ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ॥ কিছু আইনী তর্ক ও সুপ্রীমকোর্ট

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ২০ আগস্ট ২০২০

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ॥ কিছু আইনী তর্ক ও সুপ্রীমকোর্ট

(গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর) এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে কারাগারে আটক দণ্ডিত ৫ জন পৃথক পৃথকভাবে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে ‘লীভ পিটিশন’ দাখিল করলে আপীল বিভাগে ‘লীভ’ মঞ্জুর হয়। আপীল বিভাগ দণ্ডিতদের পক্ষে উপস্থাপিত ৫টি আইনী বিষয় বিবেচনার জন্য লীভ মঞ্জুর, যা ছিল- ‘(১) হাইকোর্ট বিভাগের একটি দ্বৈত বেঞ্চের দু’জন বিচারক ভিন্নমত পোষণ করে পৃথক পৃথক রায় প্রদান করায় তৃতীয় বিচারক পূর্ণাঙ্গ ভাবে অর্থাৎ সকল সাজাপ্রাপ্তের বিষয়ে ডেথ রেফারেন্সটি শুনানী গ্রহণ না করে শুধুমাত্র ৬ জন সাজাপ্রাপ্তের রেফারেন্স শুনানি করে আইনগত ভুল করেছে; (২) ‘দীর্ঘ বিলম্বে অর্থাৎ ২১ বছর পর রাষ্ট্রপক্ষ অসৎ উদ্দেশ্যে ও পরিকল্পিতভাবে মনগড়া গল্প তৈরী করে আসামীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে’- কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগ এই বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে সর্বোচ্চ সাজা ‘মৃত্যুদ-’ দিয়ে চরম ভুল করেছে; (৩) ‘সামরিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সেনা বিদ্রোহের এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিহত হয়েছেন’- এটা সাধারণ বা প্রচলিত কোন খুন নয়; সুতরাং প্রচলিত আদালতে এ খুনের বিচার এখ্তিয়ার বহির্ভূত ও বিচার কার্যক্রমকে কলুষিত (vitiated) করেছে; (৪) রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক উত্থাপিত সাক্ষ্য সমূহ প্রমাণ করে না যে, হত্যা-কে সংঘটিত করার জন্য কোন ‘অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র’ হয়েছিল, বরং সামরিক বিদ্রোহ হয়েছিল মুজিব সরকারকে পরিবর্তনের জন্য; (৫) রাষ্ট্রপক্ষ দণ্ডিত আপীলকারীদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য আদালতে উপস্থাপনে এটি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে যে, তারা দ-বিধির ৩০২/৩৪ ধারায় কোন অপরাধ সংঘটিত করেছে এবং সে কারণে হাইকোর্ট বিভাগ আপীলকারীদের দ- ও সাজা বহাল রেখে মারাত্মক ভুল এবং আইনের অপপ্রয়োগ করেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করলে আপীল বিভাগে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের শেষ ধাপ থমকে যায়। আপীল শুনানির জন্য আপীল বিভাগে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগ না দিয়ে কৃত্রিমভাবে বিচারক সঙ্কট তৈরি করে রাখা হয়। বিশেষভাবে নিযুক্ত আইনজীবী বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। অবশেষে দীর্ঘ আট বছর পর ২০০৯ সালে আবারও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে আপীল বিভাগে নতুন বিচারপতি নিয়োগের মাধ্যমে আপীল শুনানি সম্ভব হয়। আপীল বিভাগ সংশ্লিষ্ট পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীদের বক্তব্য শোনার পর দ-িত আপীলকারীদের পক্ষে উত্থাপিত আইনগত প্রশ্নসমূহ সম্পর্কে নি¤েœাক্ত সিদ্ধান্ত ও অভিমতসমূহ প্রদান করে আপীলসমূহ খারিজ করে দেয়- ‘(১) ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ৩৭৪ ও ৪২৯ অনুসারে তৃতীয় বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারক সম্পূর্ণ এখতিয়ার রাখেন যে, ‘তিনি বিরোধপূর্ণ কোন বিষয়ের উপর শুনানী করবেন’; সুতরাং তৃতীয় বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারক হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারকগণ যে ৬ জন আসামীর বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন শুধুমাত্র তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কোন ভুল করেননি; (২) বিজ্ঞ দায়রা জজ এবং হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ দীর্ঘ বিলম্বে এজাহার দায়ের সম্পর্কে রাষ্টপক্ষের ব্যাখ্যা ও সাক্ষ্য পর্যালোচনায় যে সিদ্ধান্ত একযোগে দিয়েছেন তাতে হস্তক্ষেপ করার কোন সুযোগ নেই; শুধুমাত্র বিলম্বে এজাহার দায়েরের কারণে প্রসিকিউশন অর্থাৎ রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ অবিশ^াস করার কোন সুযোগ নেই; বিভিন্ন পারিপাশির্^ক ঘটনা ও পরিস্থিতির কারণে এজাহার দায়েরে বিলম্ব হতেই পারে; (৩) আর্মি এ্যাক্ট-১৯৫২-এর ধারা ৫৯(২) অনুসারে ঐ আইনের অধীনে খুনের ঘটনা বিচার তখনই হবে যদি অপরাধীরা ‘সক্রিয় চাকুরীরত’ থাকে; কিন্তু আসামীরা আর্মি এ্যাক্টের ধারা ৮(১) অনুসারে ‘চাকুরীতে সক্রিয়’ ছিল না বিধায় প্রচলিত ফৌজদারী আদালতে তাদের বিচারে কোন বাধা ছিল না; দ্বিতীয়ত: যদি এটা ধরেও নেয়া হয় যে, আর্মি এ্যাক্টের ধারা ৮(২) অনুসারে এটা একটি ‘দেওয়ানী অপরাধ’ (সিভিল অফেন্স) তথাপি ঐ আইনের ধারা ৯৪ অনুসারে প্রচলিত আদালতে বিচারে কোন বাধা নেই; (৪) আদালতে উপস্থাপিত সাক্ষ্য পর্যালোচনায় এ সিদ্ধান্তে আসার কোন সুযোগ নেই যে, ‘সেনা বিদ্রোহের কারণেই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দ ও অপর তিনজন নিরাপত্তাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল’; এটা ‘সেনা বিদ্রোহ’ সংঘটিত করার জন্য কোন অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ছিল না, বরং ‘অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রটি’ ছিল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দকে হত্যা করার জন্য; (৫) হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ উপস্থাপিত সাক্ষ্য বিবেচনায় বিশ্বাস করেছেন যে, রাষ্ট্রপক্ষ আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণে সক্ষম হয়েছে; অপরদিকে দ-িত আপীলকারীগণ এটা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে যে, হাইকোর্ট বিভাগ সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণে ও বিবেচনায় ‘গুরুত্বর কোন ভুল’ বা ‘অবিচার’ করেছে- যাতে ন্যায় বিচার বিঘিœত ও আইনের অপ-প্রয়োগ হয়েছে; (৬) দ-িত আপীলকারীগণ আদালতের সামনে এমন কোন ‘বিশেষ বিষয়’ বা ‘প্রেক্ষাপট’ উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়নি যার ভিত্তিতে তাদের মৃত্যুদ-ের সাজা হ্রাস করা যেতে পারে এবং সে কারণে দায়রা আদালত কর্তৃক প্রদত্ত ‘মৃত্যুদ-ের’ সাজা যা ডেথ রেফারেন্সে হাইকোর্ট অনুমোদন দিয়েছে- তাতে হস্তক্ষেপ করার কোন সুযোগ নেই।’ ‘বিলম্ব কোন অপরাধীর বিচারে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না’- এই আইনী নীতিটি আবারও স্বীকৃতি পায়। বিচার চাইবার অধিকার সাংবিধানিক ও সার্বজনীন ভাবে স্বীকৃত। এই স্বীকৃত অধিকারকে স্বৈরাচারী কোন অধ্যাদেশ দ্বারা রুদ্ধ করা যায় না। আপীল বিভাগের রায়ের পর পরই কারাগারে থাকা দ-প্রাপ্ত পাঁচজনের ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয় ২৮ জানুয়ারি, ২০১০-এ। সাম্প্রতিক সময়ে আরও একজন দ-িতকে গ্রেফতার করে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। জাতি কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত হয়েছে; অবসান হয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও গ্লানি। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীমকোর্ট বিলম্বে হলেও জাতির জনকের হত্যার বিচারে অর্পিত সংবিধানিক ও আইনী দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়েছে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও। (সমাপ্ত) লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগ এবং সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১, বাংলাদেশ
×