ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমদানির দরকার পড়বে না

গ্রীষ্মকালে পেঁয়াজ আবাদ করা গেলে ঘাটতি থাকবে না

প্রকাশিত: ২১:৩২, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০

গ্রীষ্মকালে পেঁয়াজ আবাদ করা গেলে ঘাটতি থাকবে না

সমুদ্র হক ॥ দেশে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের উৎপাদন, চরাঞ্চলে এবং চিনিকল এলাকায় আখের সঙ্গে সংযুক্ত ফসল পেঁয়াজের আবাদ করা গেলে দেশে পেঁয়াজের কোন ঘাটতি থাকবে না। ধানের মতো পেঁয়াজের ফলন উদ্বৃত্ত হবে। এমনটি জানিয়েছেন মসলা গবেষণা কেন্দ্রের গবেষকগণ। বর্তমানে পেঁয়াজের চাষ হয় শুধু শীত মৌসুমে। যা মুড়িকাটা পেঁয়াজ নামে পরিচিত। বগুড়া নগরী থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার উত্তরে ৭০ একর ভূমিতে দেশের একমাত্র মসলা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয় ১৯৯৪ সালে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) নজরদারিতে এই গবেষণা কেন্দ্র পরিচালিত। এই কেন্দ্রের গবেষকগণ সারাবছর পেঁয়াজ আবাদের ছয়টি জাত উদ্ভাবন করেছেন। এগুলো বারি-১ থেকে ৬ পর্যন্ত। এর মধ্যে বারি-১, ৪ ও ৬ জাত শীতকালীন। যার অধিক পরিচিতি মুড়িকাটা পেঁয়াজ। এর বাইরে এই কেন্দ্রের বড় সাফল্য গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ। যেগুলো বারি-২,৩ ও ৫ জাতের। শীত মৌসুমে সারাদেশে মুড়িকাটা পেঁয়াজের চাষ হয়। সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় পাবনা, ফরিদপুর ও মাগুরা জেলায়। এর বাইরে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ হয় কালেভদ্রে। বেশিরভাগ কৃষকের কাছে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের খবর পৌঁছানো যায়নি। মসলা গবেষণা কেন্দ্র গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জাত উদ্ভাবন করে তা কৃষি মন্ত্রণালয়কে জানায়। এই জাতের বীজ বিতরণের দায়িত্ব বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি)। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদকে মাঠ পর্যায়ে পৌঁছানোর দায়িত্ব কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই)। মন্তব্য পাওয়া গেছে, দেশে পেঁয়াজের আবাদ ও উৎপাদনকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও উদ্বৃত্ত করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে গবেষণা কেন্দ্র, বিএডিসি ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরকে একই ছাতার নিচে আনা দরকার। বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সিএসও) ড. মোঃ হামিম রেজার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি জানান, পেঁয়াজ আবাদের অপার সম্ভাবনার মাটি এই বাংলাদেশ। যার প্রমাণ দিয়েছেন মসলা গবেষকগণ। শীতকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনের পাশাপাশি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদন করা গেলে চাহিদা পূরণের কাছাকাছি যাবে। বারি-৫ জাতের পেঁয়াজের চারা আগস্ট- সেপ্টেম্বর মাসে রোপণ করে নবেম্বর-ডিসেম্বরেই ফসল ঘরে উঠবে। প্রতি হেক্টরে ফলন ৩০ থেকে ৩৫ মেট্রিক টন। এই ফসলের পর পেঁয়াজের আরেকটি চাষ করা যায়। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে বীজ থেকে চারা বের করে রোপণ করলে মে-জুন মাসেই পেঁয়াজ ঘরে উঠবে। তবে এই জাতের উৎপাদন প্রতি হেক্টরে ২০ থেকে ২৫ মেট্রিকটন। এভাবে বারি-২ থেকে ৬ জাতের পেঁয়াজের আবাদ ভর বছর সম্ভব। ড. হামিম রেজা জানান, পদ্মা ও যমুনার চরের মাটিতে পেঁয়াজ আবাদের প্রচুর সম্ভাবনা বিদ্যমান। চরের অনেক কৃষক বিচ্ছিন্নভাবে পেঁয়াজের চাষ করে তাদের চাহিদা পূরণ করেছেন। চরের এই কৃষকদের মধ্যে পেঁয়াজ আবাদ সম্প্রসারণ করা গেলে বছরে বাড়তি ৫ থেকে ৭ লাখ মে. টন পেঁয়াজ উৎপাদন হতে পারে। চরের জমিতে প্রতি হেক্টরে পেঁয়াজের ফলন হয় ২০ থেকে ২৫ মে.টন। দিনাজপুর ও সিলেট অঞ্চল অনেক জমি পতিত পড়ে আছে। এই জমিগুলোকেও গ্রীষ্ম ও শীতকালীন পেঁয়াজ আবাদের আওতায় আনা যায়। দেশের ১৫টি চিনিকলের আওতায় আখ চাষের মৌসুমে ইন্টার ক্রপ হিসাবে পেঁয়াজ আবাদ করা সম্ভব। যে সম্ভাবনা তৈরি হয়ে আছে। দেশে আখ চাষ হয় দুই লাখ একর জমিতে। এর অর্ধেকে ইন্টার ক্রপ হিসাবে পেঁয়াজ চাষ করা গেলে অন্তত চার লাখ মে. টন বাড়তি পেঁয়াজ উৎপাদিত হবে। এর বাইরে আদা রসুন হলুদ মরিচ মানকচুর জমিতে ইন্টার ক্রপ হিসাবে পেঁয়াজ আবাদ করা সম্ভব। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩৫ লাখ মেট্রিক টন। চলতি বছরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) জরিপে বছরে দুই দশমিক ১৬ লাখ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়ে উৎপাদন হয় ২৩ দশমিক ৭৬ লাখ মে.টন। ঘাটতি পেঁয়াজ আমদানি নির্ভর। এই ঘাটতি খুব সহজেই পূরণ করা যায় গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ করে। এর পাশাপশি চর ভূমি, দিনাজপুর ও সিলেটের পতিত ভূমি, আখ ও অন্যান্য মসলা ফসলের সঙ্গে ইন্টার ক্রপে পেঁয়াজ আবাদ করলে কোনভাবেই ঘাটতি থাকার কথা নয়। উল্টো ধানের মতো পেঁয়াজও উদ্বৃত্ত হবে। গবেষণা কেন্দ্রের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ নূর আলম জানালেন, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ বাড়ির ছাদ বাগানের টবেও করা সম্ভব। বর্তমানে রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি জেলায় ছাদ বাগানের টবে নানা ধরনের সবজি চাষ হচ্ছে। সামার অনিয়ন (গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ) ছাদ বাগানের টবে করলে কোন ফ্ল্যাট বাড়ির কয়েকটি পরিবারের পেঁয়াজের চাহিদা পূরণ হতে পারে। পেঁয়াজ সরাসরি খাবার নয়। খাদ্যের ভাল স্বাদ আনতে মসলা হিসেবে ব্যবহার হয়। পেঁয়াজের ঝাঁজে তরকারির বাড়তি স্বাদ। পেঁয়াজের পাতা বা ফুলকি পেঁয়াজের স্বাদ এনে দেয়। এ ধরনের আরেকটি পাতার সন্ধান পাওয়া গেছে। যা চিভ নামে পরিচিত। এর স্বাদ পেঁয়াজ ও রসুনের মতো। একটি পেঁয়াজের সঙ্গে কয়েকটি চিভ পাতা তরকারিতে দিলে তিন চারটি পিঁয়াজের স্বাদ এনে দেয়। অনেক পরিবার পেঁয়াজের খরচ কমাতে এই চিভে খাদ্যাভাস করছেন। গত বছর গাজীপুর কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে চিভ আবাদ করা হয়। যারা পেঁয়াজ রসুন খান না, তাদের অনেকেই এই চিভ পাতায় তরকারি রান্না করেন। এই চিভ আলাদা একটি ফসল। পেঁয়াজ নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ অতি অল্প মসলা ও খুব কম তেল ও পেঁয়াজে রান্নায় খাবার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এতে রোগব্যাধি সহজে আক্রমণ করতে পারে না। পেঁয়াজ নিয়ে দেশে যখন এত হৈ চৈ তখন বগুড়ায় দেশের একমাত্র মসলা গবেষণা কেন্দ্রের উদ্ভাবন আড়ালেই থাকছে। গবেষণা কেন্দ্রের অধীনে তিনটি আঞ্চলিক ও চারটি উপ-আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র মসলার বহুমুখী উদ্ভাবনে সফলতা এনেছে। মসলা চাষ ও গবেষণায় দেশ অনেক এগিয়েছে। কয়েকবছর আগে গবেষণালব্ধ সফলতা এসেছে পেঁয়াজ উৎপাদনে। প্রতিষ্ঠানটি ভর বছর পেঁয়াজ আবাদের ছয়টি জাত উদ্ভাবন করেছে। এছাড়াও তারা ১৫টি মসলা ফসলের উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ৪০টি জাত উদ্ভাবন করেছে। এগুলো পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, আদা, হলুদ, ধনিয়া, মেথী, পান, মৌরী, কালোজিরা, গোলমরিচ, দারুচিনি। গবেষণার মাঠে আছে শলুক, তেজপাতা, রাঁধুনী, জোয়ান, ফিরিঙ্গি, চুঁইঝাল, একাঙ্গি, পিপুল, শঠি, দই রং, বচ, পুদিনা, পোলাও পাতা, লেমনগ্রাজ, আম আদা, মিঠা তুলশি, পান সুপারি, জিরা, কাবাবচিনি, চিভস, অলস্পাইস, কারিপাতা, পান বিলাস, লবঙ্গ পেস্তা বাদাম, জয়ফল-জৈত্রী। আরেকটি সূত্রের কথা, মাঠ পর্যায় থেকে বাজার হয়ে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে কিছু পেঁয়াজ নষ্ট হয়। দেশের কৃষক পেঁয়াজের ন্যায্য দাম পেলে তারা অধিক আবাদে আগ্রহী হবে। এই বিষয়ে বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের সিএসও মোঃ হামিম রেজা জানান, মাঠ পর্যায়ে দুটি ওয়ার্কশপে দু’জন অতিরিক্ত সচিব কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেন। কৃষকের কথা তাদের ৮০ শতাংশই শীত মৌসুমে পেঁয়াজের আবাদ করেন। প্রতিমণ পেঁয়াজ আবাদে খরচ হয় ৬শ’-৭শ’ টাকা। প্রতিমণ এক হাজার টাকা দরে বেচলেই তারা লাভবান হবে। তাছাড়া পেঁয়াজ বেশিদিন ঘরে রাখলে প্রতি কেজিতে ২শ’ থেকে আড়াইশ’ গ্রাম কমে যায়। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদে তাদের আগ্রহ আছে। তবে ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা দরকার।
×