ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্যোগে ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত

প্রকাশিত: ২১:০২, ৭ অক্টোবর ২০২০

দুর্যোগে ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ তৃতীয় দফা বন্যা দুর্যোগে ধর্মীয় সম্প্রতি ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায়। ঘরে ঘরে যখন বন্যার পানি ঢুকে পরিবার নিয়ে গৃহহীন মানুষ। কোথায় আশ্রয় নেবেন এমন ভাবছিলেন। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তবে তাদের এই উদ্বেগ বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকেনি। মুসলমান হলেও অসহায় পরিবারের সদস্যদের ডেকে বাড়িতে নিয়ে যান ওই গ্রামের ফার্মেসি দোকান্দার উত্তম কুমার। কুদ্দুস নামের এক ব্যক্তি তার পুরো পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকায় হিন্দু উত্তমের বাসায়। শুধু কুদ্দুস নন তার মত গ্রামের আরও তিনটি মুসলমান পরিবারকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন উত্তম। তাদের সঙ্গে ভাগবাটোয়ারা করে খাচ্ছেন উত্তম কুমারের পরিবার। এবারের বন্যায় এই সম্প্রীতি দেখা দিয়েছে। শুধু ধর্মীয় নয়, রাজনীতি সম্প্রীতিও দেখা লক্ষ্য করা গেছে। এবারের বন্যায় লোকজন এক অপরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও অতি বর্ষণে রাজশাহীর বাগমারায় তৃতীয় দফা বন্যা হানা দেয়। বন্যায় কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে যাওয়া ছাড়াও খেতের ফসল তলিয়ে যায়। এছাড়াও প্রায় ২৫ কোটি টাকার মাছ পানিতে ভেসে যায়। এই বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন উপজেলার দ্বীপপুর, বড়বিহানালী, কাচারীকোয়ালীপাড়া, ঝিকড়া ইউনিয়নের লোকজন। এসব এলাকার প্রায় ৭০ শতাংশ লোক পানিবন্দী। অনেকে গৃহহীন। তবে তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন গ্রামের লোকজন। সোমবার সকালে উপজেলার দ্বীপপুর ইউনিয়নের হাসানপুর গ্রামে গিয়ে লোকজনের দুর্ভোগের চিত্র চোখে পড়ে। ওই গ্রামের ফার্মেসি দোকানি উত্তম কুমারের বাড়িতে গিয়ে তিনটি মুসলমান পরিবারকে আশ্রয় অবস্থায় দেখা যায়। তার বাড়িটি একটু উঁচু হওয়ার কারণে এখনও বন্যার পানি ঢুকেনি। এই সুবাদে ওই গ্রামের কৃষক আবদুল কুদ্দুস, সায়েদ আলী ও বয়েন উদ্দিনের পরিবারকে বাড়িতে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। উত্তম কুমার জানান, তার বাড়িতে আশ্রয় নেয়া ব্যক্তিদের বাড়িঘর ডুবে ও ধসে গেছে। অন্য ধর্মের হলেও কোন ভেদাভেদ না রেখে তাদের ডেকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে এক সপ্তাহ ধরে থাকছেন তারা। একই বাড়িতে নিজ নিজ ধর্ম পালন করা হচ্ছে। আশ্রয়দাতা হিসেবে তাদের খাওয়া-দাওয়ার খোঁজ নেয়া ছাড়াও সহযোগিতাও করা হচ্ছে। অনেক সময় একই খাবার ভাগবাটোয়ারা করে খাওয়া হচ্ছে। আশ্রয় নেয়া আবদুল কুদ্দুসসহ অন্যরা জানান, ধর্ম বা জাতি না দেখে একজন আশ্রয়দাতার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা সব সময় ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রেখে চলেছেন। বিপদে কোন ভেদাভেদ যেন থাকে না এর দৃষ্টান্ত হিন্দু ধর্মাবলী ব্যক্তির বাড়িতে তাদের আশ্রয় নেয়া বলে মন্তব্য করেন। এ রকম সম্প্রীতির প্রমাণ আরও কয়েকটি স্থানে দেখা গেছে উপজেলা ঘুরে। উপজেলার বড় বিহানালী ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য চেয়ারম্যান মাহমুদুর রহমানের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন ইউনিয়ন কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নানসহ পরিবারের ছয় সদস্য। পাঁচদিন ধরে বিএনপি নেতার বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে আছেন কৃষক লীগের নেতা ও পরিবারের সদস্যরা। রাজনীতিতে বিপক্ষ হলেও বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বিএনপি নেতা মাহমুদুর রহমান বলেন, দলীয় পরিচয় কোন বিষয় নয়। বিপদে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোই বড় মানবতা। একই রকমের মন্তব্য করেছেন আশ্রয় নেয়া কৃষক লীগ নেতা আবদুল হান্নানও। অপরদিকে বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাকিরুল ইসলামের মালিকানাধীন একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খোলে দিয়েছেন। সেখানে সব দলের লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন। এখানেও কোন দলীয় দিক বিবেচনা করা হয়নি। এদিকে সম্প্রতির নমুনা পাওয়া যায় ত্রাণ বিতরণেও। বন্যাকবলিত দ্বীপপুর ইউনিয়নের কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে নিজ হাতে ত্রাণ ও নগদ টাকা বিতরণ করেছেন উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান ও ভবানীগঞ্জ পৌর মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী মমতাজ আক্তার বেবী। তিনি জানান, এলাকার পুত্রবধূ হিসেবে বন্যাকবলিত দ্বীপপুর ইউনিয়নের দুর্গত সব দলের লোকজনের মধ্যে ত্রাণ এবং অর্থ বিতরণ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য জানান, তাকে দুর্গত হিসাবে ত্রাণ দেয়া হয়েছে। দলীয় বিবেচনায় নয়। বিপদে কোন ভেদাভেদ নেই।
×