ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাওসার রহমান

কচ্ছপ আর খরগোশের গল্প

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ২০ নভেম্বর ২০২০

কচ্ছপ আর খরগোশের গল্প

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারীতে যখন প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলোর ধরাশায়ী অবস্থা, তখন বাংলাদেশের মতো একটি জনাকীর্ণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে নাস্তানাবুদ হওয়া দেশের অর্থনীতি ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বিষয় নিয়েই এখন ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়েছে, আর তা হলো মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশ আঞ্চলিক অর্থনৈতিক পরাশক্তি ভারতকে টপকে গেছে। অথচ মাত্র পাঁচ বছর আগের বাস্তবতাও ছিল ভিন্ন। সে সময় ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের তুলনায় ২৫ শতাংশ এগিয়ে ছিল। এখানে স্পষ্ট ব্যবধান গড়ে দিয়েছে দুই দেশের করোনা মোকাবেলায় নেওয়া পদক্ষেপসমূহ। ভারতকে এখন পর্যন্ত করোনা মোকাবেলায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশ তাদের তথ্যবহুল গণস্বাস্থ্য কার্যক্রম এবং ডিজিটাল অবকাঠামো ব্যবহার করে করোনাকালেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিশ^ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুতো বলেই দিয়েছেন, ‘ভারত এখন যে অবস্থানে আছে, তাতে তারা যদি চীনকে টেক্কা দিতে চায় তবে তাদের অবশ্যই আগে বাংলাদেশকে পরাজিত করতে হবে।’ এক টুইট বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘যে কোন উদীয়মান অর্থনীতি ভাল করছে, এটা সুখবর। কিন্তু এটা অবাক করে দেয়ার মতো খবর যে, ভারত এখন পিছিয়ে পড়ছে। পাঁচ বছর আগেও যাদের অর্থনীতি ২৫ শতাংশ এগিয়ে ছিল তাদের জন্য এটা মোটেও ভাল খবর নয়।’ বাংলাদেশের ভাল করার কারণ প্রসঙ্গে কৌশিক বসু বলছেন, ‘বাংলাদেশ ভাল করছে। এর কারণ হচ্ছে তারা তাদের কম দক্ষতাসম্পন্ন পণ্যের রফতানি বজায় রেখেছে। এই বিষয়টি গরিব দেশের কর্মবয়সী জনসংখ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য এগিয়ে আছে ভিয়েতনাম। কিন্তু মৌলিকভাবে, উভয়েই চীনের কাছ থেকে শিক্ষা নিচ্ছে। কম দক্ষতাসম্পন্ন পণ্যের উৎপাদনের মাধ্যমে বড় আধিপত্য বিস্তার করে, তার মাধ্যমে তারা উচ্চ জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে।’ সংবাদ এজেন্সি সিএনআইয়ের এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব দরবারে এখন নতুন অর্থনৈতিক বিস্ময় তৈরি করেছে বাংলাদেশ। ধরে নেওয়া যায়, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের পুরনো অর্থনৈতিক মিত্র ভারতকে বাদ দিয়ে, আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে আরও দৃঢ় অর্থনৈতিক সম্পর্কে সম্পর্কিত হতে যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করেই দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মহামারি করোনাকালে যেখানে বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতির দেশে কোনও প্রবৃদ্ধিই হচ্ছে না, সেখানে বাংলাদেশ ৮ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি আশা করছে। টানা তিন মাস লকডাউনের কারণে সবকিছু বন্ধ থাকার পরও গত অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশের বাড়ন্ত অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, যেভাবে তেজীভাব নিয়ে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সে তুলনায় কর্মসংস্থান বাড়ছে না। তবে করোনার প্রভাব কাটিয়ে এত দ্রুত বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। এটা সম্ভব হয়েছে সরকারের আন্তরিক সহায়তা এবং বাংলাদেশের মানুষের উদ্যাম। বাংলাদেশের এই দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলা শুরু হয়েছে গত এক দশক ধরেই। যে কারণে বিশ্বব্যাংকের হিসাবে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে ২০১৫ সালেই। জাতিসংঘের হিসাবে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের সিঁড়িতে পা দেবে ২০২৪ সালে। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সম্প্রতি তার এক রিপোর্টে বলেছে, ২০২০ সালে পঞ্জিকাবর্ষে মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আইএমএফের হিসাবে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে এক হাজার ৮৮৮ ডলার, একই সময়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে এক হাজার ৮৭৭ ডলার। আইএমএফের বরাতে মাথাপিছু জিডিপির এই হিসাব প্রকাশের পর থেকে অনেকেই বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসাও করছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রশংসা করে বিভিন্ন দেশের পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ নিবন্ধও ছাপা হচ্ছে। বিশেষ করে, ভারতের পত্র-পত্রিকাগুলো যেমন সেদেশের অর্থনীতি নিয়ে সমালোচনা করছে, তেমিন অকৃত্তিমভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিরও প্রশংসা করছে। বিশ্বে মহামারীকে জয় করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধরে রেখেছে এমন নজির আরও অনেক দেশই সৃষ্টি করবে। সেক্ষেত্রে, আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ দেশগুলোর উচিত হবে ওই দেশগুলোর কাছ থেকে শেখা- কিভাবে সবদিক ঠিক রেখে মহামারীকালেও অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়া যায়। দক্ষিণ এশিয়ার এই অর্থনৈতিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে যৌথভাবে দ্রুত ডিজিটাইজেশন এবং সামাজিক সক্ষমতা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে। যে কারণে, ক্রমেই বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্ব বাজারে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। আইএমএফ একটি রক্ষণশীল সংস্থা। সহজে কারও প্রশংসা করতে চায় না। সেই আইএমএফই তার প্রতিবেদনে বলছে, চলতি বছরে মাত্র ২২টি দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হবে। ওই ২২টি দেশের একটি বাংলাদেশ। মাথাপিছু জিডিপি হলো দেশগুলোর সমৃদ্ধি নির্ধারণের একটি বিশ্বব্যাপী পরিমাপ এবং একটি দেশের সমৃদ্ধি বিশ্লেষণে অর্থনীতিবিদরা জিডিপির পাশাপাশি মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি ব্যবহার করেন। কোন দেশের জিডিপি দেশটির মোট জনসংখ্যার হিসাব দিয়ে ভাগ করে এটি গণনা করা হয়। বাংলাদেশ এবং ভারত উভয়ের চলতি মূল্যে জিডিপির হিসাব করা হয়েছে। আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছরে সবচেয়ে বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা বিশ্বের শীর্ষ তিন দেশের একটি হবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকবে শুধু গায়ানা ও দক্ষিণ সুদান। মহামারীর মধ্যে জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশ ভারতকে টেক্কা দেওয়া কিন্তু একদিনের কোন ঘটনা নয়। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ তার উন্নয়নমুখী অর্থনীতি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তার ফলাফল হিসেবে দেশটি মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে অনেক আগেই। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে গেছে দেশটির সমাজ ব্যবস্থা। লৈঙ্গিক সমতা বিধান এবং নারীর ক্ষমতায়নে রোল মডেল হয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার মাধ্যমে দেশটির সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণকে আরও উৎসাহিত করার পথ সুগম করা হয়েছে- যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে বিরল। বাংলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাইজেশনের আওতায় আনতে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে এটুআই নামের একটি সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। প্রযুক্তিভিত্তিক ক্ষুদ্র বা মাঝারি ধরনের ব্যবসায়িক উদ্যোগ ক্রমেই দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে। শুধু তাই নয়, আউটসোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্বস্ত গন্তব্য হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। কৌশলনির্ভর কূটনীতিকে পুঁজি করে বাংলাদেশ একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক উন্নয়ন করে চলেছে, ব্রেক্সিট পরর্বতী বাস্তবতায় যুক্তরাজ্যও তাদের মিত্র জাপানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন করে ভেবে দেখছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প যুক্তরাজ্যভিত্তিক অনেক নতুন ক্রেতা পাচ্ছে। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলতে বাধ্য হচ্ছেন, বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেকটা নীতিকথার সেই কচ্ছপ আর খরগোশের গল্পের মতো- ‘সেøা বাট স্টেডি’। ধীরগতি হলেও জিডিপি বৃদ্ধিতে ভারতের চেয়ে অনেক বেশি স্থিতাবস্থা রয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যার নিবিড় আত্মীয়তা, তিনি হচ্ছেন কিংবদন্তি ভাষ্যকার ও বিবিসির সাবেক সাংবাদিক মার্ক টালি। হাজারো প্রতিকূলতা সামলে বিগত দুই দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সেটাকে তিনি ‘ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির উঠে দাঁড়ানো’র সঙ্গে তুলনা করে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বাংলাদেশ যে তার আজকের জায়গায় এসে পৌঁছেছে, এর পেছনে প্রধানত দুটো ফ্যাক্টর কাজ করেছে বলে মার্ক টালির অভিমত। আর এই দুটো জায়গাতেই তারা ভারতের চেয়ে ভিন্ন পথে হেঁটেছে। প্রথমত, দুর্বল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ একটা সময় কার্যত বাধ্য হয়েছে দাতা দেশ ও উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শ মেনে নিতে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যদিও একটা তীব্র সমাজতান্ত্রিক ধারা ছিল এবং বেসরকারীকরণকে ‘জনবিরোধী’ বলে ভাবা হতো- তারপরেও রাজনীতি দূরে সরিয়ে রেখে সে দেশের সব সরকারই আন্তর্জাতিক দাতাদের উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিয়েছে। অথচ প্রতিবেশী ভারতে কিন্তু বেসরকারীকরণ নিয়ে সব সময়ই একটা দ্বিধা কাজ করেছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের উন্নয়নে এনজিও বা বেসরকারী সংস্থাগুলোকে সব সময়ই একটা বড় ভূমিকা পালনে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, যেটা ভারতে কখনোই হয়নি। যেমন, দ্য ইকোনমিস্টের মতে, ‘বাংলাদেশের ব্র্যাক এখন বিশ্বের বৃহত্তম স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা এনজিও। তাদের কর্মসূচী বাংলাদেশকে চরম দারিদ্র্য থেকে উত্তরণে সাহায্য করেছে এবং বিশ্বের অন্তত ৪৫টি দেশের এনজিওগুলো এখন ব্র্যাকের সেই পথ অনুসরণ করছে।’ বাংলাদেশের জিডিপি বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্যিই ভারতকে টপকে যাচ্ছে কিনা, তা নিয়ে এ ভারতে বিতর্ক চলছে গত বেশ কিছু দিন ধরেই। নামী ভারতীয় অর্থনীতিবিদরা অনেকেই যেমন বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন, আবার অনেকেই মন্তব্য করেছেন, আইএমএফ যে মাপকাঠিতে এই পূর্বাভাস করেছে সেটা ঠিক নয়। বরং অন্য উপযুক্ত মাপকাঠিতে ভারতই নাকি অনেক এগিয়ে আছে! আসলে ‘পরশ্রীকাতরতা’ সব দেশেই আছে। বাংলাদেশে যেমন খুব বেশি, অন্যদেশে হয়তো কম। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে সেটিই বড় কথা। কোন দেশ পেছনে পড়ে গেল সেটা মুখ্য বিষয় নয়। এক্ষেত্রে প্রবীণ বিশ্লেষক ও ভাষ্যকার মার্ক টালি কিন্তু পরিষ্কার ভাষায় তার মত জানিয়ে দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশ যেভাবে ধ্বংসের ছাই থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, পারলে ভারতের সেটা থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত।’ বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা (দু’একজন ব্যতীত) প্রশংসা তো দূরের কথা, স্বীকারই করতে চান না যে, বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে এগিয়ে যাবে। অনেকে এর সঙ্গে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ভুটানের প্রসঙ্গ টানছেন। অথচ এই দেশগুলো শুধু আমাদের দেশই নয়, ঐতিহ্যগতভাবে ভারতের চেয়েও এগিয়ে। তাদের যে একদিন আমরা টপকাবো না তা ওই অর্থনীবিদরা কী হলফ করে বলতে পারবেন। অথচ আমাদের অর্থনীতিবিদদের উচিত ছিল আইএমএফের ভবিষ্যদ্বাণীকে মেনে নিয়ে কী করে এই উন্নতি টেকসই করা যায় এবং এই করোনাকালীন অবস্থায় সরকারের ভবিষ্যত করণীয় কী সে ব্যাপারে পরামর্শ দেয়া। আমাদের অর্থনীতিবিদরা সেই লকডাউনের সময়কার তথ্য নিয়েই আকরে ধরে আছেন। লকডাউনের সময় সব কিছু বন্ধ থাকায় মানুষের আয় কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক। এখন আবার জরিপ করলে দেখা যাবে মানুষের আয় বেড়ে গেছে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় দিনের বেলা শহরে বের হলেই। এখন আবার আগের স্বরূপেই ঢাকা ফিরেছে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলারও সময় নেই। কে কার আগে দৌড়াবে সেই প্রতিযোগিতা চলছে এখন দেশে। নিশ্চয়ই বিনা পয়সায় বা বেগার খাটার জন্য কেউ জান-প্রাণ বাজি রেখে এভাবে দৌড়াচ্ছে না। বাঙালী অত বোকা নয়। লাভ ছাড়া তারা এক পা-ও বাড়ায় না। তাহলে নিশ্চয়ই প্রাপ্তি যোগ হচ্ছে। আর বাংলাদেশের অর্থনীতি যে অল্প সময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এটাও তার প্রমাণ। রফতানি, রেমিট্যান্স, রাজস্ব আয়, ব্যাংক ঋণ সবই এখন বাড়ছে। কয়েক দিন আগে বিশ্বব্যাংকও তো জানিয়েছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়েছে এবং এ বছর রেমিট্যান্সপ্রবাহে বাংলাদেশ অষ্টম অবস্থানে থাকবে। বিশ্বব্যাংকের ধারণা অনুযায়ী, মহামারীর প্রাদুর্ভাব সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়তে থাকবে। ওয়াশিংটনভিত্তিক শীর্ষস্থানীয় সংস্থার ‘কোভিড-১৯ ক্রাইসিস থ্রু এ মাইগ্রেশন লেন্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চলতি বছর বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও ৮ শতাংশ বাড়বে। এ বছর রেমিট্যান্স প্রবাহের পরিমাণ দাঁড়াবে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহের হার প্রায় ৪ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ১৩৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থবিরতার প্রভাবে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে মূলত ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণের কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ চলছে। এগুলো নিশ্চয়ই এমনি এমনি বাড়ছে না। হয়তো মূলধন যন্ত্রপাতি ভিত্তিক আমদানি বাড়ছে না। এটি এখন বাড়তে চাওয়াটাও বোকামি। এ জন্য নতুন কর্মসংস্থান বাড়ছে না। সারা পৃথিবীই এখন কভিড-১৯ মহামারীর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। এই সময়ে বিদ্যমান উৎপাদন ধরেই রাখাই চ্যালেঞ্জের ব্যাপারে। সেখানে কী করে নতুন বিনিয়োগ আশা করা যায়? আর বিনিয়োগের প্রশ্ন এলে বলাই যায়, বড় শিল্প বা বিদেশী বিনিয়োগের অন্যতম শর্ত হলো ‘রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা’। ২০০৮ সাল থেকে ১২ বছরেরও বেশি সময় টানা প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে শেখ হাসিনা। বিরোধীরা প্রায় ছন্নছাড়া। মৌলবাদী দলগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়েও ঘুরে দাঁড়াতে কার্যত ব্যর্থই সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। অন্য দিকে, বহু জনমুখী প্রকল্প, পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক বরাদ্দ, গরিবদের জন্য নানা আয়মুখী প্রকল্প, মহিলাদের স্বনির্ভর করতে আর্থিক সাহায্য ইত্যাদির হাত ধরে উত্তরোত্তর জনভিত্তি বাড়িয়ে শক্তিশালী হয়েছে হাসিনার সরকার। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে রেডিমেড পোশাক শিল্প থেকে। শেখ হাসিনার জমানায় সেই শিল্পকে ধরে রাখা এবং নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তার বৃদ্ধির পথ আরও প্রশস্ত করা হয়েছে। তার সঙ্গেই বেড়েছে অন্যান্য শিল্পও। শিল্পের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে গড়া হয়েছে শিল্পাঞ্চল। তার মধ্যে সবচেয়ে বড়টি হলো চট্টগ্রামের অদূরের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল। সরকারীভাবে যার নাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরী’। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে পণ্য রফতানির সুবিধা, শিল্পদ্যোগীদের নানা সুবিধা, কম দামে পর্যাপ্ত শ্রমিকের জোগান, পানি, বিদ্যুত, কয়লার মতো কাঁচামালের সহজলভ্যতা, উন্নত যোগাযোগের মতো শিল্পের সহায়ক পরিবেশ থাকায় ভারত, চীন, জাপানের মতো দেশের শিল্পপতিদের অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠেছে হাজার একর জমিতে গড়ে-ওঠা মিরসরাই শিল্পনগরী। সেখানে ৩ কোটি রুপি ব্যয়ে কারখানা তৈরি করছে এশিয়ান পেইন্টস। দ্বিতীয় কারখানা তৈরি করছে বার্জার পেইন্টস। শুধু ভারতীয় শিল্পের কারখানার জন্যই সেখানে ১ হাজার একর জমি নির্দিষ্ট করে ‘ইন্ডিয়া স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ তৈরির কাজ করছে আদানি পোর্ট। সাপুরজি পালনজি, রিলায্যান্স অনিল অম্বানী গ্রুপ বাংলাদেশে তৈরি করছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর সঙ্গে চীন, জাপান, কোরিয়ার মতো দেশের বিনিয়োগ তো রয়েছেই। জাপানী কোম্পানি সুমিতোমো কর্পোরেশন আড়াই হাজারে শুধু জাপানী বিনিয়োগের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করছে। সারা বিশ্বে বিদেশী বিনিয়োগে অগ্রগণ্য চীন। চিরবৈরিতার কারণে গালওয়ানের মতো পরিস্থিতি হোক বা না হোক, চীনা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতকে সব সময়ই অনেক মেপে পা ফেলতে হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সে বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে বাংলাদেশে ঢালাও বিনিয়োগ করছেন চীনা শিল্পপতিরা। সঙ্গে জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ডের বিনিয়োগকারীরা তো রয়েছেনই। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ জুড়ে এ ধরনের ১০০টি শিল্পাঞ্চল তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে হাসিনা সরকার। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই এ সকল শিল্পাঞ্চল শুধু আলোর মুখ দেখবেই না, কোন কোন শিল্পাঞ্চল ফল দিতেও শুরু করবে। সবশেষে বলা যায়, বিশ্বের অনেক দেশই স্বপ্ন দেখছে মহামারির পর তারা আবার আগের মতো অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় শামিল হবে। তার আগে সবারই অগ্রাধিকার দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠন। সে কাজটিই বাংলাদেশ করছে। সামাজিক সূচকের অগ্রযাত্রায় দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। ফলে দ্য ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনের ভাষায় বাংলাদেশের অর্থনীতি যেহেতু মহামারীর ভেতরও ঈর্ষণীয় অবস্থানে রয়েছে, তাই, আগামী দিনের দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক নেতৃত্বে বাংলাদেশই থাকছে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না। লেখক : সাংবাদিক
×