ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সব সময় দুর্ঘটনার শঙ্কা

ঝুঁকিপূর্ণ পাইপ লাইনে চলছে তিতাসের গ্যাস সরবরাহ

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

ঝুঁকিপূর্ণ পাইপ লাইনে চলছে তিতাসের গ্যাস সরবরাহ

রশিদ মামুন ॥ শহরজুড়ে ঝুঁকিপূর্ণ পাইপ লাইনে গ্যাস সরবরাহ করছে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। সংস্কারের উদ্যোগ বাস্তবায়ন চলছে ঢিমেতালে। এতে প্রতিদিনই সৃষ্টি হচ্ছে দুর্ঘটনার শঙ্কা। নারায়গঞ্জে এত বড় প্রাণহাণির ঘটনার পরও পাইপ লাইনের লিকেজ খুঁজে বের করতে প্রতিষ্ঠানটি কোন উদ্যোগ নেয়নি। ঢাকা এবং ময়মনসিংহ এলাকায় ১৩ হাজার ১৩৮ কিলোমিটার পাইপ লাইনের মাধ্যমে ২৮ লাখ ৬৫ হাজার ৯০৭ গ্রাহককে গ্যাস বিতরণ করে প্রতিষ্ঠানটি। এসব গ্যাস সরবরাহ পাইপ লাইনের বেশিরভাগেরই মেয়াদ শেষ হয়েছে বহু আগে। গত কয়েক বছর ধরে ঝুঁকিপূর্ণ পাইপ লাইন পুনরায় বসানোর আলোচনাও চলছে। তবে সবেমাত্র প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে অনুমোদনের জন্য পেট্রোবাংলায় পাঠিয়েছে কোম্পানিটি। গ্যাস পাইপ লাইনে লিকেজ থেকে বছরের বিভিন্ন সময় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে। এতে অনেক সময়ই প্রাণহাণির ঘটনা ঘটার পরেও বিতরণ কোম্পানিটি অনেকটা নির্বিকার থাকছে। নারায়ণগঞ্জে দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানির পর পাইপ লাইনে লিকেজের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। তবে তিতাসের পাইপ লাইনে কোথায় কোথায় এ ধরনের লিকেজ রয়েছে তা খুঁজে বের করতে এখন জ¦ালানি বিভাগের কোন নির্দেশনা পায়নি তিতাস। নিজস্ব উদ্যোগেও প্রতিষ্ঠানটি এ কাজ শুরুও করেনি। জানতে চাইলে তিতাসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা যখন যেখানে অভিযোগ পাচ্ছি সেখানে পাইপ লাইনের লিকেজ সারানো হচ্ছে। তবে নারায়ণঞ্জের দুর্ঘটনার পর কোথায় কোথায় লিকেজ রয়েছে তা খুঁজে বের করার বিষয়ে বিশেষ কোন নির্দেশনা এখনও দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, আমাদের পাইপ লাইন অনেক এগুলোর কোথায় কি অবস্থায় রয়েছে তা পর্যালোচনা করতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। নারায়ণগঞ্জে মসজিদে অগ্নিকা-ের পর সকল মসজিদের বিদ্যুত লাইন এবং শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র কি অবস্থায় রয়েছে তা পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে বিদ্যুত বিভাগ। এরপর থেকে বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানি মসজিদে মসজিদে গিয়ে এই পরীক্ষার কাজ শুরু করেছে। তারা বলছে তিন দিনের মধ্যেই এই পরীক্ষার কাজ শেষও করতে চায় তারা। কিন্তু জ¦ালানি বিভাগ এ ধরনের কোন উদ্যোগ নেয়নি। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য জ¦ালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিসুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতা উত্তর ১৯৬৮ সালের ২৮ এপ্রিল তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে গ্যাস সরবরাহ করার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিতাস গ্যাসের বেশিরভাগ সম্প্রসারণ হয়। সেই হিসেবে তিতাসের যে পাইপ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে তার মেয়াদ এরমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি সূত্র বলছে তাদের বেশিরভাগ পাইপ লাইন ২০ থেকে ৪০ বছরের পুরাতন। ফলে এসব পাইপ লাইনে লিকেজ তৈরি হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন থেকে বাসা বাড়ি পর্যন্ত যেসব পাইপ লাইন রয়েছে সেগুলোতেও লিকেজ রয়েছে। এসব লিকেজ থেকে বাসা বাড়ির বদ্ধ জায়গাতে গ্যাস জমে যায়। এতে প্রায় ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটে। সূত্র বলছে ১৯৬৭-৬৮ সালে ডেমরা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত ১২ ইঞ্চি এবং ডেমরা থেকে পোস্তগোলা ১৪ ইঞ্চি ও ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়। এরপর সেখান থেকে দুই ইঞ্চি থেকে ছয় ইঞ্চি ব্যাসের বিতরণ নেটওয়ার্ক স্থাপন করে গ্রাহকদের গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়। নব্বই দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ঢাকা শহরের বিভিন্ন অংশে ৫০ পিএসআই চাপের বিভিন্ন ব্যাসের বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হয়। নব্বইয়ের দশকের থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহর এলাকা ক্রমান্বয়ে বর্ধিত হচ্ছে। তবে নতুন আবাসিক সংযোগ বন্ধ থাকায় ২০১০ এর পর থেকে আর কোন পাইপ লাইন নির্মাণ করা হয়নি। সেই হিসেবে পাইপ লাইনগুলোর মেয়াদ এর মধ্যে শেষ হয়েছে। বৈধ পাইপ লাইনের যেখানে খোঁজ রাখে না বিতরণ কোম্পানিটি। সেখানে অবৈধ পাইপ লাইনের বিষয়েও নজর নেই বিতরণ কোম্পানির। প্রতি মাসে যতটা অবৈধ পাইপ লাইনের খোঁজ আসে তার এক তৃতীয়াংশও উচ্ছেদ করতে পারেনা কোম্পানি। অন্যদিকে অবৈধ পাইপ লাইন উচ্ছেদ করার পর আবারও ঠিকাদারের মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী এসব পাইপ লাইন রাতের অন্ধকারে বসিয়ে নেয়। তিতাসের একজন কর্মকর্তা বলেন, এসব কাজের সঙ্গে তিতাসের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা কর্মচারীর সঙ্গে ঠিকাদাররা মিলে মিশে এই অবৈধ পাইপ লাইন বসিয়ে থাকে। আবার এরাই এখান থেকে টাকা তুলে ভাগাভাগি করে নেয়। ফলে অবৈধ লাইন কার্যত বন্ধ হয় না। ওই কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু বৈধভাবে বাসাবাড়িতে নতুন সংযোগ দেয়া হয় না, তাই অবৈধভাবেই সাধারণ মানুষ গ্যাস ব্যবহারে দিকে ঝুঁকছে। তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি সূত্র বলছে গত কয়েক বছরে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তিতাস পাইপ লাইন প্রতিস্থাপন করেনি। কোথাও কোন উন্নয়ন কাজের জন্য তিতাস গ্যাস পাইপ লাইন প্রতিস্থাপন করলেও মেয়াদোত্তীর্ণ পুরাতন লাইন প্রতিস্থাপন করা হয়নি। যদিও তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি বলছে পুরাতন এসব পাইপ লাইন সরিয়ে নতুন পাইপ লাইন বসাতে তারা একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের প্রস্তাবটি এখন পেট্রোবাংলায় অনুমোদনের জন্য রয়েছে। পেট্রোবাংলার অনুমোদনের পর জ¦ালানি বিভাগের অনুমোদন শেষে অর্থ বিভাগ এবং সরকারের অনুমোদন নিয়ে দরপত্র আহ্বান করা হবে। ফলে পাইপ লাইন স্থাপন করতে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। আর এর আগে কটি দুর্ঘটনা ঘটে এটিই দেখার বিষয়।
×