ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঝুলন্ত তারের জঞ্জাল নিয়ে জটিলতা কাটছে না

প্রকাশিত: ২৩:১১, ২১ অক্টোবর ২০২০

ঝুলন্ত তারের জঞ্জাল নিয়ে জটিলতা কাটছে না

ফিরোজ মান্না ॥ রাস্তায় ঝুলন্ত তারের জঞ্জাল সরানো নিয়ে জটিলতা বেড়েই চলেছে। আইএসপিবি, কোয়াব ও এনটিটিএন এখন মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। এনটিটিএনগুলো আগেই আপত্তি তুলেছে মাটির নিচে নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ একমাত্র তারাই করতে পারে। বিটিআরসি এনটিটিএন লাইসেন্স দেয়ার সময় এমন শর্তই দিয়েছে। আইএসপিবি ও কোয়াব বলছে, তারা ‘লাস্ট মাইল’ অর্থাৎ বাড়ি পর্যন্ত তারা মাটির নিচ দিয়ে তার প্রতিস্থাপন করতে পারে। এটা তাদের লাইসেন্সেও উল্লেখ আছে। পাল্টাপাল্টি এমন বক্তব্যের কারণে বিটিআরসি এখন পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত দেয়নি। বিষয়টি নিয়ে বিটিআরসি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করবে বলে জানিয়েছে। বিটিআরসি বলছে, তিনটি লাইসেন্স তিন ধরনের। একেকটি লাইসেন্সের কাজ একেক রকম। আইএসপি বিবাড়ি পর্র্যন্ত ইন্টারনেট সার্ভিস পৌঁছে দেবে। কোয়াব বাড়ি পর্যন্ত ডিস লাইন দেবে। নেশনওয়াইড টেলিযোগাযোগ ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক তৈরি করবে এনটিটিএল লাইসেন্সের তিন রকম ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। এনটিটিএন লাইসেন্স ফি তিন কোটি টাকা। আইএসপি ও কোয়াবের লাইসেন্স ক্যাটাগরি অনুযায়ী ৫০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা। আইএসপি ও কোয়াব এনটিটিএন’র কাছ থেকে সার্ভিস নেয়ার কথা। এখন আইএসপি ও কোয়াব মাটির নিচ দিয়ে ক্যাবল স্থাপন করার জন্য আবেদন জানিয়েছে। এটা আইন সঙ্গত না। তারা যদি এনটিটিএন লাইসেন্স চান সে বিষয়টি ভিন্ন। আইএসপি ও কোয়াব তো মাটির নিচ দিয়ে তার নিতে পারবে না। এটা একটা নীতিমালার মধ্য দিয়ে আসতে হবে। টেলিযোগাযোগ নীতিমালা অনুযায়ী কাজটি করার দায়িত্ব এনটিটিএনগুলোর। বর্তমানে দেশে ফাইবার এ্যাট হোম, সামিট কমিউনিকেশন, বাহন লিমিটেড, বিটিসিএল, রেলওয়ে ও পিজিসিবি নামের ৬টি এনটিটিএন কোম্পানির। উভয় পক্ষের এমন মুখোমুখি অবস্থানের কারণে বিটিআরসি কোন সিদ্ধান্ত দেয়নি। বিষয়টি নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জনকণ্ঠকে বলেন, আইএসপিদের ধর্মঘট বন্ধ করার দায়িত্ব পালন করেছি। আমি মেয়রের সঙ্গে কথা বলে কাজটি করেছি। দক্ষিণের মেয়র কথা রেখেছেন। তিনি আইএসপি ও কোয়াবের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিটিং করেছেন। আইএসপি ও কোয়াব সেখানে নবেম্বরের মধ্যে মাটির নিচে তার প্রতিষ্ঠানের অঙ্গীকার করেছে। আমি টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী হিসাবে চাইব না কোথাও ইন্টারনেটবিহীন থাকুক। আমার কথা স্পষ্ট তার ওপরে থাকুক আর নিচেই থাকুক ইন্টারনেট সার্ভিস মানুষকে দিতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী আইএসপি ও কোয়াব মাটির নিচ দিয়ে তার প্রতিস্থাপন করতে পারে না। তারা লাস্ট মাইল কানেক্টিভিটি স্থাপন করতে পারে। কিন্তু এনটিটিএন লাস্ট মাইল পর্যন্ত যেতে না পারায় এখন এ ধরনের কথা উঠেছে। আর লাইসেন্স দেয়ার মালিক হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিটিআরসি। বিটিআরসির সঙ্গে উভয় পক্ষই যোগাযোগ করেছে। কিন্তু বিটিআরসি এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে এখন পর্যন্ত কোন কিছু অবহিত করেনি। মন্ত্রী বলেন, যে কোন মূল্যে ইন্টারনেট ও ডিস লাইন চালু রাখার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। ব্যাংক লেনদেন ঠিক রাখতেই হবে। ব্যাংকার এ্যাসোসিয়েশন এসেছিল আমার কাছে। তারা অনুরোধ জানিয়েছে, ইন্টারনেট বাধাগ্রস্ত হলে ব্যাংক চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যাংকের বিষয়সহ ছাত্রছাত্রীদের অনলাইন ক্লাস, বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য চরমভাবে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে আইএসপি ও কোয়াবের ধর্মঘট স্থগিত করা হয়েছে। তারপর তার কাটা হোক। ঢাকা উত্তরের মেয়রের সঙ্গে কথা বলেছি। আইএসপিরা উত্তরের মেয়রের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বিষয়টি বুঝেছেন। এখন তারা দক্ষিণের মেয়েরের সঙ্গে কথা বলেছেন। একটা না একটা সমাধান হবেই। ইন্টারনেট সুবিধা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। ইন্টারনেট সবার জন্য সমান অধিকার। আইএসপিএবির সভাপতি আমিনুল হাকিম জনকণ্ঠকে বলেন, দক্ষিণের মেয়রের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। মঙ্গলবার বিটিআরসিতে মাটির নিচে তার প্রতিস্থাপন এবং সিটি করোপরেশনের রাস্তা কাটার অনুমতি চেয়ে আবেদন জমা দিয়েছি। আমরা যাতে ব্যবসা না করতে পারি সেজন্য এনটিটিএন বিরোধিতায় নেমেছে। তারাই সব ব্যবসা করবে। তারা ইতোমধ্যে আইএসপি লাইসেন্স নিয়ে নিয়েছে। আমরা ঝুলন্ত তার নামিয়ে মাটির নিচে নেয়ার জন্য কথা দিয়েছি। অল্প দিনের মধ্যে মাটির নিচ দিয়ে সংযোগের কাজ শুরু করা হবে। আশা করি, নবেম্বরের মধ্যেই আমরা এই কাজ শেষ করতে পারব। এর আগে ঝুলন্ত তার অপসারণের প্রতিবাদে রবিবার থেকে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার কর্মসূচী ঘোষণা করেছিল আইএসপিএবি এবং কোয়াব। নীতিমালা অনুযায়ী মাটির নিচ দিয়ে লাইন নেয়ায় আমাদের কোন বাধা নেই। আমরা লাস্ট মাইল অর্থাৎ বাড়ি পর্যন্ত ইন্টারনেট পৌঁছে দেব। সেজন্য এক শ’ থেকে ২ শ’ মিটার পর্যন্ত মাটি খুঁড়ে লাইন নিতে পারি। এটাই এনটিটিএনের সহ্য হচ্ছে না। তারা সবটাই খেতে চায়। বিটিআরসির কাছে বিষয়টি নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করব। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ফাইবার এ্যাট হোমের হেড অব পিআর এ্যান্ড গবর্মেন্টস এ্যাফেয়ারস আব্বাস ফারুক জনকণ্ঠকে বলেন, এনটিটিএন অপারেটররা কোভিড-১৯ কালীন সময়ে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃণমূলের সঙ্গে যে ভিডিও কনফারেন্সিং করেছেন তা এনটিটিএন অপারেটরদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেই করেছেন। তাছাড়া দেশের মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী বিভিন্ন ধরনের অনলাইন মিটিং এনটিটিএন অপারেটরদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই করছেন। সারাদেশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ক্লাস করেছে তাও এনটিটিএন অপারেটরদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। এছাড়া বেসরকারী অফিস, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকসহ অন্যান্য খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোও বিভিন্নভাবে করোনাকালীন সময়েও এএনটিটিএন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক চাকা গতিশীল রাখতে কাজ করে যাচ্ছে। ইনফো-সরকার ৩ প্রকল্পের মাধ্যমে এনটিটিএন অপারেটররা ইউনিয়ন পর্যন্ত তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তার করেছে, যার ফলে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলেও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বন্যায় যখন দেশের অনেকস্থান প্লাবিত, তখন এনটিটিএন অপারেটরের কর্মীরা নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে অনেক ক্ষেত্রে গলা পানিতে নেমে নেটওয়ার্ক সচল রাখতে নিরলস পরিশ্রম করেছে। এমনকি মহামারী করোনার সময়েও মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক সচল রাখার কাজ করেছে। আমি মনে করি, এনটিটিএন অপারেটরদের কাজ যতটা ব্যবসার স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত, তার চেয়ে অধিক পরিমাণ দেশপ্রেম এবং দেশের সমৃিদ্ধর সঙ্গে সম্পর্কিত। যা দেশের জিডিপিতে সরাসরি প্রতিফলিত হচ্ছে। সামিট কমিউনিকেশন্স লিমিটেড ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আরিফ আল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, সামিট কমিউনিকেশন্স লিমিটেড, প্রাইভেট এনটিটিএন অপারেটর হিসেবে ঢাকা সিটিতে ১২শ’ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল এবং পুরো দেশে ৪৭ হাজার কিলোমিটার ক্যাবল স্থাপন করেছে। সামিট কমিউনিকেশন্স লিমিটেড ঢাকা শহরে বিল্ডিং কানেক্টিভিটি করতে সক্ষম, একটি নির্দিষ্ট সময় এবং সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা তৈরির মাধ্যমে প্রাইভেট এনটিটিএন হিসেবে ঢাকা সিটির প্রতিটি বিল্ডিংয়ে বিল্ডিং কানেক্টিভিটি স্থাপন করতে আমরা প্রস্তুত আছি, তবে এটি একটি সময় সাপেক্ষ বিষয়। আব্বাস ফারুক আরও বলেন, এনটিটিএন (নেশন ওয়াইড টেলিযোগাযোগ ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক) লাইসেন্স আমরা নিয়েছি ২০০৯ সালের ৭ জানুয়ারি। দীর্ঘ ১১ বছর চলে গেছে। এই ১১ বছরে আমরা সারাদেশে ৫০ হাজার কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক তৈরি করেছি। দেশের ৮টি বিভাগ, ৬৪টি জেলা, ৪৯১টি উপজেলা এবং ৩০৫০টি ইউনিয়নে আমাদের নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। আমরা সরকারের ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছি। কারণ আমাদের তৈরি করা অবকাঠামোর ফলেই শহর ও গ্রামের মধ্যে দূরত্ব হ্রাস পেয়েছে। এই ১১ বছরে আমরা হাজার কোটি টাকা খরচ করে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছি। আমাদের দেয়া এনটিটিএন গাইডলাইনের বাধ্যবাধকতা পূরণ করেছি এবং এই জন্য সরকারকে দেয়া ১০ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি আমরা ফেরত পেয়েছি। শুধুমাত্র এনটিটিএন‘র কারণে ব্যান্ডউইথের মূল্য কোন কোন ক্ষেত্রে ৯৮ ভাগ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু কাস্টমার বলছে, আমরা মূল্য বেশি চাই। আমাদের কাস্টমারের অভিযোগটির সমাধান করতে পারে একমাত্র বিটিআরসি, কারণ বিটিআরসি ট্যারিফ ঠিক করে। এই ১১ বছরে বিটিআরসি আমাদের কোন যৌক্তিক ফ্লোর প্রাইস ঠিক করে দিতে পারে নাই। যার ফলে, অনেক অপারেটর অবৈধভাবে নিজেরাই ট্রান্সমিশন ব্যবসা করছে। যা সম্পূণরূপে বেআইনী। আমরা চাই, বিটিআরসি শীঘ্রই আমাদের একটি যৌক্তিক মূল্য ঠিক করে দিবে, ফলে আমাদের ও কাস্টমারের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে।
×