ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী

প্রকাশিত: ১৯:৪৩, ২০ জুলাই ২০২০

চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী

৭ জুন ১৯৬৬। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ‘ম্যাগনাকার্টা’খ্যাত বাঙালীর মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন। তাঁরই নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ঐতিহাসিক ৭ জুন ১৯৭২ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু আরেক যুগান্তকারী ভাষণ প্রদান করেন। সে ভাষণে বঙ্গবন্ধু নাতিদীর্ঘ বিশ্লেষণে পাকিস্তানী সামরিকজান্তা কর্তৃক নির্বাচন বানচালের চেষ্টা, মুক্তি সংগ্রামের সূচনা, দালালদের সমালোচনা, যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি, শিল্প জাতীয়করণ ও শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন, সমাজবিরোধী কার্যকলাপ, জাতির আদর্শ, পাকিস্তানে আটক বাঙালীসহ সমুদয় বিষয়ে জনগণকে সম্যক অবহিত করেন। অভূতপূর্ব এই ভাষণে সমাজবিরোধী কার্যকলাপ বা মজুদদার, চোরাকারবারি ও চেরাচালানিদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি বলেন ‘তাদের আমি সোজা কথায় বলে দিচ্ছি, পাঁচ মাস আমি তাদের অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, বুঝিয়েছি, অনেক করে বলেছি, এ কাজ কর না। আমার বিশ্বাস ছিল যে, তারা আমার কথা শুনবে। কিন্তু দেখছি, ‘চোরা নাহি শুনে ধর্মের কাহিনী’। তাই তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলতে চাই, যারা শহরে সরকারী বাড়ি, গাড়ি দখল করে আছ, যারা অন্যের দোকান বা জমি দখল করে আছ, যারা মজুদ করছ, জিনিসপত্র বিক্রি করছ না, জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছ, তাদের রেহাই নেই... বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান। আর ঘুঘু ধান খাওয়ার চেষ্টা কর না। আমি পেটের মধ্য হতে ধান বের করে ফেলব।’ এই অমূল্য ভাষণের প্রাসঙ্গিকতায় বর্তমান দুঃসহ করোনাকালে তাঁর সুযোগ্যকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার কণ্ঠে একই ধরনের উচ্চারণ প্রতিধ্বনিত এবং কুৎসিত অপকর্মের কুশীলবদের বিতৃষ্ণিত হিং¯্রতা পরিলক্ষিত করতে হবে, তা জাতির কল্পনাতীত। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কুলি-মজুর’ কবিতার কয়েকটি পঙক্তি নিবন্ধের সূচনায় সমস্বরে উচ্চারণ করতে চাই- ‘আসিতেছে শুভদিন,/দিনে দিনে বহু বাড়িয়েছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ-/... একের অসম্মান নিখিল মানব-জাতির লজ্জা- সকলের অপমান!/মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উত্থান,/উর্ধে হাসিছে ভগবান, নিচে কাঁপিতেছে শয়তান!’ বিঘূর্ণিত উচ্চকিত যে, বর্তমান বিশ্বজুড়ে প্রতিটি জাতি-রাষ্ট্র এবং সমগ্র নাগরিক করোনাভাইরাস ভীতিতে আক্রান্ত ও জীবন বিসর্জনের চরম ক্রান্তিকাল করছে। আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি এবং এর আপামর জনগোষ্ঠীও সংক্রমণ বিস্তার ও প্রাণসংহারের বাইরে নয়। মোট আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণের যে চিত্র প্রতিদিন প্রকাশ পাচ্ছে; বিশেষ করে বিগত মাসে যথাক্রমে ৬৮ ও ৬৫ শতাংশে উন্নীত হওয়ার বিষয়টি নতুন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করে চলেছে। ইতোমধ্যেই সকল বিরোধ-বিচ্ছেদ-বিভাজনকে নিধন করে নতুন এক মানবিক বিশ্ব গড়ার শিক্ষণীয়-গ্রহণীয় জ্ঞান-অভিজ্ঞতা সঞ্চারণে প্রকৃষ্ট আলোকবর্তিকার নবতর উন্মেষ ঘটেছে। পশুতুল্য কিছু মানবসন্তান এ কঠিন সময়েও কোনভাবেই তাদের লোভ সংবরণ না করে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অপকৌশল ও নিকৃষ্ট উদ্ভাবনী পন্থায় দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নে অদমনীয় প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তারা হয়ত বেমালুম ভুলে গেছে যে, তাদের স্বার্থসিদ্ধি কখনও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। মহান আল্লাহ্ সূরা রা’দ এ ঘোষণা করেছেন, ‘আল্লাহ্ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না যে পর্যন্ত না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনে এগিয়ে আসে।’ বস্তুতপক্ষে যে কোন পবিত্র ধর্ম ও ধর্ম গ্রন্থে মানব জীবনে উৎকর্ষ অর্জনে চারিত্রিক গুণাগুণকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। উত্তম বা অসৎ চরিত্রের বিভাজিত ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের চিরায়ত বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন কর্মযজ্ঞকে গ্রহণ-বর্জনের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন এমন একটি অসৎ চরিত্রের বহির্প্রকাশ, যা পুরো জাতির উন্নতি-সমৃদ্ধিকে বিপর্যস্ত করতে পারে। আভিধানিক অর্থে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন হলো সমাজনীতি ও আদর্শবিরুদ্ধ আচরণ বা অপকর্ম। তবে সামগ্রিক প্রচলিত বিবেচনায় আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রবণতা এবং সংশ্লিষ্ট কর্ম দুর্বৃত্তায়নের প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত। সাম্প্রতিককালে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকল্পে জীবন সুরক্ষার অতীব জরুরী উপকরণ যেমন- মাস্ক, কিট, অক্সিজেন. হাইফ্লো অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর নানা সরঞ্জামাদি আমদানি-ক্রয়-বিক্রয়-সরবরাহের সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের যে দৃশ্যপট জাতি পর্যবেক্ষণ করছে, তাতে দুর্বৃত্তরা লজ্জিত না হলেও পুরো জাতিই যারপরনাই এসব উপকরণ ব্যবহারে সন্দেহ সংশয়ে ভুগছে। গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে দুর্বৃত্তদের পেছনে সামাজিক-ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনুমেয় যোগসাজশ-সমর্থন-প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ জাতীয় চরিত্রকে প্রচন্ড কলুষিত করছে। গরিব-দুঃখী মানুষের অসহায়ত্ব ও করুণ অবস্থাকে অবজ্ঞা করে ত্রাণ বিতরণে জনপ্রতিনিধিদের দুর্বৃত্তপনা জঘন্য অপরাধের দৃষ্টান্ত হয়েছে। চিহ্নিত কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কারণে এই অরাজক দুঃসাহসের পর্যায় অনেকটা স্তিমিত হয়েছে বলে মনে হয়। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবা গ্রহণ ও প্রদান, আক্রান্ত-শনাক্তকরণ, হাসপাতালে ভর্তি, সেবা প্রদান না করেও অনৈতিক অর্থ আদায়, বিদ্যুত বিলের অসঙ্গতিসহ অনৈতিক সিন্ডিকেটের অসহনীয় পাপাচার অতিশয় উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরে সামান্য অক্সিজেন বা অক্সিজেন বঞ্চিত ব্যক্তিদের রাস্তা বা গাড়িতে মৃত্যুবরণের যন্ত্রণাদায়ক সংবাদ কোনভাবেই সভ্য সমাজ মেনে নিতে পারে না। প্লাজমা সংগ্রহ, করোনামুক্তির ভুয়া রিপোর্ট, আইডি কার্ডসহ নানা অপকৌশলে ঘৃণ্য জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারী বা বেসরকারী সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে দুর্বৃত্তায়নের প্রতিনিয়ত রূপ-রূপান্তর প্রকৃত অর্থে জাতিকে বিভ্রান্ত ও ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে। বিশ্বকবি রবিঠাকুরের ‘ত্রাণ’ কবিতার পঙক্তি এক্ষেত্রে সমধিক প্রযোজ্য - ‘এ বৃহৎ লজ্জারাশি চরণ-আঘাতে/চূর্ণ করি দূর করো। মঙ্গলপ্রভাতে/ মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে/ উদার আলোক-মাঝে, উন্মুক্ত বাতাসে ॥’ দেশের সকল দেশপ্রেমিক ও মানবতাবাদী মানুষের হৃদয়ে রবিঠাকুরের এই অমীয় মিনতিরাশি প্রাণশক্তিতে স্পন্দিত হোক। ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ এসব দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে সমাজের গতিময়তা ও স্বাভাবিকতা বিপন্ন হবে। আমরা বরাবরই লক্ষ্য করেছি যে, জাতির কোন দুঃসময় বা দুর্যোগে অবাঞ্ছিত, অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত মনোবৃত্তির বহির্প্রকাশ ঘটিয়ে এসব নির্মম কার্যসিদ্ধির মানবরুপী দানবের সংখ্যা কম নয়। এটি সর্বজনবিদিত যে, শুধু বাংলাদেশ নয়; পুরো বিশ্ব কম-বেশি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। উন্নত বা উন্নয়নশীল, ইসলামী প্রজাতন্ত্র বা গণপ্রজাতন্ত্র, প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য সকল দেশেই দুর্নীতির দুরন্ত প্রভাব রয়েছে। যেসব কারণে মানুষ দুর্নীতি করে থাকে; তার মূলে অর্থ-সম্পদ-ক্ষমতা-আধিপত্য-ভোগ-বিলাস ইত্যাদির স্নায়ুবিক দৌর্বল্য প্রণিধানযোগ্য। অর্থনৈতিক বৈষম্য বা ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অর্থ ও সম্পদের উপার্জন, বিতরণ, ভোগ দুর্নীতির মাত্রা ও প্রকৃতিকে নানাভাবেই উপস্থাপন করে। বিশিষ্ট সমাজ-অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক গুন্নার মিরডলের মতে, ‘সংস্কার, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ইত্যাদি কোন কিছুতেই আমার কোন আস্থা নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত দুর্নীতি দূরীকরণের কোন চেষ্টা না হচ্ছে।’ উল্লিখিত খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদের মতানুসারে দরিদ্র দেশসমূহে দুর্নীতিকে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার প্রবণতা কত যে ভয়ঙ্কর, তা রাষ্ট্র পরিচালকদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে এবং এসব দেশসমূহে দুর্নীতি দমনই হলো প্রধানতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। উচ্চমধ্যবিত্ত বা বিত্তশালী ক্ষমতাবান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়া এবং এর বিস্তৃতি ঘটানো খুবই সহজ, দরিদ্র শ্রেণীর পক্ষে নয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮৫ সালের ২৫ জুন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার National Institute of Public Finance and Policy কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৮৩-৮৪ সালে কালো টাকার পরিমাণ ছিল ৩১৫৮৪ কোটি থেকে ৩৭৭৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ, তা মূল অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (GDP) প্রায় ১৮ থেকে ২১ শতাংশ। রিপোর্ট অনুসারে ১৯৭৫-৭৬ সালে কর আদায়ের আওতার বাইরে ছিল প্রায় ৭০ থেকে ৭৪ শতাংশ। আমরা অবগত আছি যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে মানুষের আহার, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা দেন; যার প্রধান লক্ষ্য ছিল-দুর্নীতি দমন; ক্ষেতে খামারে ও কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি; জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ‘শর্ষের মধ্যে ভূত’ থাকলে বা বর্ণচোরা-অনুপ্রবেশকারী-মুখোশধারী-দলবদলে পারদর্শী জঘন্য চরিত্রের লোকজন দল বা সরকারের পদ-পদায়ন দখলে নিয়ে নানা অপকর্মে জড়িত হয়ে পড়লে, দুর্বৃত্তায়ন থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার। অর্থলোভী, বিত্ত ও ক্ষমতা লিপ্সু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিদেশে টাকা-মানবপাচার, অবৈধ অপ্রদর্শিত অর্থ-সম্পদ অর্জনে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে যেভাবে দেশের অর্থনীতি ও সামগ্রিক উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জ করছে, তাদের কঠোরহস্তে আইনের আওতায় এনে দমন করা না গেলে এই অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘গরিব দুঃখীর সুখেই স্বাধীনতার সার্থকতা’। তিনি আরও বলেছেন, ‘জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সঙ্গে আর কিছুই নিয়ে যাব না। ... যারা অন্যায় করবে, আপনারা অবশ্যই তাদের কঠোর হস্তে দমন করবেন। কিন্তু সাবধান, একটা নিরপরাধ লোকের ওপরও যেন অত্যাচার না হয়। তাতে আল্লাহ্র আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। ... আল্লাহ্র নামে প্রতিজ্ঞা করুন, ‘আমরা দুর্নীতির উর্ধে থাকব’। প্রতিজ্ঞা করুন, ‘আমরা দুর্নীতিবাজদের খতম করব’। প্রতিজ্ঞা করুন, ‘আমরা দেশকে ভালবাসব, দেশের মানুষকে ভালবাসব, দেশের মাটিকে ভালবাসব।” বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যারা দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, রাতের অন্ধকারে যারা মানুষ হত্যা করে, থানা আক্রমণ করে, অস্ত্র নিয়ে আপনাদের মোকাবেলা করে, বাংলাদেশের মাটি থেকে তাদের উৎখাত করুন।’ বিচিন্তিত যে বিষয়টি সকল সময় স্মরণে রাখতে হবে, দুর্নীতি-দুর্বৃত্ত দমনের নামে নিরীহ জনগণের মাঝে যেন আতঙ্ক সৃষ্টি না হয়। বেনামে বা ছদ্মনামে কথিত অভিযোগকারীর অভিযোগ আমলে নিয়ে অনৈতিক আর্থিক যোগসাজশ বা অবৈধ সুযোগ-সুবিধার লোভে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা ব্যক্তিস্বার্থে নিরীহ ও সৎ ব্যক্তিদের তদন্তের নামে হয়রানি করার অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে। অভিযোগকারীর যথার্থ নাম, ঠিকানা, পরিচয় ও অভিযোগের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা ছাড়া কারো বিরুদ্ধে চরিত্রহনন কার্যক্রম অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয়। এই শর্ত অবশ্যই যুক্ত করতে হবে যে, অভিযোগকারীর অভিযোগ যদি বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ, সৎ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সমন্বয়ে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাহলে অভিযোগকারীকেও কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। কথিত মিথ্যা অভিযোগ তদন্ত আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমাজে সম্মানহানির ঘটনায় যাতে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, অভিমান, অসহায়ত্ব এবং হতাশা তাদের আত্মহননে প্ররোচনা বা বিপথগামী না করে, সে দিকে অবশ্যই মনোযোগ নিবিষ্ট করতে হবে। সঠিক অর্থে যথোপযুক্ত আইনী কৌশল অবলম্বনে দেশকে দুর্নীতি-দুর্বৃত্ত মুক্ত করতেই হবে। তার ব্যত্যয় হলে ভবিষ্যত প্রজন্ম ও আগামী দিনের বাংলাদেশ আমাদের ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত করবে। নিবন্ধের শেষে রবিঠাকুরের ‘ন্যায়দ-’ কবিতার পঙক্তি, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে ॥’-যেন আমাদের জীবনের পাথেয় ও ব্রত হয়-এটিই আগামী ও বর্তমান সময়ের প্রত্যাশা। লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×