ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যদি কানাডা আসতে চান

প্রকাশিত: ১৯:৪৯, ৭ নভেম্বর ২০২০

যদি কানাডা আসতে চান

এই প্রসঙ্গটি আমার লেখার বিষয় নয় এবং এ বিষয়ে কখনও লিখতে হবে তা ভাবিনি। কিন্তু বিভিন্ন সময় অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে কানাডা আসার ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে চায়। এভাবে সকলের ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দেয়াও যেমন দুরূহ কাজ, তেমনি অধিকাংশের পক্ষে এরকম ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ কারণেই এই বিষয়ে লিখতে চেষ্টা করা। কেননা উন্নত বিশ্বের কোন দেশে আসার জন্য প্রয়োজনীয় সকল বিষয় খুব ভালভাবে জানা থাকা প্রয়োজন। সঠিক তথ্য এবং পদ্ধতি জানা না থাকার কারণে অনেকেই যেমন উপযুক্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এখানে আসতে পারে না। আবার অনেকেই বিনা কারণে এক্ষেত্রে লাখ লাখ টাকা খরচ করছে এই কানাডা আসার পিছনে যার কোন প্রয়োজনই হয় না। কানাডা সম্পর্কে একটি বিষয় প্রথমেই জেনে রাখা ভাল যে ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠা বা তথাকথিত দাফতরিক চাকরি বা হোয়াইট কালার জব যোগাড় করার ক্ষেত্রে যে নেতিবাচক দিক বা সীমাবদ্ধতা আছে সেটি মেনে নিতে পারলে বসবাসের জন্য কানাডা যে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর একটি দেশ তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেউ যদি নিজের পেশায় ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠা করতেই হবে এমন ধারণার বশবর্তী না হয়ে যে কোন মর্যাদাসম্পন্ন চাকরি করে নিশ্চিন্তে এবং শান্তিতে থাকতে চায় তাহলে তাদের জন্য কানাডার চেয়ে ভাল কোন দেশ পৃথিবীতে আর কোথাও আছে বলে আমার মনে হয় না। এখানে মানুষের জীবনের মূল্য এবং মানুষের মূল্যবোধের স্থান সবার উপরে। মাল্টিকালচারাল বা বহুজাতিক সংস্কৃতির সর্বোচ্চ চর্চার স্থান হলো এই কানাডা। এসব কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কানাডা আসার আগ্রহ বেশি এবং এ দেশের সরকারের অভিবাসন নীতিমালাও তেমনি যথেষ্ট সহায়ক। রাজনৈতিক আশ্রয়ে বাংলাদেশীদের কানাডা থাকার সুযোগ শেষ কানাডায় সাধারণত ছাত্র হিসেবে উচ্চশিক্ষার জন্য এবং অভিবাসী এই দুইভাবে আসার সুযোগ আছে। এছাড়া রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের একটি স্বীকৃত সুযোগ কানাডায় সবসময়ই ছিল এবং এখনও আছে। তবে এভাবে আসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশীরা এখন আর সেই পর্যায়ে নেই। কোন বাংলাদেশী এখন এখানে এসে আদালতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলে তা নাকচ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই শতভাগ। সম্প্রতি কেউ কেউ ভিজিট ভিসা নিয়ে এখানে এসে এরকম সুযোগ নিতে গিয়ে আদালত কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে বলা যায় একরকম অপমানিত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এই ধরনের ঘটনা তার নিজের জন্যও অপমানজনক এবং দেশের জন্যও বিব্রতকর। কেননা এরকম অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার কারণে এখন প্রকৃত ভিজিটররাও ভিসা পেতে যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। তাই যে যাই বলুক না কেন এখন আর কোন অবস্থাতেই কারও এ পথে পা বাড়ানো মোটেই সমীচীন হবে না। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে কানাডা আসার সুযোগ ছাত্র হিসেবে এদেশে আসার একটি ভাল সম্ভাবনা আছে। পূর্বে এই সুযোগ যথেষ্ট সীমিত ছিল। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে ছাত্র হিসেবে পড়তে এসে নিজ খরচে পড়াশোনা সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে এক বছর কাজ করতে পারলে খুব সহজেই এখানকার অভিবাসন লাভ করা যায়। ফলে এই সুযোগ কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে এখন বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য কানাডা এসে থাকে। আমাদের দেশ থেকে যে সকল ছাত্রছাত্রী কানাডা উচ্চশিক্ষার জন্য আসতে চান তাদের প্রথমেই একটি বিষয় পরিষ্কার করে নিতে হবে যে তাদের আসার মূল উদ্দেশ্যটা কি ? অর্থাৎ তারা কি উচ্চশিক্ষা শেষ করে এখানে অভিবাসন নিয়ে থেকে যেতে চান, নাকি দেশে ফিরে গিয়ে নিজ দেশে অবদান রাখতে চান। যদি কানাডায় উচ্চশিক্ষার ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরে গিয়ে ভাল কিছু করার উদ্দেশ্যে এখানে আসতে চান, তাহলে তাদের যথেষ্ট ভেবেচিন্তে অগ্রসর হতে হবে। কেননা আন্তর্জাতিক ছাত্র হিসেবে এখানকার উচ্চশিক্ষার খরচ অত্যধিক। এই বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে এখানকার উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে কতটুকু লাভ হবে বা এর কতটুকুই বা প্রয়োগ করা যাবে, সেটি ভালভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে যাদের অঢেল অর্থ আছে তাদের তেমন কিছু না হলেও, যারা সীমিত সম্পদের মালিক তাদের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। পক্ষান্তরে যারা এখানে উচ্চশিক্ষা শেষ করে অভিবাসন নিয়ে থেকে যেতে চান, তারা এ পথে এগুতে পারেন। তবে এই সুযোগ ভালভাবে কাজে লাগাতে হলে তাদেরকেও যথেষ্ট পরিকল্পনা করে এগুতে হবে। এই প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য যেন হয় সবচেয়ে কম খরচে অল্পসময়ের মধ্যে কানাডায় উচ্চশিক্ষাসম্পন্ন করে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া। এই লক্ষ্য মাথায় রেখে সঠিকভাবে অগ্রসর হতে পারলে কানাডা এসে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সর্বোচ্চ সফলতা লাভ করা সম্ভব। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে পড়ার সুযোগ প্রথমেই ঠিক করতে হবে যে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে পড়তে আসা, নাকি দেশে গ্র্যাজুয়েট শেষ করে, এখানে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করার জন্য আসা। দুটো পথই এখানে খোলা আছে এবং দুটো পদ্ধতিরই অনেক ভাল এবং মন্দ দিক আছে। গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম এখানে চার বছরের কোর্স, তাই এটি যথেষ্ট ব্যয়বহুল। যেমন কমপক্ষে ত্রিশ হাজার ডলার করে বছরে খরচ হলেও সম্পূর্ণ প্রোগ্রামটি শেষ করতে প্রায় এক থেকে দের লাখ ডলার খরচ হবে যার পরিমাণ বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় এক কোটি টাকা। তাছাড়া গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে অধিক মাত্রায় স্থানীয় ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয় বিধায় আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীর কোঠার পরিমাণ অনেক কম থাকে। ফলে এই প্রোগ্রামে ভর্তি খুবই প্রতিযোগিতামূলক এবং এখানে সুযোগ পেতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। অধিকন্তু আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে স্কলারশিপ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় যে, কানাডা কাজ করে উচ্চশিক্ষার ব্যয় নির্বাহ করার সুযোগ খুবই সীমিত। গ্রীষ্মকালে সীমিত আকারে ছাত্রছাত্রীরা বৈধভাবে যা কিছু উপার্জনের সুযোগ পায় তা এতটাই অপ্রতুল যে, সেই উপার্জন দিয়ে এক সেমিস্টারের টিউশন ফি পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। এই গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে পড়তে আসার আরও একটি বড় অসুবিধা হলো, শিক্ষা শেষে অভিবাসন না পাবার অনিশ্চয়তার ঝুঁকি। কারণ এই প্রোগ্রামে পড়তে এলে একজন ছাত্র শিক্ষা শুরু করার কমপক্ষে পাঁচবছর পরে অভিবাসনের জন্য আবেদন করতে সক্ষম হবে। এই সময়ের মধ্যে অভিবাসন আইন পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। অথচ একজন ছাত্রকে এখনকার প্রচলিত আইন বিবেচনায় নিয়ে এখানে উচ্চশিক্ষার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। উল্লেখ্য, এসব উন্নত দেশে অভিবাসন আইন খুব ঘন ঘন পরিবর্তন করা হয় দেশের মানুষের জীবনমান, কর্মসংস্থান এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলো বিবেচনা করে। যেমন বিগত তিন বছর ধরে এখানে বাবা-মাকে অভিবাসন দিয়ে নিয়ে আসার নিয়ম প্রায় বছর বছরই পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে পড়তে আসার আগে এই বিষয়গুলো ভালভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নচেৎ এখানে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য এসে ভালর চেয়ে খারাপ হবার সম্ভাবনা একেবারে কম নয় এবং কেউ কেউ যে ইতোমধ্যে এমন ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি তেমন নয়। গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে পড়ার সুযোগ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের তুলনায় গ্র্যাজুয়েট বা মাস্টার্স প্রোগ্রামে পড়তে আসার সুবিধা অনেক বেশি। প্রথমত এসব দেশে স্থানীয় ছাত্রছাত্রীরা গণহারে মাস্টার্স করে না। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী গ্র্যাজুয়েট শেষ করেই যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী কাজে লেগে যায়। যারা অত্যাধিক মেধাবী এবং ভবিষ্যতে গবেষণার কাজে সম্পৃক্ত হতে চায়, শুধু তারাই মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হয়। ফলে মাস্টার্স প্রোগ্রামে আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীদের জন্য অধিক সংখ্যক আসন নির্ধারিত থাকে। এতে করে মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ অনেক বেশি থাকে। তাছাড়া মাস্টার্স প্রোগ্রামের অধ্যয়ন উৎসাহিত করার জন্য এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্রছাত্রীদের যোগ্যতা অনুযায়ী কিছু স্কলারশিপ বা আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, এই প্রোগ্রামে ভর্তি হতে পারলে পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু উপার্জনও করা যায়। কেননা এই প্রোগ্রামগুলো মূলত গবেষণাধর্মী। এসব কারণে মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের উচ্চশিক্ষার ব্যয় যথেষ্ট পরিমাণে সাশ্রয় করা সম্ভব। অধিকন্তু মাস্টার্স প্রোগ্রাম সাধারণত দুই বছরের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে যায়। এতে করে দেখা যায় যে একজন ছাত্র মাস্টার্স প্রোগ্রামে পড়তে আসার মাত্র তিন বছরের মধ্যে অভিবাসন পেয়ে যায়। অভিবাসন আইন পরিবর্তনের অনিশ্চয়তা সবসময় থাকলেও সেই ঝুঁকি পাঁচ-ছয় বছরের তুলনায় তিন বছরের ক্ষেত্রে অনেকটাই কম। এসব বিষয়গুলো ভালভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে গ্র্যাজুয়েট বা মাস্টার্স প্রোগ্রামে কানাডা পড়তে আসলে লাভের সম্ভাবনাই বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন এর পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে কানাডায় অধ্যয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করা। কানাডার ক্ষেত্রে একাজটি খুবই সহজ। কেননা এখানকার অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পড়ালেখার মান খুবই কাছাকাছি। অবশ্যই কোন কোন বিষয়ে একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে বিশেষ শুনাম এবং অবারিত গবেষণার সুযোগ। তবে আন্তর্জাতিক ছাত্রদের কানাডার বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে বৃহৎ নগরী যেমন টরনটো বা অটোয়াকে অগ্রাধিকার না দেয়াই ভাল। কেননা এগুলো কানাডার সবচেয়ে বৃহত্তম নগরী হওয়ায় এখানে সুযোগ-সুবিধা যেমন বেশি, ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাও তেমনি তীব্র। ফলে এসব বৃহৎ নগরীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ যেমন সীমিত, তেমনি এখান থেকে আর্থিক সহযোগিতা বা স্কলারশিপ পাবার সম্ভাবনাও খুবই কম। সে তুলনায় অন্যান্য নগরীতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির চাপ কম থাকায় সেখানে ভর্তি হওয়া যেমন কিছুটা সহজ, তেমনি সেখান থেকে স্কলারশিপ বা আর্থিক সহযোগিতা পাবার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। কেননা ছাত্রছাত্রীদের সে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নে উৎসাহিত করতে কর্তৃপক্ষ ছাত্রছাত্রীদের স্কলারশিপ বা আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে থাকে। লেখক : ব্যাংকার, টরেনটো, কানাডা [email protected]
×