ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কামরুল ইসলাম চৌধুরী

খুলেছে জাতীয় প্রেসক্লাব, হারিয়েছি অনেককেই

প্রকাশিত: ১৯:৪৪, ২০ জুলাই ২০২০

খুলেছে জাতীয় প্রেসক্লাব, হারিয়েছি অনেককেই

খুলেছে জাতীয় প্রেসক্লাব। অবসান হলো দীর্ঘ প্রতীক্ষার। করোনা মহামারীর আকালের এই অবরুদ্ধকালে চার মাস ক্লাব ছিল লকডাউনে। অবশেষে সীমিত আকারে খুলল ১৬ জুলাই। আমরা যাচ্ছি আমাদের প্রিয় প্রাঙ্গণে। সদস্যদের পদচারণায় মুখরিত হতে শুরু করেছে আবার আমাদের দ্বিতীয় গৃহ। ফিরে তো পেলাম না আগের সেই প্রেসক্লাব! একাত্তরের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধশেষে ক্লাবে ফিরে যেমন পাওয়া যায়নি রেখে যাওয়া পুরনো দ্বিতীয় গৃহ। আবার ক্লাবে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের নিত্যদিনের সেই আড্ডায় আমাদের মাঝে আর নেই বেশ কজন অগ্রজ, আমাদের শ্রদ্ধেয় মানুষ। এক দুজন নয়। নয়জন প্রিয় জ্যোতির্ময় সাংবাদিক। দিকপাল সাংবাদিক ডিপি বড়ুয়া, দ্যুতিমান সাংবাদিক আবু জাফর পান্না, রং ছড়ানোর কারিগর রওশন উজ্জামান, মুক্তিযোদ্ধা কবি মাশুক চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা কাজপাগল মোহিতুল ইসলাম রনজু, পরিশ্রমী ফারুক কাজী, সিদ্ধহস্ত রশিদ উন নবী বাবু, গেদুচাচাখ্যাত খোন্দকার মোজাম্মেল হক চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এই করোনা মহামারীকালে মায়াভরা এই পৃথিবী ছেড়ে আকাশের তারা হয়ে গেছেন। কেউ সাংবাদিকতা শুরু করেছেন পঞ্চাশের দশকে, কেউ উত্তাল সত্তরের শুরুতে, মাঝে বা শেষে রক্তঝরা সময়ে। সাংবাদিকতা পেশায় নিখাদ পেশাদার এই মানুষগুলো রেখেছেন অনন্য অবদান। কত অম্লমধুর স্মৃতি আমাদের। কত যুগ দশক মমতায় জড়িয়ে ছিলাম। সজীব হাসি-খুশি একানব্বই বছর বয়সী বড়ুয়া দা ছিলেন আমার প্রধান সম্পাদক। চমৎকার ইংরেজী লিখতেন। ১৯৫৮ সালে মর্নিং নিউজ দিয়ে তার সাংবাদিকতা শুরু। সেই সময়ে ট্রেন দুর্ঘটনার ওপর তার অসাধারণ বর্ণনা অনেক পাঠকের চোখে জলের ধারা নামিয়েছিল। তার ইংরেজীর ছোঁয়ায় আমার রিপোর্ট অনন্য হয়ে উঠত। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক। ক্লাব অন্তপ্রাণ এই মহীরুহকে আমরা মিস করছি। বাংলাদেশ অবজারভার আর লন্ডনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমস খ্যাত পান্না ভাই আশি ছুঁই ছুঁই বয়সেও কি চৌকস সাংবাদিক। ‘কি মিয়া কামরুল, খবর আছেনি’ বলে আর কোনদিন কাছে ডাকবেন না আমাদের তারকা পান্না ভাই। দেবেন না আর সংবাদের নানা টিপস্। পরিচয় করিয়ে আর দেবেন না হরেক রকম মানুষের সঙ্গে। বিদেশ থেকে আসার সময় আনতেন আমাদের জন্য কিছু না কিছু গিফট। চুপিসারে আর তো পাব না অমন ভালবাসার উপহার। সুদর্শন রওশন ভাই কত অসাধারণ মিষ্টি রিপোর্ট করেছেন, অন্যের কপি যতœ নিয়ে এডিট করেছেন। লন্ডনে প্রশিক্ষণ পাওয়া জেমিনি নিউজের সংবাদদাতা রওশন ভাই ছিলেন অনেকের গুরু। কবিতার মতো স্নিগ্ধ ছিল তার লেখা! বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিবেশ চিত্র, সুন্দরবন চিত্র, বিশ্ব পানি চিত্র, এয়ার পলিউশন ইন এশিয়ান সিটিজসহ নানা গ্রন্থের সম্পাদনায় তিনি আমাকে অকুণ্ঠ সহযোগিতা করেছেন। আমার বক্তৃতার খসড়া আর তিনি করে দেবেন না। মনে পড়ে রণাঙ্গন ফেরত কবি মাশুক ভাই কি তাক লাগানো হেডিং করতে পারতেন। কপি দেখতেন নীরবে! ছিল না বার্তা সম্পাদকের হাঁকডাক, ঠাটবাট, তর্জন গর্জন। বাবু টেনশন না নিয়ে টিম ওয়ার্ক করত। অনুজ সহকর্মীদের কি মমতায় না ও আগলে রাখত। সহ-সম্পাদক থেকে ধীরে ধীরে হয়েছিল সম্পাদক। রন্জু মাঠের রিপোর্টার থেকে সম্পাদক। কি মিষ্টভাষী, নিরহঙ্কারী। ফারুক কাজী হাড়ভাঙা পরিশ্রমী রিপোর্টার হিসেবে নমস্য। আইন আদালত রিপোর্ট ছিল ঝরঝরে। পেশাদার সৎ এবং মহতী এই নির্ভেজাল সাংবাদিকদের কি আমরা ভুলতে পারব? জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য থাকাকালীন তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছি। ভোট দিয়েছেন, ভোট চেয়েছেন। কত মমতা ছড়িয়েছেন। হাজারও স্মৃতি। মোজাম্মেলের সাপ্তাহিক কাগজে গেদুচাচার কলাম ছিল তুমুল জনপ্রিয়। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমাদের সময়ে ২০১৫ সালে ক্লাব সদস্য হতে পেরেছিল বলে বেশ সমীহ করত মোজাম্মেল। ক্লাবের দক্ষিণের বারান্দার সেই বিখ্যাত টেবিলে সাংসদ মুহম্মদ শফিকুর রহমান আর আমার সামনে এসে আর কোন দিন বসবে না। ক্লাবের প্রবীণতম সদস্য আমানুল্লাহ ভাই, গোলাম মহিউদ্দিন খান, কেজি মোস্তফা, শামসুদ্দিন আহমেদ পেয়ারা বা হারুন হাবীব ভাইকে দেখে আর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াবে না। হায়রে জীবন। এই নির্ভেজাল তারকা সাংবাদিকদের পায়ের চিহ্ন আর পড়বে না জাতীয় প্রেসক্লাবে। আর তো কখনও দেখা হবে না তাদের সঙ্গে। ভাবতেই চোখ অশ্রুসজল হয়ে যায়। ক্লাব অঙ্গন থেকে তাদের আমরা শেষ বিদায়ও জানাতে পারিনি। এদের অবদানের স্বীকৃতিও আমরা দেইনি। এরাই সত্যিকারের ‘আনসাং হিরোজ অব আওয়ার প্রফেশন’। আমাদের ক্ষমা করে দিন। করোনা মহামারীর আকালে আমরা দেশবরেণ্য ক’জন জাতীয় ব্যক্তিত্বকেও চিরতরে হারিয়েছি। জাতীয় অধ্যাপক ড আনিসুজ্জামান, জাতীয় অধ্যাপক ড জামিলুর রেজা চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সা’দত হুসাইন, সাংবাদিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদকে। বাঙালী জাতির গঠন ও বিকাশে রয়েছে তাদের অসামান্য অবদান। জাতীয় প্রেসক্লাব তাদের পদধূলি থেকে ও হবে বঞ্চিত। তোমাদের সকলকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। মওলানা রুমির কথা দিয়ে বলি, সঠিক বেঠিকের উর্ধে হয়ত আবার দেখা হবে বেহেশতের বাগানে। লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাব
×