ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আলোময় বিশ্বাস

কবিতায় নৈতিকতা ও শৈল্পিক অনুষঙ্গ

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ২০ নভেম্বর ২০২০

কবিতায় নৈতিকতা ও শৈল্পিক অনুষঙ্গ

‘কবিতায় নৈতিকতা’ এমন কথা হালের অনেক পাঠক বা কবিদের কাছে বোধগম্য না-ও হতে পারে। কারণ পুঁজিবাদী সমাজের বাতাবরণ এমন কথাকে ক্লিশে বলে পরিত্যাগ করে থাকে। অথচ কবি মতিন বৈরাগী তাঁর কবিতার সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন এমন সব বিশুদ্ধ নৈতিকতার পরিসরের উপাচারে। তাঁর এ নৈতিকতা দাঁড়িয়ে আছে মার্ক্সীয় দর্শনের রুচিবিদ্ধ পথে, অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে, অবহেলিত ও পীড়িত মানুষের কল্যাণে, প্রকাশে শৈল্পিক অনুষঙ্গ, বিকাশে আধুনিক পরিক্রমা। কোন প্রতারণা নয়, এখানে কবি ও কবিতা এক অনুপম কাব্যমোহনায় অনেক বর্ণে একসঙ্গে মিলেছে। এই মিলন সবুজ স্বদেশ ভূমিকে অতিক্রম করে ছুঁয়েছে আন্তর্জাতিক গোলক, গোলক ছাড়িয়ে সৌরলোকে তার প্রসার। আমরা কবিকে উপলব্ধির প্রস্রবণে পেয়ে যাব যদি আরদ্ধ নৈতিকতাকে পাশে বসিয়ে পড়ে যাই ‘দূর অরণ্যের ডাক শুনেছি’ বা ‘বিষণ্ন প্রহরে দ্বিধাহীন’ এর মতো তাঁর আর সকল কাব্যগ্রন্থ। ‘কে যেন অবচেতনের দরজা ভেঙে ডাক দিয়ে গেল বলে গেল দেখিস এই রাতের শেষের পৃথিবীটা অন্যরকম হবে জীবনের মমত্বে লেগে থাকা ক্লান্তি ধুয়ে মুছে যাবে শস্যের সম্ভাবনায় হবে গো বৃষ্টি, হবে’- কবির এই ভরসা শুধু কবিতার পঙ্ক্তি নয়, কবি এসব সত্যবলে মানেন। অন্য এক পৃথিবী! এটাই বা কেমন? এইখানে পাঠক ভাবতে শুরু করেন কল্পনায় মমতার স্বরূপ উন্মোচিত হয়, ভাবনায় সুন্দরের জন্মগাথা পাঠকের অন্তরে অন্য এক প্রত্যয়ের জন্ম দেয়। ‘সভ্যতার সন্ধিক্ষণে আমার কাঁধের উপর ক্ষয়ে যাওয়া রৌদ্রের-কণা, বিষণ্ন বিদ্যুৎ না-কি সময়টা বয়ে বয়ে হাওয়া দিচ্ছে কোন কিছু বদলে নেবার জন্য’! সভ্যতার সন্ধিক্ষণে- মানে কি? এই সভ্যতা কি এখন পরিবর্তনের দরোজায় কড়া নাড়ছে? কোন আরাধ্য সভ্যতা কি অপেক্ষা করে আছে খিলানের প্রান্তে? এটা কি কোন বিপ্লবের আভাস? বদল হবে হাওয়া, আহা! অপেক্ষা। এই হাহাকার আর অভাব জন্মের যুগে অপেক্ষার আর কি বিকল্প হতে পারে, অপেক্ষা তো আশারই পথযাত্রা। অযাচিত অলংকারে ভারী হয়ে ওঠে না কবিতা, হঠাৎ কবিতার নাকের একমাত্র হীরক স্ফটিক দ্যুতি ছড়ায় পাঠকের চোখে, আহা! কী সহজে লিখে ফেলেন, ‘আকাশটা ছিল আকাশের মতো একা’- অসীম ব্রহ্মাণ্ড নিজেকে ভীষণ একা লাগে তখন। ২ কবি মতিন বৈরাগী লেখা শুরু করেন একটু পরে, তার সমবয়সী কবিরা যখন খ্যাতির মধ্যগগনে তখন তিনি সমাজতন্ত্র গঠনের সৈনিক, সার্বক্ষণিক নিয়োজিত শ্রমিক রাজ কায়েমের সংগ্রামে, কবিতা লেখার অবসর নেই। আর এই স্ব-প্রণোদিত ত্যাগের পরিসরই ভবিষ্যতে হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতা চাষের উর্বর ভূমি। তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন সারা বাংলাদেশ, দেখেছেন নানা রকমের মানুষ দেখেছেন অপরূপ বাংলার ভূমিস্বর্গ- পাখি, নদী, ফুল। কবি বলেন, ’৬৯ সালের উত্তাল দিনগুলোতে পরিচয় হয়েছিল রাজনীতির লোকেদের সঙ্গে। দু’চার পঙ্ক্তি যা এর আগে রচিত হয়েছে তা’ কাবিতা কিনা জানি না তবে পার্টির লোকদের পেলে শুনিয়ে দিতাম। সে কবিতা না বলে পদ্যই বলা ভাল। পার্টির লোকেরা মন দিয়ে শুনতেন এবং প্রশংসাও করতেন তবে বলতেন আরও কবিতা পড়ার জন্য, তারা দেশ বিদেশের কবিদের খোঁজ খবর দিতেন। এবং পরবর্তীকালে তারাই আমাকে উন্মেষ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদের সঙ্গে যুক্ত হতে বলেন। ৭৪ সালে আমি ‘উন্মেষে’ নিয়মিত যাতায়াত করতে শুরু করি এবং কবিতা চর্চার সুযোগ পাই। আসলে আমি কবি হতে চাইনি। আমি রাজনীতির সঙ্গেই যুক্ত থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পার্টির চলমান নীতি আমাকে নিষ্ক্রিয় করে দেয় এবং আমি লিখাতে মন দেই। ১৯৭৮ সালে আমার নিজ টাকায় প্রথম কাব্য ‘বিষণ্ন প্রহরে দ্বিধাহীন’ বের হয় মির্জা সুলতান রাজার পরিচালনাধীন বাংলাবাজার পুঁথিপত্র প্রকাশনী থেকে। সে টাকাটা এসেছিল আমার জীবন সঙ্গীর তিন ভরি স্বর্ণ বিক্রয় করে। তাকে লোভ দেখিয়ে। বই বিক্রি হবে, অনেক বেশি টাকা পাব এবং বেশি গহনা কিনে দিতে পারব। দেব কি বই বিক্রি হলে তো। যাও দুই এক কপি বিক্রি হয়েছে তাও বন্ধু বান্ধবদের সংগে চা খেয়ে আড্ডা দিয়ে শেষ। তারপর যখন দেখল যে এ নিয়ে আর কথা বলে লাভ নেই, তখন চুপ হয়ে গেলো। এবং পরে কেউ টেলিফোন করে কবি মতিন বৈরাগী আছেন? জিজ্ঞেস করলে তিনি আমাকে ডাকতেন ‘এই যে কবি সাব আপনাকে কেউ ডাকছেন।’ ব্যাস আমি কবি হলাম তো। অন্তত বাইরে না হোক আমার নিজের ঘরে। এই আনন্দ নিয়ে আজও লিখছি। কি হলো আর কি হচ্ছে আমি নিজেও তেমন জানি না। তবে আমার প্রতিজ্ঞা যে যা কিছু আমি করি তা জনগণের জন্য, সেই ধারাটির সঙ্গে আজও আপোষ করতে পারিনি। সে কারণে হয়ত আমি কাব্য জগতে অচ্ছুতের দলেই রয়ে গেছি। আমি বিশ্বাস করি তরুণরা আমাদের আগামী আমাদের ভরসা। একমাত্র তারাই পারে জীবন বদলাতে। আমি তাদের দিকে চেয়ে আছি... তারা আসবে।’ এখন আমরা চোখ রাখতে পারি, পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের একটি ছোট্ট কবিতার ওপর, শিরোনাম- ‘ক্রমশ জীবনের দিকে’ ‘মোহময় জীবনের সমস্ত কালভার্ট ভেঙে দিয়ে হে জীবন হে কবিতা আলোর দিকে ফিরে যাব আমরা প্রিয় হয়ে ওঠা সেই মানুষগুলোর দিকে যাঁরা প্রগতি যাঁরা সভ্যতা নতুনের দিকে যাব প্রতিবার’- আধুনিকতম গঠনের এই কবিতা প্রগতির দিক নির্দিষ্ট করে, পথের সাথীদের চিনিয়ে দেয় আর জীবনের সাথে কবিতাকে বিঁধে রাখে আগামী পথযাত্রায়। শুধুমাত্র সুন্দর প্রকাশে কবিতা এমন কথা ভাবতেই পারেন না কবি, এমন কিছু প্রকাশে দ্বিধা, পথ আগলে দাঁড়ায় তাঁর আপ্ত দর্শন, কবিতায় সামান্য তুচ্ছ বিষয়ের শৈল্পিক প্রকাশকে বাস্তবতা বিবর্জিত মনে হয়, শিল্প ও দায় এই দুই পথের সমন্বয়ে কবি কিছুটা সময় নেন। আচ্ছা দেখে নেই আরেকটি কবিতা প্রথম কাব্যগ্রন্থের, মিছিলের গান- ‘যতবার সুখ স্মৃতির কথা তুলে তুলে সাজাতে চেয়েছি আমার বাগান ততবার কারা যেন পিষ্ট করে সব ভেসে আসে প্রতিবাদী মিছিলের গান’। এ ধরনের কবিতাকে বলা হতো বিপ্লবী-আবেগের কবিতা, তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতসহ লাতিন আমেরিকার অনেক কবিরা এসব কবিতা লিখে বাম ধারার কবিদের মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তখাকথিত শিল্প-উত্তীর্ণ প্রেমের কবিতা থেকে, মতিন বৈরাগী তখনও বন্দী হয়ে ছিলেন দলগত প্রাচীর ঘেঁষা রেখায় কিন্তু তিনি ক্রমে সরে যাবেন মুক্ত বিপ্লবের অনুপম কবিতার পথে, নিত্য সরলতায় অপূর্ব চিত্রকল্পের কঠিন দর্শন নির্মাণে। নিজকে প্রসারিত করবেন নতুন ভাষা নির্মাণে, অনুপ্রাস প্রয়োগে ভাষা ব্যবহারে সচেতন হবেন, দর্শন স্থিত হবে মানবিকতা বা মানব কল্যাণে- ‘কিছুই থাকে না তবে হরিষে বিষাদ বিড়ালের দুই চোখ জ্বলে সন্ধ্যার আঁধারে জীবনের একদিকে আলোকের প্রহ্লাদ অন্যে বেদনা-অর্বুদ হাঁটতে হাঁটতে পথ খাটো হয় রূপান্তরিত প্রজ্ঞায় হেমন্তের কণ্ঠে হারানো দিন বাজে’- আরও এগিয়ে যাবেন তিনি এবং কবিতাকে গ্রহণ করবেন আত্মপরিচয়ের উৎস সন্ধানে, লিখবেন ‘অস্থিরতার দিনলিপি’ শিরোনামে অনেকগুলো কবিতা যা ধারণ করবে সময়, ভিন্ন মাত্রা ও ভিন্ন সুরে কবিতাগুলোর কেন্দ্রে বা অলিন্দ নিলয়ে আসন পাতবে মানুষের মগজের বদলে আবেগতাড়িত অতিবাস্তব উচ্ছ্বাস। তিনি তাঁর কবিতার বিষয়ে নিজের অজান্তেই প্রকাশ করবেন একটি সরল আত্মদ্বন্দ্ব অবস্থান, একদিকে কবির কবিতা সময়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলে আবার একই কবিতা- ‘বেদনার ধোয়া হৃদয়ের ছোঁয়া জয়।’ ‘আমি পর্বের ১ম’ কবিতাটি পাঠের মধ্যদিয়ে এই লেখাটি সম্প্রসারণের ইঙ্গিত রেখে আপাত ইতি টানতে চাই। আমি পর্ব ০১. আজ আমি কোথাও যাব না আজকে আমার ছুটি শুধু ভ্রমণ হাঁটতে হাঁটতে কখন যে বেরিয়ে পড়লাম একটা পথ রেখা ধরে আর তখন আমার কানের কাছে বাতাসেরা বললো: দেখ একদিন যেখানে ফসলের মাঠ ছিল আজ যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানচিত্র এলোমেলো বাড়ি ঘর ঘের দেয়াল ভূমি ঘিঞ্জির মতো ভূমিদস্যুর সাইনবোর্ড মাঝে মাঝে ঝিংগে শশার চালা কৃষক নেই, ধানচারার শিস নেই ফিংগের ওড়াউড়ি নেই কোরার ডাক নেই আর, কেবল লোভের উপস্থিতি আজ আমি হাঁটছি টিলাটা পাড় হয়ে সটিবনের ভেতর দিয়ে গজারির জঙ্গল পেরিয়ে একটা লজ্জাবতি লতা আমায় দেখে শরমে মুখ লুকালো বললো : দেখ দেখ মূর্খমানুষ আর দুটো শালিক ফুড়ৎ করে উড়লো একটা ধুতরা কাঁপালো পাতা আমি উড়ছি বনভূমির দিকে পাথি নিল না আমাকে কোথাও বসবার জায়গা নেই গাছগুলো কতল হয়েছে আর বনদস্যুরা দেহ কান্ড ভরছে ট্রাকে আমি নির্নিমিখ তাকিয়ে দেখলাম নিজেকে অগুণতি বৃক্ষলাশ হায়, কোথাও বসতে পারিনি আমি।
×