ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশমুখী হচ্ছে চীন ফেরত জাপানী বিনিয়োগ

প্রকাশিত: ২২:১৫, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

বাংলাদেশমুখী হচ্ছে চীন ফেরত জাপানী বিনিয়োগ

কাওসার রহমান ॥ চীন ফেরত জাপানী বিনিয়োগ এবার বাংলাদেশমুখী হচ্ছে। নানা প্রচেষ্টা ও জল্পনা-কল্পনার পর জাপান সরকার চীন থেকে তার দেশের কারখানা সরিয়ে নেয়ার তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। চীন থেকে জাপানী উদ্যোক্তাদের শিল্প কারখানা সরিয়ে নিতে বৃহস্পতিবার (৩ সেপ্টেম্বর) জাপান সরকার যে দ্বিতীয় দফা ভর্তুকি কর্মসূচী ঘোষণা করেছে তাতে এবার বাংলাদেশকে যুক্ত করা হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতও। এজন্য ২ হাজার ৩৫০ কোটি ইয়েন (২২ কোটি ১০ লাখ ডলার) ভর্তুকি হিসাবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চীনের ওপর একক নির্ভরশীলতা কমিয়ে পণ্যের সরবরাহ চেন বহুমুখী করার জন্যই জাপানের শিল্প মন্ত্রণালয় দ্বিতীয় দফা এই ভর্তুকি কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। এর আগে প্রথম দফায় চীন থেকে জাপানের ৮৭টি কোম্পানির কারখানা সরিয়ে নেয়ার জন্য গত জুলাই মাসে প্রথম দফা ভর্তুকি কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই সময় জাপান সরকার কারখানা স্থানান্তরে কোম্পানিগুলোকে সহায়তা করার জন্য ২৪ হাজার ৩৫০ কোটি জাপানী ইয়েনের তহবিল গঠন করেছিল। এই তহবিল থেকে প্রদেয় অর্থ চীনে অবস্থিত জাপানী কোম্পানিগুলোকে স্থানান্তরের জন্য অনুদান হিসাবে দেয়া হবে। তারই অংশ হিসাবে জাপানী উদ্যোক্তারা এখন চীন থেকে তাদের শিল্প কারখানা বাংলাদেশ ও ভারতে স্থানান্তরের জন্যও ভর্তুকি পাওয়ার যোগ্য হবে। বৃহস্পতিবার জাপান সরকার তাদের দেশের ‘সাপ্লাই চেইন’ বা সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে চলমান ভর্তুকি কর্মসূচী সম্প্রসারণ করেছে। ২০২০ আর্থিক বর্ষের সম্পূরক বাজেট ঘোষণার মাধ্যমে সরকার দ্বিতীয় এই ভর্তুকি কর্মসূচী সম্প্রসারণ করে। বাজেটে দ্বিতীয় দফা কর্মসূচীর জন্য ২ হাজার ৩৫০ কোটি ইয়েন বা ২২ কোটি ১০ লাখ ডলার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রথম দফা কর্মসূচীতে চীন থেকে জাপানী কোম্পানিগুলোকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং জাপানে স্থানান্তরের নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। আর দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশ ও ভারতে স্থানান্তরের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। জাপানের নিক্কেই এশিয়ান রিভিউর শুক্রবারের এক খবরে বলা হয়েছে, জাপানের অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফা শিল্প স্থানান্তরের আবেদনপত্র গ্রহণের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। এই কর্মসূচীর লক্ষ্য হচ্ছে, জাপান ও আসিয়ানভুক্ত দেশে জাপানী পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা সব সময় চালু রাখা। এজন্য এবার চীন ফেরত জাপানী শিল্প স্থানান্তরে দেশটি দৃষ্টি দিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতি। এজন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ও পাইলট প্রকল্পের জন্য ভর্তুকির আওতায় অনুদান হিসাবে কোম্পানিগুলোকে এক কোটি ডলার দেয়া হবে। মূলত এই ইস্যুটি সামনে এসেছে, করোনা মহামারীর প্রথম দিকে চীনে সব শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে। ওই সময়ে জাপানে চীন থেকে আসা পণ্যের সরবরাহ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দুর্ভোগে পড়তে হয় জাপানকে। তাই চীনের ওপর একক নির্ভরশীলতা কমিয়ে জাপান তার সাপ্লাই চেন বহুমুখী করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিশেষ করে, ইলেকট্রনিক কমপোনেন্ট ও মেডিক্যাল সামগ্রীর জরুরী সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য। এতে কোন একটি দেশে সমস্যা হলেও জাপানে তাদের চাহিদার পণ্যের সাপ্লাই চেন স্থিতিশীল ও অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। গত জুলাইতে জাপানের অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় প্রথম দফায় ৮৭টি কোম্পানিকে সহায়তার জন্য চূড়ান্ত কর্মসূচী ঘোষণা করে। এরমধ্যে ৫৭টি কোম্পানি চীন থেকে তাদের শিল্প ইউনিট জাপানে স্থানান্তরের জন্য অনুদান গ্রহণ করে। অপর ৩০টি কোম্পানি পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এজন্য ওই কোম্পানিগুলো এক হাজার কোটি ইয়েন অনুদান পায়। এরমধ্যে হুয়া তাদের শিল্প ইউনিটগুলো চীন থেকে ভিয়েতনাম ও লাওসে স্থানান্তর করে। অপর কোম্পানি সুমিতুতো রাবার তাদের কোম্পানিগুলো স্থানান্তর করে মালয়েশিয়ায়। জাপানীদের চীন ছাড়ার কারণ দেশটির ওপর নির্ভরতা কমানো ও উৎপাদন ব্যয় কমানো। যেকোন পণ্য সস্তায় ও কম খরচে তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত চীনে গত তিন দশকে ঘাঁটি গেড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপানী বহুজাতিকেরা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে কয়েক বছর ধরে বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। বেশিরভাগ চীনা পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ঢুকতে ২৫ শতাংশ বাড়তি শুল্কের মুখে পড়ছে। এর মধ্যে করোনাভাইরাস দেখিয়ে দিয়েছে, এককভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল থাকাটা কতটা বিপদের। তাই নিরাপত্তা ও কৌশলগত কারণেই চীনের ওপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্য নিয়েছে জাপানীরা। ফলে শুরু হয়েছে সম্মিলিত প্রস্থান। আর এই প্রস্থানের সুফল বেশি পাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। বিশেষ করে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড। জাপানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৮৭টি কোম্পানির ৫৭টি জাপানে ফিরে যাচ্ছে। আর ৩০টি চীন ছেড়ে অন্য দেশে যাচ্ছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) ওয়েবসাইটে চীন ছেড়ে জাপানের বাইরে অন্য কোন দেশে যাওয়া কোম্পানিগুলোর তালিকা দেয়া রয়েছে। সেই তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩০টির মধ্যে ১৫টি কোম্পানি ভিয়েতনাম, ৬টি থাইল্যান্ড, ৪টি মালয়েশিয়া, ৩টি ফিলিপাইন, ২টি লাওস, ১টি ইন্দোনেশিয়া এবং ১টি মিয়ানমার যাচ্ছে (দুটি কোম্পানি কারখানা দুই দেশে নিচ্ছে)। জাপান কারখানা সরাতে প্রথম দফা যে সহায়তা দিচ্ছে, তা মূলত আসিয়ানভুক্ত (এ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশন) দেশগুলোতে যাওয়ার জন্য। আঞ্চলিক এই জোটের সদস্য ১০টি দেশ হলো ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ব্রুনাই, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া ও লাওস। বিনিয়োগ ও ব্যবসার ক্ষেত্রে আসিয়ান দেশগুলোকে অগ্রাধিকারে রাখে জাপান। জাপানের বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নমুরা হোল্ডিংসের এক জরিপ ও বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে ফক্স নিউজ জানিয়েছিল, ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত ৭৯টি কোম্পানি চীন থেকে কারখানা সরিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে ২৬টি ভিয়েতনামে, ১১টি তাইওয়ানে, ৮টি থাইল্যান্ডে, ৬টি মেক্সিকোতে ও ৩টি ভারতে গেছে। বাংলাদেশ পেয়েছে ২টি। তখন থেকে বাংলাদেশও জাপানী বিনিয়োগ পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। দেশে জাপানীদের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে, যার ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এটি উন্নয়ন করছে জাপানের সুমিতমো করপোরেশন। জাপানী অর্থনৈতিক অঞ্চল ২০২১ সালে কারখানা করার উপযোগী হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার সহায়তায় বিনিয়োগকারীদের জন্য এক দরজায় সেবা বা ওয়ান স্টপ সার্ভিসও চালু করেছে বেজা। যদিও তাতে বেশ কিছু সেবা যুক্ত করা এখনও বাকি। যদিও গত ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অফিস কক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বাণিজ্য মন্ত্রীর সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় জনিয়েছেন, জাপান বাংলাদেশে অটোমোবাইল কারখানা স্থাপনের চিন্তা করছে। বাংলাদেশের আড়াইহাজার স্পেশাল ইকোনমিক জোনে জাপান বড় ধরনের বিনিয়োগ করবে, এ বিনিয়োগ হবে এশিয়ার মধ্যে বৃহৎ। বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত বলেন, জাপান বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ২০২৪ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পরও জাপান বাংলাদেশকে দেয়া বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখার চিন্তা করছে। এজন্য এফটিএ অথবা পিটিএ করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন। এ সময় তিনি জানান, জাপানের ব্যবসায়ীগণ বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে আগ্রহী। উভয় দেশের বাণিজ্য-বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা যেতে পারে। এর আগে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম গত ১২ মে জেট্রোর ঢাকা কার্যালয়কে চিঠি দিয়ে বলেছেন, জাপান বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার যে কৌশল নিয়েছে, তা নিয়ে বাংলাদেশ খুবই আগ্রহী। এফবিসিসিআই চায়, জাপান কারখানা সরিয়ে বাংলাদেশে আনুক। চীন থেকে সরে যাওয়া কারখানা এ দেশে আনতে বাড়তি সুবিধা দেয়ার চিন্তা করছে সরকারও। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি কমিটিও কাজ করছে। বাংলাদেশে এখন জাপানী কোম্পানির সংখ্যা ২৭০টির মতো। বিগত কয়েক বছরে হোন্ডা মোটর করপোরেশন, জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল, নিপ্পন স্টিল এ্যান্ড সুমিতমো মেটাল, মিতসুবিশি করপোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে। অন্য দেশগুলো যেভাবে জাপানী বিনিয়োগ পাচ্ছে, বাংলাদেশ সেখানে অনেক পিছিয়ে। এমনকি মিয়ানমারও বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকছে। বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসাসূচক বা ইজি অব ডুয়িং বিজনেসে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৬৮তম। এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম ৭০, থাইল্যান্ড ২১ ও ইন্দোনেশিয়া ৭৩তম। মিয়ানমারের অবস্থানও বাংলাদেশের তিন ধাপ আগে, ১৬৫তম।
×