ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

খেলা মাঠে গড়ানোর প্রহর গুনছেন নারী ফুটবলাররা

প্রকাশিত: ০০:২৫, ১৫ জুলাই ২০২০

খেলা মাঠে গড়ানোর প্রহর গুনছেন নারী ফুটবলাররা

পুরো বিশ্বই এখন পার করছে অস্থির ও আতঙ্ক জাগানিয়া এক ক্রান্তিলগ্ন। বুঝতেই পারছেন- করোনাভাইরাসের কথাই বলা হচ্ছে। এই অনাকাক্সিক্ষত ভাইরাসটি প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাধ্যমে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশে। ইতোমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৮৭ হাজারের মতো, মারা গেছেন ২৪০০ জনেরও বেশি। আক্রান্তদের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। সরকার ঘোষণা করেছে জনসাধারণকে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে, জনসমাগম বা ভিড় এড়িয়ে চলতে এবং দিয়েছে আরও কিছু পরামর্শ-নির্দেশনা। শুধু তাই নয়, গত মার্চে দেশের অভ্যন্তরে সব ধরনের খেলাধুলা এবং এ সংক্রান্ত কার্যক্রম স্থগিত করারও ঘোষণা দেয় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। সবার শেষে ক্রিকেট ও ফুটবলের যাবতীয় লীগের খেলাও বন্ধ ঘোষিত হয়। উদ্দেশ্য একটাইÑ এর মাধ্যমে ক্রীড়াঙ্গনকে ভাইরাসমুক্ত বা সুস্থ রাখা। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা দলের চার তারকা ফুটবলার মিস করছেন ফুটবল খেলা। প্রহর গুনছেন আবারও খেলাটি মাঠে গড়ানোর। কাকতালীয়ভাবে তারা প্রত্যেকই ঘরোয়া মহিলা ফুটবল লিগে বসুন্ধরা কিংসের হয়ে খেলে থাকেন। এদের দুজনেই আবার একই গ্রামের বাসিন্দা। আরও মজার ব্যাপার, জাতীয় বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে অধিনায়কত্ব করার অভিজ্ঞতা। তারা হলেন মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার, কৃষ্ণা রানী সরকার এবং মিসরাত জাহান মৌসুমী। এই চার তারকা প্রমীলা ফুটবলারের করোনাকালে ফুটবল-প্রস্তুতি নিয়েই আজকের প্রতিবেদন। মারিয়া মান্দা ॥ মারিয়া মান্দা, যিনি দেশের মহিলা ফুটবলের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। মধ্যমাঠের নিপুণ কুশলী এক কারিগর। বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবল দিয়ে শুরু। জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছেন। জাতীয় দলের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে খেলে অনেক শিরোপা জিতেছেন, অ-১৬ জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেছেন, সিনিয়র দলেও খেলার সুযোগ পেয়েছেন। তৈরি করেছেন তার অসংখ্য ভক্তকুল। দেশে যে করোনাভাইরাস এত ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে, সেটা প্রথমে বুঝতে পারেননি ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার কলসিন্দুরের মেয়ে মারিয়া। ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে এসে টিভিতে দেখে ও পত্রিকায় পড়ে ধীরে ধীরে অনুধাবন করতে পারেন। তখন কিছুটা হলেও আতঙ্ক কাজ করে তার মনে। প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা বাড়ি ছেড়ে বাইরে বের হচ্ছেন না। লিগ তো এখন বন্ধ। তাহলে নিজেদের ফিট রাখার কাজও বন্ধ নাকি? মারিয়ার ভাষ্য, ‘আমাদের দেয়া শিডিউল অনুযায়ী অনুশীলন করছি। মাঠে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। তাই ঘরেই ব্যায়াম করছি, একবার অবশ্য মাঠে অনুশীলন করছি।’ ওমেন্স লিগ নিয়ে মারিয়ার অভিমত, ‘এই লিগটি নিয়মিত আয়োজন করা হলে আমাদের জন্য অনেক উপকার হবে। কারণ তাহলে আমরা পরিবারে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করতে পারব।’ জাতীয় দল নিয়ে মারিয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে আরও ভাল খেলে একদিন বিশ্বকাপের মূলপর্বে জায়গা করে নেয়া। বয়সভিত্তিক দলের অধিনায়কত্বকে কিভাবে উপভোগ করেন? ‘আমি মনে করি এটি আমার জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। এই দায়িত্বের কারণে আরও ভাল খেলতে ইচ্ছে হয়।’ মারিয়ার সাবলীল জবাব। সানজিদা আক্তার ॥ ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মহিলা ফুটবলের ইতিহাসে সাফল্যের নজির স্থাপন করেছিল মেয়েটি। এএফসির সেরা দশ মহিলা ফুটবলারের তালিকায় ছিল তার নামটি (সপ্তম স্থান)। যে মেয়েটির কথা বলছি, অনেকেই মনে করেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের সবচেয়ে সুন্দরী ফুটবলার হচ্ছে এই মেয়েটি। যার নাম সানজিদা আক্তার। খেলাতেই যার আনন্দ, সেই সানজিদার মন ভাল নেই। ভয়ঙ্কর করোনার কারণে দেশের সব খেলাধুলা যে বন্ধ! ফলে ঢাকার কমলাপুর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত মহিলা ফুটবল লিগের খেলাও বন্ধ অনির্দিষ্টকালের জন্য। বসুন্ধরা কিংসও তাদের ক্যাম্প বন্ধ করে ফুটবলারদের ছুটি দিয়েছে। দলটির মহিলা ফুটবল দলের কোচ মাহমুদা শরীফা অদিতিও গাইবান্ধায় নিজের গ্রামে চলে গেছেন। যাওয়ার আগে শিষ্যাদের বলে দিয়েছেন পারলে যেন তারা অনুশীলন করে ফিটনেস ধরে রাখে। যদিও সামনেই সানজিদার এইচএসসি পরীক্ষা। দিনরাত পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত। সেই সঙ্গে অনুশীলনও চারিয়ে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে রাইট উইঙ্গার পজিশনে খেলা সানজিদা জানান, ‘আমি, শিউলি, মারিয়া পরীক্ষা দেব। তাই পড়াশোনা নিয়েই আছি। ছুটিতে আসার আগে আমরা বসুন্ধরা কিংসের চারজন বাফুফে একাডেমিতে গিয়েছিলাম আমাদের পাঠ্যবইগুলো আনতে। কোচ ছোটন স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ক্লাব কর্তৃপক্ষের মতো তিনিও বলেছিলেন গ্রামে গিয়ে যেন ব্যায়াম করে ফিটনেস ঠিক রাখি।’ মহিলা ফুটবল লিগ এখন বন্ধ। বন্ধ হওয়ার আগে ৫ খেলার প্রতিটিতেই জিতে সর্বোচ্চ ৫১ গোল ও ১৫ পয়েন্ট নিয়ে পয়েন্ট টেবিলে শীর্ষে ছিল বসুন্ধরা। লিগ বন্ধ, কিংসের খেলোয়াড়রাও ছুটিতে বাড়িতে বসে ফিটনেস হারাচ্ছেন। পরে আবার লিগ শুরু হলে শুরুর সেই ছন্দ ধরে রাখতে পারবে তো? ‘ফিটনেস সমস্যা তো শুধু আমাদের না, সব দলেরই হবে। কাজেই এ নিয়ে ভেবে লাভ নেই।’ সানজিদার ব্যাখ্যা। লিগ শুরু হলেই এইচএসসি পরীক্ষাও শুরু হয়ে যাবে। তখন বেশকিছু ফুটবলারের সার্ভিস পাবে না কিংস। এতে কি দল দুর্বল হয়ে যাবে না? এ প্রসঙ্গে সানিজদার ভাষ্য, ‘আমার মনে হয় না। কারণ আমরা ৭-৮ জন পরীক্ষার জন্য খেলতে না পারলেও বাকিরা তো পারবে। তারাই জেতাবে দলকে। এ নিয়ে আমি আশাবাদী।’ জাতীয় দলের সব ফুটবলারই কিংসে খেলেন। ফলে লিগে তারাই চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছেন অনায়াসেইÑ এমনটা যারা ভাবেন, তাদের উদ্দেশ্যে সানজিদা বলেন, ‘উত্তরবঙ্গ, নাসরিন ... ওরাও ভাল দল। তাছাড়া এখনও লিগের অনেক খেলা বাকি। আমরা শক্তিশালী হলেও আমরাই যে চ্যাম্পিয়ন হব, এমনটা বলা ঠিক নয়।’ কৃষ্ণা রানী সরকার ॥ টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার পাথালিয়া গ্রামের মেয়ে কৃষ্ণা রানী সরকার। যার মতো দক্ষ-কুশলী ফরোয়ার্ড এই মুহূর্তে বাংলাদেশ দলের বড়ই দরকার। তবে করোনার এই ক্রান্তিকালে নারী ফুটবলারদের মতো কৃষ্ণাও বল নিয়ে মাঠে খেলতে পারছেন না। তাই বলে হাত পা গুটিয়ে একেবারেই বসে নেই তিনি। শরীরকে ফিট করে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিভাবে ফিটনেস বজায় রাখছেন মায়াকাড়া চেহারার অধিকারী কৃষ্ণা? এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন কোচরা হোয়াটসএ্যাপে মেসেজ এবং সপ্তাহে একদিন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফিটনেস সম্পর্কে জানান এবং তারা প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে থাকেন।’ এই মুহূর্তে কী ধরনের ব্যায়াম করছেন? ‘কোচদের দেয়া নির্ধারিত শিডিউল অনুযায়ী নিয়মিত অনুশীলন করছি। আমরা একেক দিন একেক রকমের ব্যায়াম করছি, যেমন : একদিন রানিং, পরদিন কোর।’ কৃষ্ণার জবাব। সবশেষে কৃষ্ণা আরও জানান, ‘এর পাশাপাশি কিরণ আপা (মাহফুজা আক্তার কিরণ, বাফুফের নারী ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান), ছোটন স্যার (গোলাম রব্বানী ছোটন, বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের কোচ) অনন্যাদি (মাহমুদা আক্তার অনন্যা, নারী জাতীয় ফুটবল দলের সহকারী কোচ), সুইনুদিরাও (সুইনু প্রু মারমা, জাতীয় নারী ফুটবল দলের হেড অব উইমেনস ফুটবল উইংস) আমাদের সংস্পর্শে রেখেছেন।’ মিসরাত জাহান মৌসুমী ॥ সিনেমার নায়িকাদের মতোই অসম্ভব রূপসী চেহারা। নামটাও নায়িকার নামে। শৈশবে হতে চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীর সৈনিক। করতে চেয়েছিলেন দেশের জন্য যুদ্ধ। বর্তমানকালে যুদ্ধই করছেন, তবে সেটা ফুটবলার হিসেবে! অস্ত্র হাতে নয়, বরং ফুটবল পায়ে। রংপুরের মেয়ে হলেও বর্তমান নিবাস সাভারের নবীনগরের খেজুরটেক বাজারে। সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার পজিশনে খেলা এই ফুটবলারটির নাম মিসরাত জাহান মৌসুমী। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দল যেন বিশ^কাপে খেলে এবং সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের অধরা শিরোপা জেতে এবং সেই দুটি দলেরই যেন গর্বিত সদস্য থাকতে পারেন, এটাই মৌসুমীর স্বপ্ন। ফুটবলের প্রতি অনুরক্ত মৌসুমী এখন ফুটবল থেকে দূরে। কারণ করোনাভাইরাস। ফিটনেস ধরে রাখতে এখন হাল্কা ব্যায়াম করছেন (স্ট্রেচিং ও কোর)। এছাড়া বাড়ির সামনে একটু ফাঁকা জায়গা আছে, সেখানে বল নিয়ে একা একা অনুশীলন করেন। বাড়ি এসে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বসুন্ধরা কিংসের অপর টিমমেটদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন মৌসুমী।
×