ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোঃ হারুনুর রশীদ

জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি কর্মসূচী খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে অবদান

প্রকাশিত: ১৯:৩৮, ২৫ জুলাই ২০২০

জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি কর্মসূচী খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে অবদান

দেশে কৃষি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হলেও এখনও গবেষণা মাঠ ও কৃষকের জমিতে বিরাজমান ফলনের পার্থক্য অনেক। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিদ্যমান। এ পার্থক্য কমিয়ে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব যা খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দেশে উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্যের উৎপাদন বহুমুখীকরণ আশানুরূপ নয়। তাছাড়া কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজন ব্যবস্থা এখনও সীমিত। অন্যদিকে বৈশ্বিক জলবায়ু ও কৃষি বাণিজ্যিক পরিবেশের পরিবর্তন, ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জাতীয় পর্যায়ে আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন এবং গবেষণা ও সম্প্রসারণ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সাফল্যের পটভূমিতে চলমান সম্প্রসারণ কার্যক্রম সময়োপযোগী করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও প্রান্তিক কৃষকের আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে সার্বিক কৃষির উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিশ্বব্যাংককে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য আহ্বান জানায়। বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিশ্বব্যাংক ১৫ বছরের জন্য কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি কর্মসূচী (এনএটিপি) বাস্তবায়ন করতে চুক্তি সম্পাদন করে। এর আওতায় আরেক উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইফাদ (আইএফএডি) এই কর্মসূচীতে আর্থিক সহযোগিতা প্রদানে এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ওই প্রকল্পের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে গবেষণায় (বিএআরসি অঙ্গ) প্রায় ৫৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রজেক্ট-১ (এনএটিপি-১) নামে এর ১ম পর্যায় শুরু হয় ২০০৭ সালে ও শেষ হয় ২০১৪ সালে। এ প্রকল্পের ১ম ধাপ বাস্তবায়নের ফলে প্রকল্প এলাকায় কৃষকরা নতুন কৃষি প্রযুক্তিসমূহ গ্রহণ করে, গবেষণা-সম্প্রসারণের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়, সাপ্লাই চেইন ও গবেষণা-সম্প্রসারণ-কৃষক সম্পর্ক জোরদার হয়। প্রকল্পের গবেষণা অঙ্গের মাধ্যমে ১০৮টি গবেষণা উপ-প্রকল্প জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমভুক্ত (এনএআরএস) ১২টি প্রতিষ্ঠান ও ৬টি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাস্তবায়িত হয় এবং এতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শস্য উপ-খাতে-২২টি, প্রাণিসম্পদ উপ-খাতে-৫টি, মৎস্য উপ-খাতে -৩টি, তথ্যপ্রযুক্তি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ১২টিসহ সর্বমোট ৪২টি হস্তান্তরযোগ্য ও উন্নত কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়। এনএটিপি-১ প্রকল্পের আওতায় উদ্ভাবিত উল্লেখযোগ্য উন্নত প্রযুক্তিসমূহের মধ্যে রয়েছে- উচ্চফলনশীল লবণাক্ত সহিঞ্চু বিনাধান-১০, বাউ হাইব্রিড ধান-১ (সুগন্ধি ধান), বারি তাপ সহিঞ্চু হাইব্রিড টমেটো-৮, সাদা পাট, বাদাম ও তিলের ১২টি উন্নত লাইন, ৫টি স্বল্পমেয়াদী রোগ প্রতিরোধী সরিষার লাইন, ১০টি খাট জাতের সূর্যমুখীর লাইন, বিএইউ আদা-৩, স্বল্পমেয়াদী উচ্চফলনশীল গম, বালাইনাশক ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি, ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে চুন প্রয়োগ প্রযুক্তি, কাঁঠালের গ্যামোক্সিস রোগ ব্যবস্থপনা, আদার পচন রোগ ব্যবস্থাপনা, নারিকেলের মাকড় (মাইট) ব্যাবস্থাপনা, লেবু জাতীয় ফলের ক্যাংকার রোগ দমন পদ্ধতি ও সারা বছর ফসল পেতে বিভিন্ন ধরনের শস্য বিন্যাস, হালদা নদীতে রুই, কাতলা ও মৃগেলের পোনা উৎপাদন, বিলুপ্তপ্রায় বাগাইর, মোহাশোল, বাইমের উন্নত চাষ পদ্ধতি, পাহাড়ী এলাকায় ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন, মুরগির রোগ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন ইত্যাদি। উদ্ভাবিত প্রযুক্তি জাতীয় সম্প্রসারণ কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে। পরামর্শক সংস্থা কর্তৃক জরিপে প্রতীয়মান হয় যে, কৃষকের উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণের ফলে খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণে প্রকল্প এলাকায় ফসলের ৯-৫৪%, প্রাণিসম্পদের উৎপাদন ৫৯-৮৭% এবং মাছের উৎপাদন ৬৪-৯৮% বৃদ্ধি পেয়েছে। ধানের ফলন আউশে হেক্টর প্রতি ৩.০৭ হতে ৩.৮২ টন, আমনে হেক্টর প্রতি ৩.১৯ হতে ৪.০১ টন, বোরোতে হেক্টর প্রতি ৫.৪৩ হতে ৫.৯৪ টন, আলু হেক্টর প্রতি ১৭.১০ হতে ১৯.৮০ টন, টমেটো হেক্টর প্রতি ২০.১০ হতে ২৮.৪০ টন, বাঁধাকপি হেক্টর প্রতি ২৯.৩০ হতে ৪৫.১০ টন বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাণিসম্পদের ক্ষেত্রে প্রতিটি ক্রস গরুতে দৈনিক ৫.১ হতে ৮.৭ লিটার দুধ বৃদ্ধি পেয়েছে। মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৩.৯৮ হতে ৮.৫৫ টন বৃদ্ধি পেয়েছে। এনএটিপি-১ সফলভাবে বাস্তবায়িত হওয়ায় বিশ্বব্যাংক প্রকল্পটিকে ফ্ল্যাগশিপ প্রজেক্ট হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণ খাতে দীর্ঘমেয়াদে কারিগরি ও আর্থিক সহযোগিতা দিতে বিশ্বব্যাংক ও সহযোগী সংগঠন ইফাদ, ইউএসএআইডি, কৃষি মন্ত্রণালয় (লিড এজেন্সি) এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় ছয় বছর মেয়াদী এনএটিপি-২ প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু করে ২০১৫ সালে। মোট ৫টি বাস্তবায়ন ইউনিট যথাক্রমে- বিএআরসি (অঙ্গ-১), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) (অঙ্গ-২), মৎস্য অধিদফতর (অঙ্গ-৩), প্রাণিসম্পদ অধিদফতর (অঙ্গ-৪) এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন ইউনিট (অঙ্গ-৫) এ প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট রয়েছে। উল্লেখ্য, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কৌশলগত সহযোগী হিসেবে সাপ্লাই চেইন ও মূল্য সংযোজন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। ফসল, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ বিষয়ে লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন, প্রযুক্তি সম্প্রসারণ এবং সংগ্রহত্তোর পর্যায়ে অপচয় রোধ ও মূল্য সংযোজন এবং বাজার ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষকদের বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের উৎপাদন, উৎপাদনশীলতা ও আয় বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি কৃষকদের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন সাধনে দ্বিতীয় ধাপে (২০১৫-২০২১) এনএটিপি-২ কাজ করে যাচ্ছে। প্রকল্পের গবেষণা অঙ্গের উদ্দেশ্য হলো কৃষির উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেম শক্তিশালীকরণ, প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমভুক্ত (এনএআরএস) প্রতিষ্ঠান, সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সহায়তায় গবেষণা অঙ্গের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। তাছাড়া, এনএআরএসভুক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৪০টি পিএইচডি বৃত্তি (দেশে-৮০ ও বিদেশে-৬০) প্রদান করা হয়েছে এবং এনএআরএসভুক্ত বিজ্ঞানীদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ, কর্মশালা আয়োজন করা হচ্ছে। তাছাড়া পরীক্ষাগারের ও আইসিটি কার্যক্রম উন্নয়নের মাধ্যমে এনএআরএস প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও তথ্য ভান্ডার (ডেটা সেন্টার) স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে প্রকল্পের গবেষণা অংগে ইতোমধ্যে ৬৯টি হস্তান্তরযোগ্য ও উন্নত কৃষি প্রযুক্তি (শস্য খাতে-৫১টি, প্রাণিসম্পদ খাতে-১০টি, মৎস্য খাতে-৮টি) উদ্ভাবিত হয়েছে। উদ্ভাবিত প্রযুক্তিসমূহের মধ্যে উচ্চমূল্যের লিলিয়াম ফুলের চাষ, উচ্চফলনশীল ব্রিধান-৯১ (জলী আমন), লবণাক্ততা সহিঞ্চু সরিষা ও সূর্যমুখীর লাইন, বিভিন্ন ফসলের আইপিএম প্রযুক্তি, মাটিবিহীন আদা চাষ প্রযুক্তি, মাটির উর্বরতা শক্তি সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন ধরনের শস্য বিন্যাস, চর এলাকায় তামাকের বিকল্প হিসেবে উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদন প্রযুক্তি, জৈব সার উৎপাদন ও ব্যবহার প্রযুক্তি, বোরো ধানের সুস্থ সবল চারা উৎপাদন (শীত সহিঞ্চু), গুণগতমানসম্পন্ন রফতানিযোগ্য পান উৎপাদন প্রযুক্তি, সবজি ও ফল ফসলে ব্যবহৃত কীটনাশকের অবশেষের প্রভাব সময় নির্ধারণ, ব্যাগ ব্যবহারের মাধ্যমে রফতানিযোগ্য গুণগতমানসম্পন্ন আম উৎপাদন প্রযুক্তি, অপ্রচলিত এলাকায় উচ্চমূল্যের সবজি চাষ, খরা প্রবণ এলাকায় উচ্চমূল্যের স্বল্পমেয়াদী মাছ চাষ পদ্ধতি, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গলদা চিংড়ি এবং দেশী শিং জাতীয় মাছের (ক্যাট ফিসে) মিশ্র চাষ, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ছাগল ও ভেড়া পালনের উপযুক্ত খাদ্য প্রস্তুতপ্রণালী, পনির (চিজ) তৈরির সহজলভ্য পদ্ধতি, গুড় তৈরির উন্নতমানের আখ মাড়াই প্রযুক্তি উল্লেখযোগ্য। উদ্ভাবিত প্রযুক্তিসমূহের মধ্যে ১১টি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠানের (কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ৬টি, মৎস্য অধিদফতর-৩টি ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতর-২টি) মাধ্যমে কৃষকদের মাঝে সম্প্রসারণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক চাহিদাভিত্তিক মৌলিক ও কৌশলগত গবেষণার জন্য আরও ৫১টি গবেষণা উপ-প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে কৃষি উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং ভবিষ্যতে উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ৪% সুদে ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনা প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি খাতের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ৪% সুদে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কৃষকদের মাঝে ঋণ প্রদান করতে যাচ্ছে। অধিকন্তু, কৃষি খাতে সরকার প্রণোদনা অব্যাহত রেখেছে। বসতবাড়ির আঙ্গিনাসহ সকল পতিত জমিতে শাক-সবজি, ফল-মূল ও অন্যান্য ফসলের চাষে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে এনএটিপি উদ্ভাবিত প্রযুক্তিসহ চাহিদা অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করবে বলে আশা করা যায়। লেখক : পরিচালক, প্রকল্প বাস্তবায়ন ইউনিট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, এনএটিপি-২
×