ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষিবিদ মোঃ আরিফ হোসেন খান

মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ফোলিয়ার ফিডিং প্রযুক্তি

প্রকাশিত: ১৯:০৮, ২৮ অক্টোবর ২০২০

মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ফোলিয়ার ফিডিং প্রযুক্তি

সদ্য স্বাধীন দেশ, জনসংখ্যা সাড়ে ৭.৫ কোটি, জমিও প্রচুর কিন্তু তার পরেও এদেশের মানুষকে খাওয়ার কষ্টে থাকতে হয়েছিল। কৃষিই যে এদেশের প্রাণ তা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম উপলব্ধি করে কৃষিবিদদেরকে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার মর্যাদা প্রদান করেন। তিনি চিন্তা করেন দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের কৃষিতে সম্পৃক্ত করতে না পারলে এদেশের কৃষির উন্নতি করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আজ তাঁরই সুযোগ্য কন্যা কৃষিবান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এসে বাস্তবে রূপ নিয়েছে। তবে কৃষিতে আজকের যে সাফল্য তা আগামীতে ধরে রাখাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কারণ এখন প্রতি বছর প্রায় শতকরা প্রায় ১ ভাগ হারে জমি কমছে এবং ২২ লক্ষ হারে জনসংখ্যা বদ্ধি পাচ্ছে। আমরা যদি আজকের এই সাফল্যের বিষয়ে কিছু পিছনে ফিরে তাকাই তা হলে প্রথমে কি দেখি? ১) দেশ স্বাধীন হবার পরে অধিকাংশ জমিতে স্থানীয় প্রজাতির ধান চাষ হতো এগুলোর উৎপাদনশীলতা ছিল খুবই কম । ২) দেশের অনেক জমি বছরের অধিকাংশ সময় পানিতে তলিয়ে থাকত বলে কোন আবাদ হতো না। ৩) চাষিরা নিজেদের উৎপাদিত সাধারণ মানের বীজ ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করতো যার কারণে ফসলের ফলন খুব কম হতো। ৪) সেচের ব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিলনা, সেচের জন্য বৃষ্টির উপর নির্ভর করতো। ৫) চাষাবাদ কৌশলও অনুন্নত ছিল। চাষিরা রাসায়নিক সারের ব্যবহার তেমন জানত না এবং এর ব্যবহারে তেমন আগ্রহীও ছিলনা। ৬) উৎপাদিত ফসলের একটি বড় অংশ রোগ ও পোকামাকড়ের মাধ্যমে নষ্ট হয়ে যেত। ৭) কৃষকদের কৃষি বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য দক্ষ সম্প্রসারণ কর্মীও তেমন ছিলনা। আইআর-৮ জাতের ধানের সম্প্রসারণ এ দেশের কৃষিতে প্রথম বিপ্লবের সূচনা করে। খাল খননের মাধ্যমে বিলের পানি নিষ্কাষণ এবং স্লুইস গেট নির্মাণের মাধ্যমে অনেক জমি চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ফসল আবাদে চাষিদেরকে রাসায়নিক সারের ব্যবহার শিখানো হয়। নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে ফসলের ফলনশীলতা অনেক বৃদ্ধি করা হয়। উন্নতমানের বীজের ব্যবহার এবং সেচ ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করা হয়। বালাইনাশকের ব্যবহারের মাধ্যমে চাষিদেরকে তার ফসলের সুরক্ষা দেওয়া শিখানো হয়। বছরে এক ফসলের স্থলে ৩-৪ টা ফসল ফলানোর কৌশল শিখানো হয়। এ সময়ে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির সকল কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের কৃষিকে এই অবস্থানে আনতে সক্ষম হয়েছি। সকল কিছুর বিবেচনাতে আমাদের কৃষি আজ প্রায় তুঙ্গে অবস্থান করছে। একারণে আমরা ধান উৎপাদনে বিশ্বে ৩য়, সব্জি উৎপাদনে তৃতীয়, আম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম, এবং পাট ও কঁঠাল উৎপাদনে ২য় অবস্থানে রয়েছি। তবে আগামী দিনে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য পাঁচটি বিষয় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিবে বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত। ১) আবাদি জমি কমে যাওয়া । ২) জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া। ৩) পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়া। ৪) জলবায়ু পরিবর্তন এবং ৫) ক্রমাগত অধিকহারে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল ফসল উৎপাদনের কারণে মাটির উৎপাদনশীলতা হ্রাস। ব্রি’র মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং প্রধান জনাব ড. এস কে জামান মহোদয়ের একটি তথ্য থেকে জানা যায় ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আমাদের দেশের মাটির মোট নাইট্রোজেনের পরিমান কমেছে ৩১%, মোট কার্বন কমেছে ১১% এবং গ্রহণযোগ্য ফসফেট কমেছে ৯%। সুতরাং পরবর্তী ২৩ বছরে এ তথ্য যে আরও উদ্বেগজনক হবে তা বলাই বাহুল্য। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা সম্প্রতিক সময়ে Save and Grow নামক একটি কর্মসূচি চালু করেছে যার মূল উদ্দেশ্য হলো সর্বাধিক কম উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে কিভাবে বেশী ফসল ফলানো যায়। তারা অনুধাবন করতে পেরেছে যে, ৬০ এর দশকের সবুজ বিপ্লবের সূচনার মাধ্যমে বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষ অনাহারের কবল থেকে রক্ষা পেলেও অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে অধিক হারে রাসায়নিক সার, কীটনাশকের ব্যবহার এবং ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে মাটি, পানি এবং পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এজন্য FAO এমন একটি কর্মসূচি গুরুত্বের সাথে বাস্তবায়ন করছে। আমাদের দেশে এসময়ে উচ্চফলনশীল বিভিন্ন ফসল চাষের নিবিড়তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে প্রতিনিয়ত মাটির নিজস্ব উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। আর মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহারের মাধ্যমে মাটির ক্ষতি বছর বছর বৃদ্ধি পাছে। প্রকৃতপক্ষে, দেশের মাটির স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলেই সচেতন এবং কিভাবে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করা যায় সে বিষয়ে চিন্তিত। যার ফলশ্রুতিতে ডিএই’র মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় মাটিতে জৈব পদার্থ বৃদ্ধি প্রয়াশ চালানো হচ্ছে। এ অবস্থাতে অধিক খাদ্য উৎপাদন করতে হলে ট্রাডিশনাল কৃষির পরিবর্তে প্রযুক্তির সম্প্রসারণ অতি জরুরী বলে মনে করি। আগামীর কৃষির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাতে উন্নত বিশ্বে বহুল ফোলিয়ার ফিডিং প্রযুক্তিটি এক্ষেত্রে আমাদের দেশের জন্য সহায়ক হতে পারে। এছাড়া দেশের সামগ্রীক খাদ্যোপাদন বৃদ্ধি ও পুষ্টি সম্বৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে (Monimul Haque Robin et al., 2015)| প্রথমেই দেখা যাক ফোলিয়ার ফিডিং (Foliar feeding) প্রযুক্তিটি কি? আমারা মুখ দিয়েই আমাদের খাদ্য গ্রহণ করে থাকি কিন্তু কখনও যদি বেশী মাত্রায় অসুস্থ হয়ে যাই তবে আমাদেরকে ভেইনের মাধ্যমে পুষ্টি প্রদান করে (স্যালাইনের মাধ্যমে) সুস্থ করা হয়। গাছ সাধারণ ভাবে শিকড়ের মাধ্যমে তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে কিন্তু যদি কোন কারণে যদি শিকড়ের মাধ্যমে পুষ্টি উত্তোলনে অসুবিধার সন্মুখীন হয় (সাময়িক খরা, জলাবদ্ধতা, পিএইচ জনিত সমস্যা, নি¤œতাপমাত্রা ইত্যাদি) তবে গাছকে পাতার মাধ্যমে পুুষ্টি দিয়ে বেশ ভালো ভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়। গাছকে পাতার মাধ্যমে খাদ্য বা পুষ্টি প্রদানের এই বিষয়টিকেই Foliar feeding/Foliar fertilization/Foliar fertigation বলে। প্রকৃতপক্ষে শুধু পাতা নয় মাটির উপরের যে কোন অংশ দিয়েই গাছ পুষ্টি উপাদানসমূহ গ্রহণ করতে পারে। এ বিষয়টিকে Non root absorbtion ও বলে। যতদুর জানা যায় ফসল উৎপাদনের এই প্রযুক্তির প্রথম প্রয়োগ হয় ১৮৪৪ সালে আমেরিকাতে। তবে এটা যে বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য পদ্ধতি তা প্রমাণ হয় ১৯৫০ সালে। আমেরিকার মিসিগান স্টেট ইউনিভারসিটির উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের বিজ্ঞানী Dr. H. B. Tukey এবং S.H. WITTWER বিষয়টি সর্বপ্রথম সুনিদিষ্টভাবে প্রমাণ করেন যে ফসলে পুষ্টি প্রদানের ক্ষেত্রে এই ফোলিয়ার ফিডিং একটি অতিমাত্রায় কার্যকর পদ্ধতি। Dr. H. B. Tukeyএর ফোলিয়ার ফিডিং বিষয়ের প্রথম পাবলিকেশন (EARLY EXPERIMENTAL DEVELOPMENT OF FOLIAR FEEDING এর কনক্লুশন নিম্নাক্তভাবে উপস্থাপিত হয় ঃ- We have seen that materials are absorbed by the plant and move rather freely in the plant. The amounts may at first seem relatively small, but to offset this handicap, the efficiency rate is high! In fact, this is the most efficient method of applying fertilizer to plants that we have yet discovered. If we apply these materials to the leaves in soluble forms, as much as 95% of what is applied may be used by the plant. If we apply a similar amount to the soil, we find that only about 10% of it is used. This is a very dramatic finding!” চাকুরীর সূচনালগ্ন থেকে শখের বসে গাছকে পাতার মাধ্যমে পুষ্টি প্রদান বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমি দেখেছি যে, আমরা যদি ফসল উৎপাদনের সময় অতিরিক্ত পরিপূরক হিসাবে কিছু পুষ্টি উপাদান (ম্যাক্রো এবং মাইক্রো) পাতার মাধ্যমে প্রদান করি তবে তা ফসলের ফলন অনেক বৃদ্ধি করছে। পাতার মাধ্য অতিরিক্ত পরিপূরক হিসাবে পুষ্টি প্রদান করে ধান ও গমের ক্ষেত্রে ১০-১৫% এবং সব্জীর ক্ষেত্রে ২০-৫০% এর মধ্যে ফসলের ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব বলে মাঠের গবেষণাতে প্রমাণ পাই। আরও উল্লেখ্য যে, দীর্ঘ ১৬ বছরের গবেষণার মাধ্যমে দেশের প্রেক্ষাপ টে প্রথম একটি মিশ্র তরল সার “ম্যাজিক গ্রোথ” উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছি। এই মিশ্র তরল সারের মধ্যে সকল ম্যাক্রো ও মাইক্রো পুষ্টি উপাদান এবং কিছু বেনিফিসিয়ারী উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটাতে সক্ষম হই। ম্যাজিক গ্রোথের কৌশলগত ব্যবহারের মাধ্যমে ফসল ভেদে ২০-২৫% ইউরিয়া সারের সাশ্রয় করেও ভালোভাবে ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয়,শীত মৌসুমে বোরো ধানের চারার কোল্ড ইনজুরী অনেকাংশে রোধ করা যায়, তীব্র শীতের সময় পানের পাতা ঝরা রোগ ৬০-৭০% পর্যন্ত কমিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়, অম্লীয় বা লবণাক্ত এলাকার মাটিতে সহজেই অধিক ফসল ফলানো যায়। এছাড়া গম বীজ ফাটিলাইজেশন/ প্রাইমিং করে ও পাতার মাধ্যমে ম্যাজিক গ্রোথ প্রদান করে গমের ফলন ১৫-২০% পর্যন্ত বৃদ্ধি করা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়। এখন প্রশ্ন হতে পারে পাতার মাধ্যমে পুষ্টি প্রদান করলে কেন ফসলের ফলন বৃদ্ধি পাবে? উচ্চ ফলনশীল বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদের সময় আমরা আজকাল আর জমিতে সেভাবে জৈব পদার্থ প্রদান করি না। এজন্য মাটিতে অনুখাদ্যের ব্যাপকভাবে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। আমরা যে সকল অনুখাদ্য ব্যবহার করছি তার অধিকাংশই ভেজালে ভরা যা এসআরডিআই’র রির্পোট থেকে জানা যায় । এসকল অনুখাদ্য খুব কম পরিমাণে প্রয়োজন হলেও এগুলোর গুরুত্ব ফসল উৎপাদনে খুবই বেশী। যেমন, কোন জমিতে দস্তার ঘাটতি থাকলে সে জমিতে ধান গাছ প্রতিষ্ঠিত করা যায়না, বোরণের ঘাটতি থাকলে গম এবং ভূট্টার পরাগায়নে সমস্যা হয়। বিভিন্ন ফল জাতীয় সবজির ফলন অনেক কমে যায়। অম্লধর্মী মাটিতে ফসফরাস মৌলটি আয়রন এবং এলুমিনিয়ামের সাথে বিক্রিয়া করে ফসফেটের কমপ্লেক্স তৈরী করে বলে গাছ সঠিকভাবে ফসফেট পায় না ফলে গাছে ফুল ফল কমে যায়। কীটনাশকের অধিক ব্যবহার এবং জৈব সার ব্যবহার না করে কেবল রাসায়নিক রাসায়নিক সারের ব্যবহারের মাধ্যমে ফসল চাষ করতে গিয়ে আমাদের জমিতে উপকারী অনুজীব এবং কেঁচো আশংকাজনক ভাবে কমে গেছে। অনুজীবের অভাবে ব্যবহৃত ইউরিয়া পূর্ণমাত্রায় গাছের জন্য গ্রহণোপযোগী হতে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। জলাবদ্ধ বা সাময়িক ক্ষরার সময় ধানের জমিতে সময়মত নাইট্রোজেন না দিতে পারলে ফলন অনেক কমে যায়। আবার লবণাক্ত মাটিতে ইউরিয়েজ এনজাইমের কার্যকারিতা কম থাকার কারণে প্রয়োগকৃত ইউরিয়া হাইড্রোলাইসি হয়ে এমোনিয়াম আয়ন তৈরী করতে অসুবিধার সন্মুখীন হয়। এছাড়া ফসফেট এবং পটাশ কম গ্রহণ করতে পারে। আবার কপার, আয়রন, জিঙ্ক এবং ম্যাঙ্গানিজ অনুপুষ্টি উপাদান গুলিও গাছ সহজে গ্রহণ করতে পারে না বলে ভালো ফলন পাওয়া যায় না। পাতার মাধ্যমে খাদ্য প্রদান সংক্রান্ত ফোলিয়ার ফিডিং কৌশলের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমে এ ধরণের সমস্যা অনেকাংশে সমাধান করা যায় এবং অধিক ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয়। এই প্রযুক্তি ব্যবহারে উন্নত বিশ্বে ইলেকট্রোস্ট্যাটিক বুম স্প্রেয়ার, বিমান, হেলিকপ্টার এমন কি ড্রোন পর্যন্ত ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের দেশে এ সময়ে যে সকল আদানীকৃত বিদেশী ফল পাওয়া যায় তার ১০০% পাতার মাধ্যমে পুষ্টি প্রদান কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন করা হয়ে থাকে। ধানের ফলন বৃদ্ধিতে ফোলিয়ার ফিডিং প্রযুক্তির গুরুত্ব: বর্তমান সময়ে আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধানের জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছি। কিন্তু নতুন নতুন জাতগুলি সেভাবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে চাষি পর্যায়ে জনপ্রিয়তা করতে পারা যাচ্ছে না। যেমন চলতি ২০২০-২১ বোরো মৌসুমে বিএডিসি থেকে জনপ্রিয় উচ্চফলনশীল জাত ব্রিধান২৮ এবং ব্রিধান২৯ এর বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে প্রায় ৫১০০০ মেঃ টন কিন্তু এই দুইটি জাতের ধানের চাইতে অধিক ফলনশীল, ব্রিধান২৮ এর বিকল্প জাত ব্রিধান৮১, ব্রিধান ৮৪, ব্রিধান,৮৬ ব্রিধান, ৮৮ এবং ব্রিধান ৯৬ এবং ব্রিধান ২৯ এর বিকল্প ব্রিধান৮৯ এবং ব্রিধান৯২ এর বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ১০১৪ মেট্রিক টন। এর সাথে হয়তো সরাসরি ব্রি থেকে এবং ডিএই’র মাধ্যমে চাষি পর্যায়ে বীজ উৎপাদন সংরক্ষণ এবং বিতরণ প্রকল্পের কিছু বীজ থাকতে পারে। সুতরাং জাতের পাশাপাশি ধান উৎপাদনের নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ধানের উৎপাদনশীলতা যদি বৃদ্ধি করা যায় তবে তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিৎ। গবেষণাতে আজ প্রমাণিত যে পাতার মাধ্যমে পুষ্টি প্রদান করে ১০-১৫% এর মধ্যে ধানের ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব(A.H.M.M Pramanik et al.,2015, Alam Md. Zahanggir et al.,2015, Monira, S. et al.,2017)। পৃথিবীর অনেক ধান উৎপাদনকারী দেশ ফোলিয়ার ফিডিং কৌশলের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমে ধানের ফলন বৃদ্ধি করছে। ব্রি’র এগ্রোনমি বিভাগের দীর্ঘ তিন বছরের গবেষণাতে প্রমাণিত হয়েছে যে পাতার মাধ্যমে পুষ্টি প্রদান কার্যকর বিকল্প পদ্ধতি (Akhand M.I.M. et al., 2013)। বর্তমান সময়ে ব্যাকটেরিয়াল লিফ ব্লাইট (BLB) রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিদিষ্ট ঘনত্বে পটাশিয়াম (০.৬% ঘনত্বে) এবং সালফার (০.৬% ঘনত্বে) মৌলকে একত্রে স্প্রে করে পাতার মাধ্যমে প্রদানের জন্য ব্রি থেকেও সুপারিশ করা হচ্ছে যা রোগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মিশ্র তরল সারের কার্যকারিতার বিষয়টিকেই প্রমাণ করে। গত ২০১৯-২০ রোরো মৌসুমে কেজিএফ এর নির্দেশনাতে শের-এ-বাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. অলক কুমার পাল মহোদয়ের সরাসরি সম্পৃক্ততায় গবেষণাতেও প্রমাণিত হয়েছে যে, পাতার মাধ্যমে পুষ্টি প্রদানের কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে মাটিতে ৩০% এবং সামগ্রীকভাবে ১৫% ইউরিয়া সাশ্রয় করেও প্রায় ১১% (হেক্টরে ৬৪৬ কেজি) ধানের ফলন বৃদ্ধি সম্ভব। এ গবেষণাতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের সিনিয়র প্রফেসর এবং বিএডিসি’র টেবুনিয়া বীজ উৎপাদন খামারের উপপরিচালক (খামার) সম্পৃক্ত ছিলেন। এছাড়া বিএডিসি’র গবেষণা সেলের আওতায় টেবুনিয়া বীজ উৎপাদন খামারের গবেষণাতেও প্রায় একই ধরণের ফলাফল পাওয়া গেছে। এছাড়া ২০১২-১৩ সালে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ডিএই’র শতশত প্রদর্শনীর পরীক্ষাতে বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। তা হলে আমরা যদি আমাদের দেশের কৃষিতে ধান চাষে অতিরিক্ত পরিপূরক খাদ্য হিসাবে মিশ্র তরল সার প্রয়োগের বিষয়ে সুপারিশ করার চিন্তা করি তাহলে এখনই সকল জাতের ধানের ফলন ১০-১৫% বৃদ্ধি করা সম্ভব, ফলে মাঠ পর্যায়ে ধানের ফলন পার্থক্য (Yield gap) কমে আসবে। চওড়া পাতা বিশিষ্ট সব্জির উৎপাদন, চা এবং পাটের আঁশের ফলন বৃদ্ধিতেও এই প্রযুক্তি যথেষ্ট কার্যকর বলে গবেষণাতে প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কৃষির অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাতে যেমন তীব্র শীত, সাময়িক খরা এবং সাময়িক জলাবদ্ধতা, মাটির অম্লত্ব/লবণাক্ততা/ ক্ষরত্বের সময় এই প্রযুক্তিটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। এজন্য ফসল উৎপাদনে পাতার মাধ্যমে পুষ্টি প্রদানের (Foliar Feeding) বিষয়টি নিয়ে দেশের সকল গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নিবিড়ভাবে গবেষণা করা উচিত বলে মনে করি। ছাদ বাগানের গাছের সুরক্ষার জন্য পাতার মাধ্যমে পুষ্টি প্রদানের বিকল্প নেইঃ বর্তমান সময়ে যে হারে জমি কমছে এবং জনসংখ্যা বাড়ছে তাতে করে ভবিষ্যতে এই অতিরিক্ত জনসংখ্যার খাদ্যের যোগান কিভাবে আসবে তা নীতিনির্ধারকসহ সকলের চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে সুনিয়ন্ত্রিত এবং পরিকল্পিত ছাদ বাগান আমাদেরকে অনেক সহায়তা করতে পারে। এজন্যই বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার ছাদ বাগানকে উৎসাহিত করছেন এবং ছাদে সব্জি এবং ফল চাষের বিষয়টিকে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে জনপ্রিয় করা হচ্ছে। ঢাকা শহরে ছাদ বাগান করলে হোল্ডিং ট্যাক্স কমানোর ঘোষণা দেশের মানুষকে ছাদ বাগান করতে বেশ উৎসাহি করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও ছাদ বাগান করার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। একারণে দেশের মানুষের মাঝে ছাদ বাগান করার বিষয়টি এ সময়ে একটি ক্রেজে পরিণত হয়েছে। অনেক নতুন বাগানী ব্যাপক উৎসাহে ছাদ বাগান করতে আগ্রহী হচ্ছেন কিন্তু তারা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গাছের পুষ্টির বিষয়টি নিয়ে সমস্যাতে পড়ছেন কারণ ছাদের গাছের গোড়াতে খুব কম মাটি থাকে একারণে পুষ্টিও খুব কম থাকে। ছাদ বাগানে অধিক রাসায়নিক সারের ব্যবহার মাটিকে বিষাক্ত করে দেয়। একরণে পাতার মাধ্যমে নিয়মিত পুষ্টি প্রদান ছাদের গাছের পুষ্টি সমস্যাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ছাদ বাগানের বিভিন্ন ফসল চাষে মিশ্র তরল সারের ব্যবহার দেশে একটি বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে পারে। শেষকথাঃ করোনা মহামারীর কারণে দেশের কৃষির জন্য যে অশনি সংকেত দেখা যাচ্ছে তাতে মিশ্র তরল সারের সুসংহত ব্যবহার আমাদের কৃষিকে আরও এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে বলে মনে করি। উন্নত বিশ্বের গবেষণা লব্ধ তথ্য থেকে আরও জানা যায় যে, ফোলিয়ার ফিডিং কৌশলের সুসংহত প্রয়োগের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনে কিছু পরিমাণ নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশ সারের ব্যবহার কমানো সম্ভব। সুতরাং প্রযুক্তিটি আমদের মাটি স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ সুরক্ষাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশে এই প্রযুক্তি সম্প্রসারণের জন্য প্রথমেই যা প্রয়োজন তা হলো আইনগত ও নীতিমালাগত সমস্যা সমাধানপূর্বক পূর্বের ন্যায় দেশে মিশ্র তরল সারের ব্যবহার চালু করা। উল্লেখ্য ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশে মিশ্র তরল সারের ব্যবহার চালু ছিল কিন্তু ২০১৩ সালে ভেজালের আশংকাতে তা আমদানী নিষিদ্ধের মাধ্যমে বন্ধ রয়েছে। দেশের কৃষি এবং আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধির স্বার্থে পাতার মাধ্যমে পুষ্টি প্রদান তথা মিশ্র তরল সার ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে দেশের সম্মানিত সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারক এবং গবেষকগণ ভাববেন এটা প্রত্যাশা রইল। কারণ আমরা প্রায়শই দেখছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মহোদয় বিভিন্ন সেমিনার বা ওয়ার্কসপে কৃষিতে নতুন নতুন প্রযুক্তি সম্প্রসারণের বিষয়ে বলছেন। যেহেতু বর্তমান সময়ে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মহোদয় একজন কৃষিবিদ ও কৃষি বিজ্ঞানী এজন্য আশাকরি তিনি উন্নত বিশে^র মত আমাদের দেশেও ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে মিশ্র তরল সারের ব্যবহার বিষয়ে যথাযথ দিক নির্দেশনা প্রদান করবেন। আরও আশাকরি কৃষিবিদ কৃষি সচিব মহোদয়ও এবিষয়ে যথাযথ হস্তক্ষেপ করবেন। লেখক: বিএডিসির অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (বীজ বিতরণ) এবং বিএডিসির গবেষণা সেলের সদস্য
×