ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ড. সনজিত পাল

পুণ্যময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ

প্রকাশিত: ২১:০৫, ১১ আগস্ট ২০২০

পুণ্যময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ

লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ আবির্ভাব তিথি শুভ জন্মাষ্টমী উপলক্ষে সবাইকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা। প্রতি বছর এই তিথি আমাদের জন্য শুভ ও কল্যাণের বার্তা নিয়ে এলেও এবারের পরিস্থিতি অন্য যে কোন বারের চেয়ে ভিন্ন। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য মানুষের প্রার্থনা আর হাহাকারের মধ্যে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শুভ জন্মাষ্টমী উৎসব পালন করছে। আমরা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন বিশ্বকে এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা করেন। মানুষকে এই মহামারী থেকে পরিত্রাণ করেন। এ পৃথিবী যেন আবার আগের মতো কর্মচঞ্চল ও প্রাণময় হয়ে ওঠে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম উৎসব জন্মাষ্টমী। কথাটি শুনলে অবাক লাগে। যিনি বিশ্ব ব্রহ্মা-ের সৃষ্টি, পালন ও লয়ের কর্তা, তাঁর আবার জন্ম হয় কীভাবে? আসলে ভগবানের জন্ম আর দশটা মানুষের মতো নয়। তাঁর জন্মটা দিব্যময়। যা মানুষের অনুভূতির অতীত। ভগবান লোককে দেখানোর জন্য তিনি কাউকে বাবা-মা মাধ্যম ধরে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। পৃথিবীতে অবতরণ করতে হলে তাকে জন্ম নিতে হবে। তাই তিনি মানুষের মতো জন্ম নেয়ার লীলা করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণও তেমনি লীলা করেছেন। দ্বাপর যুগে বসুদেব আর দেবকীর ঘরে তাদের সন্তান হয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। তিনি কৃষ্ণ নামে পরিচিত হন। এই কৃষ্ণই হচ্ছেন জগতপালক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। ব্রহ্মসংহিতায় (৫/১) বলা হয়েছে, ‘শ্রীকৃষ্ণ, যিনি গোবিন্দ নামেও পরিচিত, তিনি হচ্ছেন পরম ঈশ্বর। তাঁর রূপ সচ্চিদানন্দময় (নিত্য, জ্ঞানময় ও আনন্দময়)। তিনি হচ্ছেন সবকিছুর পরম উৎস। তাঁর কোন উৎস নেই। কেননা তিনি হচ্ছেন সমস্ত কারণের পরম কারণ।’ শ্রীমদ্ভাগবতে (১/১/১) বলা হয়েছে, ‘হে বসুদেব তনয় শ্রীকৃষ্ণ! হে সর্বব্যাপ্ত পরমেশ্বর ভগবান! আমি আপনাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। আমি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করি। কেননা তিনি হচ্ছেন প্রকাশিত ব্রহ্মা-সমূহের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের পরম কারণ। তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সবকিছু সম্বন্ধে অবগত এবং তিনি সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন, কেননা তাঁর অতীত আর কোন কারণ নেই। তিনিই আদি কবি ব্রহ্মার হৃদয়ে সর্বপ্রথম বৈদিক জ্ঞান প্রদান করেছিলেন। তাঁর দ্বারা মহান ঋষিরা এবং স্বর্গের দেবতারাও মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, ঠিক যেভাবে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়লে আগুনে জল দর্শন হয়, অথবা জলে মাটি দর্শন হয়। তাঁরই প্রভাবে জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের মাধ্যমে জড় জগত সাময়িকভাবে প্রকাশিত হয় এবং অলীক হলেও সত্যবৎ প্রতিভাত হয়। তাই আমি সেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করি, যিনি জড় জগতের মোহ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়ে তাঁর ধামে নিত্যকাল বিরাজ করেন। আমি তাঁর ধ্যান করি, কেননা তিনিই হচ্ছেন পরম সত্য।’ শ্রীমদ্ভাগবতে (১/২/২৮-২৯) বলা হয়েছে, ‘সমগ্র বৈদিক শাস্ত্রে জ্ঞানের পরম উদ্দেশ্য হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। যজ্ঞ সম্পাদনের উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ ভগবানের প্রীতিবিধান এবং যোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁকে জানা। সমস্ত সকাম কর্মের চরম ফল তিনিই দান করেন। পরম জ্ঞান ও সমস্ত তপশ্চর্যার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁকে জানা এবং তাঁর প্রতি প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত হওয়াই হচ্ছে ধর্মের উদ্দেশ্য। তিনি হচ্ছেন জীবনের পরম উদ্দেশ্য।’ শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থের আদি লীলায় (৫/১৪২) বলা হয়েছে, ‘একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরম ঈশ্বর এবং অন্য সকলেই তাঁর সেবক। তিনি যেভাবে নির্দেশ দেন, তাঁরা সেভাবেই কাজ করেন।’ ঈশোপনিষদের আবাহন পর্বে বলা হয়েছে, ‘পরমেশ্বর ভগবান সর্বতোভাবে পূর্ণ। তিনি সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ বলে এই দৃশ্যমান জগতের মতো তাঁর থেকে উদ্ভূত সব কিছুই সর্বতোভাবে পূর্ণ। যা কিছু পরম পূর্ণ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, তা সবই পূর্ণ। কিন্তু যেহেতু তিনি হচ্ছেন পরমপূর্ণ, তাই তাঁর থেকে অসংখ্য অখ- ও পূর্ণ সত্তা বিনির্গত হলেও তিনি পূর্ণরূপেই অবশিষ্ট থাকেন।’ শ্রীমদ্ভাগবতে (২/৯/৩৩) ব্রহ্মার প্রতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উক্তি থেকেও সেই প্রমাণ মেলে। সেখানে তিনি ব্রহ্মার উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘হে ব্রহ্মা! সৃষ্টির পূর্বে কেবল আমি ছিলাম এবং সৎ, অসৎ ও অনির্বচনীয় নির্বিশেষ ব্রহ্ম পর্যন্ত কোন কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না। সৃষ্টির পরে এই সমুদয় স্বরূপে আমিই বিরাজ করি এবং প্রলয়ের পর কেবল আমিই অবশিষ্ট থাকব।’ সেখানে (১/৩/২৬ ও ২৮) আরও বলা হয়েছে, ‘হে ব্রাহ্মণগণ! বিশাল জলাশয় থেকে যেমন অসংখ্য নদী প্রবাহিত হয়, ঠিক তেমনিই ভগবানের থেকে অসংখ্য অবতার প্রকাশিত হন। ভগবানের এই সমস্ত অবতারেরা পুরুষাবতারদের অংশ অথবা কলা। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান। যখন অধার্মিকের অত্যাচার বেড়ে যায়, তখন ধার্মিকদের রক্ষা করার জন্য পরমেশ্বর ভগবান এই ধরাধামে অবতীর্ণ হন। ভগবদ্গীতায় (৪/৭-৮) অর্জুনকে উদ্দেশ্য করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘হে ভারত, যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই। সাধুদের পরিত্রাণ করার জন্য, দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের উদ্দেশ্যে আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানের অতীত। তিনি মায়ারূপ যবনিকার দ্বারা আচ্ছাদিত, তিনি অব্যক্ত ও অচ্যুত। মূঢ় দ্রষ্টা যেমন অভিনেতার সাজে সজ্জিত শিল্পীকে দেখে সাধারণত চিনতে পারে না, তেমনই অজ্ঞ ব্যক্তিরাও ভগবানকে দেখতে পায় না। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কদাচিৎ কোন একজন সিদ্ধি লাভের জন্য যতœ করেন। আর সেই প্রকার যতœশীল সিদ্ধদের মধ্যে কদাচিৎ একজন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে কিংবা তাঁর ভগবৎস্বরূপকে তত্ত্বত অবগত হতে পারেন। তাই দক্ষ প্রবচনের দ্বারা, গভীর মেধার দ্বারা, এমনকি বহু শ্রবণের দ্বারাও পরমেশ্বর ভগবানকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। ভগবান যাকে নির্বাচিত এবং পছন্দ করেন, তিনিই কেবল তাঁকে জানতে পারেন। সেই রকম ভক্তের কাছে ভগবান স্বয়ং নিজের স্বরূপ প্রকাশ করেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি জড়া প্রকৃতির অতীত। তাই তিনি হচ্ছেন সাক্ষাৎ গুণাতীত পুরুষ। অন্তর ও বাইরের সমস্ত বিষয় তিনি দর্শন করতে পারেন। তাই তিনিই হচ্ছেন সমস্ত জীবের পরম অধ্যক্ষ। কেউ যদি তাঁর চরণকমলকে আশ্রয় করে তাঁর ভজনা করেন, তা হলে তিনিও সেই রকম গুণাতীত স্তর লাভ করতে পারেন। আজ বিশ্বব্যাপী যে দুর্যোগ বয়ে যাচ্ছে, এই ক্রান্তিকালে আমরা সবাই ভগবানের শ্রীচরণকমলে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তিনি যেন আমাদের সবাইকে শান্তি দান করেন। এই মহামারী থেকে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী যেন রক্ষা পায়, এই প্রার্থনায় পূর্ণ হোক এবারের সকলের অংশগ্রহণে জন্মাষ্টমীর শুভ আয়োজন। লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল এ্যান্ড কলেজ এবং প্রাক্তন সভাপতি, শ্রীচৈতন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংঘ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×