ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মদদ জোগাচ্ছে দেশী-বিদেশী অশুভ শক্তি

নৈরাজ্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নীলনক্সা অনুযায়ী মাঠে জামায়াত

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ৫ নভেম্বর ২০২০

নৈরাজ্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নীলনক্সা অনুযায়ী মাঠে জামায়াত

শংকর কুমার দে ॥ দেশে অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পূর্বপরিকল্পিত নীলনক্সা অনুযায়ী গোপনে মাঠ পর্যায়ে তৎপরতা শুরু করেছে জামায়াত-শিবির। বড় ধরনের নাশকতা, সন্ত্রাসী কর্মকা- ও দাঙ্গা হাঙ্গামা চালানোর পরিকল্পনা করে মাঠ পর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে যুদ্ধাপরাধীর এই দলটি। এই দলটির সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রয়েছে বিএনপির একাংশ, উগ্র মৌলবাদী ও জঙ্গী গোষ্ঠীর। এই ধরনের অপতৎপরতায় মদদ যোগাচ্ছে দেশী-বিদেশী অশুভ শক্তি, বিশেষ করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের যোগাযোগ আছে-এমন তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তানী আমলের কায়দায় ধর্মের নাম ব্যাবহার করে গুজব অপপ্রচার ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার যেসব ঘটনা ঘটে গেছে তার সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের কানেকশনের বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। রংপুরের লালমনিরহাটে একজন ধর্মভীরু মুসলমানকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যার পর লাশ আগুনে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা ও কুমিল্লার মুরাদনগরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা একই যোগসূত্রে গাঁথা বলে গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা। প্রায় একই সময়ে দুইটি ঘটনাই ধর্মকে অবমাননার ভুয়া অভিযোগ তুলে ঘটানোর পেছনে কাজ করছে একই গোষ্ঠী যাতে জড়িত উগ্র মৌলবাদী ও জঙ্গী গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে বিএনপির উগ্রপন্থী একাংশের যোগাযোগ থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বরে জামায়াতের মজলিশে শূরার এক ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। জামায়াতের আমিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনাসহ নানা ধরনের ব্যার্থতা তুলে ধরার জন্য প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায় থেকে জনসংযোগ বৃদ্ধি করে প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেয়ার পর থেকে সারাদেশের কোথাও না কোথাও ঝটিকা মিছিল, কর্মী সমাবেশ করছে সংগঠনটির তৃণমূল পর্যায়ে। গত কয়েক বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গীবিরোধী লাগাতার সাঁড়াশি অভিযানের কারণে দুর্বল হয়ে পড়া নিষ্ক্রিয় জঙ্গী সংগঠনের নেটওয়ার্ক কানেকশন করার মাধ্যমে আগের মতো জঙ্গীদের চাঙ্গা করতে মরিয়া জামায়াত-শিবির। এই লক্ষ্যে জঙ্গী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জামাত নেতারা যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক কর্মকা- ও সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে সংগঠনকে শক্তিশালী করে জঙ্গী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য গোপন পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে জামায়াত-শিবির এমনটাই মনে করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, দেশব্যাপী করোনাভাইরাস মোকাবেলা, কক্সবাজারে মেজর সিনহা হত্যাকা-, দিনাজপুরে ইউএনওকে হত্যার চেষ্টা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি দুর্নীতিসহ নানা ইস্যুতেও গুজব ও অপপ্রচার ছড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সরকারের সঠিক সময়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে আগের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সফল হয়নি। তখনও মেজর সিনহা হত্যাকা-ের ঘটনায় ওসি প্রদীপ দাশকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করার ঘটনাগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর হস্তক্ষেপের ফলে স্বাধীনতা বিরোধী দলটির পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এরপর রাজধানী ঢাকায় এমপি হাজী সেলিমের পুত্র ইফরান সেলিমের হাতে নৌ-বাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ সাহেব লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করেও ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করে ওই অশুভ মহলটি। এখন আবার রংপুরের লালমনিরহাট ও কুমিল্লার মুরাদনগরে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ তুলে হত্যাকা-, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনাগুলো একই যোগসূত্রে গাঁথা বলে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা মনে করেন। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় জামায়াতের নেতাকর্মীরা সম্প্রতি দলীয় প্রচারপত্র বিলি করেছেন। দলের নেতাদের বাড়িতে চলছে নিয়মিত বৈঠক। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করছেন হোয়াটসএ্যাপ, সিগন্যাল, মেসেঞ্জার এ্যাপ এবং দেশে বসে বিশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদেশী মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে। সারা দেশে নেতাকর্মীরা মসজিদে ফজরের নামাজের আগে কিংবা এশার নামাজের পরে বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন। জেলা উপজেলা, মহানগরে সংগঠনকে শক্তিশালী করার নির্দেশ দিয়েছে যুদ্ধাপরাধীর দলটি। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, জামায়াতের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুলিশ ও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দেয়ার কৌশল নিয়ে দলীয় কর্মকা- সচল রাখতে নেতাকর্মীদের নিয়মিত বৈঠক করার জন্য স্থান হিসেবে মসজিদ, তাদের নিয়ন্ত্রিত একটি হাসপাতাল ও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিতে বলা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী দলটির মগবাজারের কেন্দ্রীয় কার্র্যালয়ের পরিবর্তে আমির ডাঃ শফিকুর রহমানের মিরপুরের বাসভবনটিকেই এখন দলীয় কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার করাসহ দলের আদেশ নির্দেশ আদান প্রদানের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জামায়াতের বৈঠকের নির্দেশ পেয়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে প্রকাশ্য মিছিল করে সংগঠনটি রাজনীতিতে তাদের সরব উপস্থিতি জানান দেয়। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক মাসে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্র থেকে উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নেতাকর্মীরা সক্রিয় হয়ে তৎপরতায় মেতে উঠেছেন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা জেলা সদরে একটি কমিউনিটি হাসপাতাল ভবনের চতুর্থ তলা উদ্বোধন উপলক্ষে হাসপাতাল মিলনায়তনে অনুষ্ঠান হয়। মূলত উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আড়ালে এটি ছিল জামায়াতের সভা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলা জামায়াতের আমির আবদুল বারী। তার বিরুদ্ধে রয়েছে নাশকতার পাঁচটি মামলা। তার স্ত্রী জাহানারা সদর উপজেলা মহিলা জামায়াতের সভানেত্রী। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে চারটি মামলা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির নুরুল হুদা। এভাবে নানা উপলক্ষ নিয়ে তারা ওই হাসপাতালে মাসে একবার সভা করেন। গত ২৮ আগস্ট পাবনার সাঁথিয়া উপজেলা সদরে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে অনলাইনে নীতিনির্ধারণী একটি বৈঠকে অংশ নেন মতিউর রহমান নিজামীর নির্বাচনী এলাকার জামায়াত নেতারা। সভায় অংশ নেন সাঁথিয়া উপজেলা জামায়াতের আমির অধ্যক্ষ আবদুস সাত্তার, সাঁথিয়া পৌর জামায়াতের আমির শফিকুল ইসলামসহ অর্ধশত নেতা। বৈঠকের শেষ পর্যায়ে পুলিশ অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মাসের শেষ পর্যন্ত রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলায় প্রচার সপ্তাহ পালন করেন উপজেলা জামায়াতের নেতাকর্মীরা। পাংশার গ্রামে গ্রামে তারা জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটি প্রকাশিত দাওয়াতপত্র বিলি করেন। বিভিন্ন হাটেও প্রচারপত্র বিলি করা হয়। প্রচারপত্র বিলি করার নেতৃত্ব দেন রাজবাড়ী জেলা জামায়াতের রুকন পেশোয়ার আর্সলান মনরো, তার চাচাত ভাই কাজী ফরহাদ জামিল রুপুসহ দলের নেতাকর্মীরা। গত ৩ অক্টোবর সকালে খোদ রাজধানীর ছনটেক মেইন রোড এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখা জামায়াতে ইসলামী। এতে সহ¯্রাধিক নেতাকর্মী অংশ নেন। বিক্ষোভে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ নেতৃত্ব দেন। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের নেতৃত্বে মিছিলটি যাত্রাবাড়ী থেকে শুরু হয়ে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে এক সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। বর্তমানে ঢাকা মহানগরের মধ্যে মিরপুরের বাইশটেকী, মিরপুরের কাজীপাড়া ও মনিপুর ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় রয়েছে জামায়াতের শক্ত অবস্থান। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মৃত্যুদ- হওয়ার পর অনেকটাই নিষ্ক্রিয় নিষ্প্রভ হয়ে যায় জামায়াতে ইসলামী নামের যুদ্ধাপরাধীর দলটি। দলীয় প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ ব্যবহার করায় উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় আরেক দফা হোঁচট খেয়ে গর্তের মধ্যে পড়ার উপক্রম হয়। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুক্তির দাবিতে সহিংস আন্দোলন করতে গিয়ে নাশকতার মামলায় জড়িয়ে যান কয়েক হাজার নেতাকর্মী। এতে প্রায় বন্ধ হয়ে যায় দলীয় কর্মকা-। এই ধরনের পরিবেশ পরিস্থিতির প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে জামায়াত-শিবির নামের স্বাধীনতা বিরোধী দলটি। জামায়াত-শিবিরের হাজার হাজার নেতা-কর্মী সন্ত্রাস, নাশকতার মামলার আসামি, গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেশে অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির পূর্বপরিকল্পিত নীলনক্সা অনুযায়ী দেশের বিভিন্নস্থানে উস্কানি দিয়ে গুজব ছড়িয়ে অপপ্রচার চালিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করাসহ বড় ধরনের নাশকতা, সন্ত্রাসী কর্মকা-, দাঙ্গা হাঙ্গামা বাঁধানোর ষড়যন্ত্র করছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি।
×