ করে গেছে।’ প্রবীর কুমার জবাব দেন, ‘শুধু আমাদের দেশে নয়, এ সমস্যা গোটা দুনিয়ার।’ ‘এইটা আমাদের শেষ কাজ? বিউটি কনটেস্ট আয়োজন আর করব না।’ ‘মানে?’ ‘স্যার, আমি একটু গলা ভেজাই। দুই পেগ না খেয়ে পারছি না। তবে অনুমতি দেন যদি।’ ‘শিওউর, আপনি চালান।’ বুক পকেট থেকে সিগারেট প্যাকেট বরে করে একটি জ্বালান প্রবীর। আয়োজক হুইস্কি গলালকরণ শেষ করে। সিগারেট ধরায়। ডান দিকে ধোঁয়া ছাড়ে। টেবিলের ওপর কনুই রেখে দুহাতের আঙ্গুল নাচাতে নাচাতে সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজক বলল, ‘একটা কথা কী জানেন স্যার, সবকিছুই মাল। মালের সঙ্গে সম্পর্ক। বহু টাকা-পয়সা আটকা। বিজ্ঞাপন আটকা। টেলিভিশন-মিডিয়ার কিছু সাংবাদিক আছে। ওরা মালকড়ি দিতে পারি না, পেমেন্ট বন্ধ। একটি বেসরকারী টেলিভিশনে এখন উল্টোপাল্টা খবর দিচ্ছে। আমি নাকি মেয়েবাজি করি? স্ক্যান্ডাল ছড়াচ্ছে। ওরাই এক সময় এত প্রশংসা করেছে আর ওরাই এখন উল্টোটা করছে। লাখো টাকাওলা ক্লায়েন্টরা এখন দশ হাজার টাকার উপরে ওঠে না।’ ‘হ্যাঁ, তা হতেই পারে। সময় লাগবে, তবে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’ বললেন প্রবীর কুমার। আরেক চুমুক হুইস্কি গিলে আয়োজক বলল, ‘স্যার, সৌন্দর্য এমন এক জিনিস। যা হাত দিয়ে ধরা যায় না। কিন্তু বোঝা যায়। মুখ চোখের গড়ন দেখি, ফিগার দেখি, হাঁটাচলা দেখি, ব্যক্তিত্ব দেখি, বুদ্ধিমত্তা দেখি, উচ্চশিক্ষিত হতেই হবে এমন নয়। আমাদের হিসাবটা অন্যরকম। যদি বুঝতে পারি শিক্ষা-দীক্ষা কম আছে, এর জন্য আলাদা ব্যবস্থা করি। কৌশল করি।’ ‘কৌশল মানে?’প্রবীর কুমারের জিজ্ঞাসা। ‘কৌশল মানে ব্যবসা। ভদ্রঘরের যেমন হতে পারে তেমনি সাধারণ পরিবারের মেয়েও হতে পারে। নিম্নঘরের হতে পারে। স্যার, আপনি এদেশের নামকরা একজন ফিল্মফিগার। সবকিছুই তো আপনি বুঝবেন। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে কৌশল সবচেয়ে জরুরী।’ ‘যতই কৌশল বলেন না কেন, কালোকে কালো, সাদাকে সাদা বলতেই তো হবে।’ মন্তব্য শেষে এস্ট্রেতে ছাই ফেলেন প্রবীর কুমার। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আয়োজক বলল, ‘স্যার দিন পাল্টেছে। এই তো গতবার একটি মেয়ের স্ট্যাটিসটিক ছিল একত্রিশ-একুশ-বত্রিশ। কিন্তু আমরা আটকে দিলাম। টল মেয়ে। কারণ বিশেষ নির্দেশ ছিল ওই সাধারণ মেয়েটির বিষয়ে। কারণ, প্রথমকেই আটকাতে হবে। আপনি অবশ্যই জানেন তবু বলে দিই স্ট্যাটিসটিকÑ অর্থাৎ বুক, কোমর এবং নিতম্বের মাপ।’ হুইস্কির গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে আয়োজক এবার বলল, ‘কোন কোন মেয়ের চোখের চাহনি অসাধারণ। টাকাওয়ালা পুরুষেরা আকর্ষিত হয়। টল হলেও ফিগারটা যুৎসই না। কী করব তখন। কিন্তু টিকাতেই হবে।’ প্রবীর কুমার বললেন, ‘এর কৌশল কী।’ এদিক-ওদিক তাকিয়ে আয়োজক মুখ এগিয়ে বলল, ‘স্যার, ফুলমতি ব্যাংকের এমডি সাহেবের নানান অভ্যাস আছে। দিনকে রাত বানাতে পারে। তিনি নিজেই স্ট্যাটিকটিস বানান। মেয়ে মানুষের পাগল।’ ‘ওসব কথা থাক। আপনারা প্রাণোদনা পাচ্ছেন। যেহেতু ব্যাংকার সুপরিচিত, মোটেই অসুবিধা হবে না।’ ‘স্যার, এটাই বলছি, মেয়ে মানুষের ব্যবস্থা হলেই সবকিছু মুঠায়।’ কথা শেষে খিকখিক করে হাসল বিউটি কনটেস্টের চিফ আয়োজক। আরেকটি সিগারেট ধরালেন প্রবীর কুমার। এরপর চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন। ‘ঠিক আছে, আজ আসি।’ ‘ওকে আচ্ছা, স্যার আপনার নতুন ছবির খুব ফোকাস-পাবলিসিটি দেখছি পেপার-ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়। রিলিজ হচ্ছে কবে?’ ‘শিগগিরই হবে।’ ‘করোনাকালে?’ ‘সিনেমা হলে পরে যাবে। করোনাকালে ঘরের বিনোদন হোক না! পারিবারিক ছবি। টেলিভিশনে দেখুক না দর্শক।’ ‘খরচ? এত টাকা? বলেন কী?’ বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা। হাঁ ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন প্রবীর কুমার। এরপর মুখে মৃদু হাসি। সুন্দরী প্রতিযোগিতায় রিচিকে যোগ দেয়ানোর বিশেষ উদ্দেশ্য প্রবীর কুমারের। তিনি নতুন চমক দেখাতে চান। কিন্তু রিচিকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তাও হয়।
×