ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একনেকে ১০ হাজার ১০২ কোটি টাকার ৮ প্রকল্প অনুমোদন

উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয়ে সাশ্রয়ী হওয়ার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ১৫ জুলাই ২০২০

উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয়ে সাশ্রয়ী হওয়ার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ করোনা পরিস্থিতিতে উন্নয়নে প্রকল্পে ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, এরই মধ্যে প্রকল্পের আওতায় নতুন গাড়ি কেনা স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় আপ্যায়ন, বিদেশ ভ্রমণ ও অন্য যে কোন কেনাকাটায় সাশ্রয়ী হতে হবে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে এ নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশনসহ ৮ প্রকল্প অনুমেদন দিয়েছেন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এগুলো বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ১০ হাজার ১০২ কোটি ৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় হবে ১০ হাজার ৬৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা দেবে ৩৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা। মঙ্গলবার রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গণভবন থেকে অনলাইননে সংযুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপার্সন শেখ হাসিনা। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ভার্চুয়াল ব্রিফ করেন পরিকল্পনামন্ত্রী। বৈঠক পরবর্তী প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাসহ প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোভিডের কারণে টাকা শর্টেজ হবে তারপরও প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের সবাইকে মিতব্যয়ী হতে হবে, ব্যয় সাশ্রয় করতে হবে। উন্নয়নে প্রকল্পে ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে আরও বলেন, এর মধ্যে কিছু অর্থ সাশ্রয়ও হচ্ছে। আগে আমরা সভা সমিতি করতাম চা ও কেক খাইতাম, এখন খাই না। আগে খাতা কলম নিতাম এখন নেই না। এখন তো সভা করি ডিজিটালি যার যার ঘরে বসে। সুতরাং এখানেও অনেক টাকা সাশ্রয় হবে। প্রকল্পের কাজে বিদেশ যেতে হতো এখন প্রয়োজন হয় না। গাড়ি ঘোড়া, ক্রয়, বিদেশ ভ্রমণসহ সব ব্যপারে আমাদের সাশ্রয়ী হতে হবে। যত্রতত্র সেতু নির্মাণ না করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানান, জনপ্রতিনিধিরা সবাই ঘরে ঘরে বা বাড়ির সামনে একটি করে সেতু চান। এতে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দুই দিক থেকেই ক্ষতি হয়। তাই এখন থেকে সেতু নির্মাণ প্রকল্পের বিষয়ে ভালভাবে খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, আমাদের দেশে এখন অনেক সেতু হয়েছে। আর লাগবে না। তাই যত্রতত্র সেতু নির্মাণ না করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভূমি ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, জমির মালিকানা নিষ্কণ্টক হতে হবে। এ জন্য ভূমি ব্যবস্থাপনা উন্নত করা জরুরী। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জমি সুরক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, প্রতিটি ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দিতে চাই। পার্বত্য চট্টগ্রাম, হাওর ও চরাঞ্চলসহ দেশের প্রত্যন্ত সব এলাকাতেও বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দিতে হবে। এছাড়াও স্থানীয় সরকার পদ্ধতি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, স্থানীয় সরকার পদ্ধতি অনেক দিন হয়ে গেছে। এটাকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। এই বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করার দরকার বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। সভায় ‘ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ১৮ (আঠার) টি ওয়ার্ডের সড়ক অবকাঠামো ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার নির্মাণ ও উন্নয়ন (ফেজ-১)’ প্রকল্পটি ৪ হাজার ২৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এটি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের। প্রকল্পের সমস্ত ব্যয় সরকারী কোষাগার থেকে মেটানো হবে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কোন টাকা এই প্রকল্পের আওতায় নেই। সব টাকা সরকারী তহবিল থেকে মেটানোর জন্য বলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম। মেয়র বলেন, এবার আমাদের টাকা নাই। সব টাকা দিয়ে দেন। পরবর্তীতে আমাদের সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকব। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা (ডিএনসিসি) স্থানীয় সরকারের আওতায়। আপনারা নাগরিকদের সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেন। রাজস্ব আদায় করতে পারছেন না কেন? উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন স্থানী সরকারের আওতায়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সময় এসেছে এগুলো (স্থানীয় সরকার) ঢেলে সাজানোর। একদিকে বলে আমরা (স্থানীয় সরকার) স্বাধীন অন্যদিকে আবার টাকা উঠাতে পারে না। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে টাকা সহায়তা চাই। এই দুইটা এক সঙ্গে চলতে পারে না। আপনি যদি স্বাধীন সরকার হন তাহলে স্বাধীনভাবেই চলেন। স্থানীয় সরকারের পদ্ধতি দীর্ঘদিনের এটা ঢেলে সাজাতে হবে। কৃষি প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বিকল্প নেই। আমাদের এগিয়ে যেতে হলে কৃষিকে আধুনিক করতে হবে। উৎপাদন খরচ কমিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ হিসেবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া দুর্গম পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের জন্য সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সৌর বিদ্যুত সরবরাহ করা হবে। একনেকে অনুমোদন পাওয়া ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ শীর্ষক নতুন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকা। সারাদেশে এটি বাস্তবায়ন করবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই)। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে কৃষিকে ব্যবসায়িকভাবে অধিক লাভজনক ও বাণিজ্যিকভাবে টেকসই করে ফসল উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব বলে জানান তিনি। প্রকল্পটি নিয়ে তিনি আরও বলেন, চলতি মাস (জুলাই) থেকে শুরু হয়ে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পটি বাস্তায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়ছে। এটি বাস্তবায়িত হলে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ব্যবহার বাড়িয়ে ফসলের ১০-১৫ শতাংশ অপচয় রোধ করা যাবে। এছাড়া চাষাবাদে ৫০ শতাংশ সময় এবং ২০ শতাংশ অর্থ সাশ্রয় করা যাবে। পাশাপাশি সমন্বিত সবজি জাতীয় ফসল আবাদ করে কৃষি যন্ত্রপাতির ৫০ শতাংশ কর্মদক্ষতা বাড়ানো যাবে। এছাড়া যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে পোস্ট হারভেস্ট ব্যবস্থাপনায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্যতা কমানো সম্ভব হবে। এছাড়াও সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে ভূমি সংক্রান্ত সব অফিসের গতিশীলতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা হবে। এই সফটওয়্যারে দেশের ভূমি সংক্রান্ত পাঁচ হাজার ২৪৭টি অফিসকে একসঙ্গে অনলাইনভুক্ত ও ইলেক্ট্রনিক ভূমি সেবা চালু করা হবে। এই লক্ষ্যে এক হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন’ প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, প্রকল্পের মাধ্যমে একটি ইন্টার অপারেবল ভূমি উপাত্তভা-ার (ডাটাবেজ) তৈরি, ভূমি প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট সব জনবলকে আধুনিক ভূমি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সুদক্ষ করে তোলাসহ অনলাইন অফিস ব্যবস্থাপনা ও ইলেক্ট্রনিক রাজস্ব আদালত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হবে। ভূমি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সেবা, যেমন রেকর্ড সংশোধন/রেকর্ড হালনাগাদকরণ (সমন্বিত প্রক্রিয়ায় নামজারি, জমাভাগ ও জমা একত্রীকরণ); ভূমি উন্নয়ন কর; রেন্ট সার্টিফিকেট মামলা; ভূমি অধিগ্রহণ; খাসজমি বন্দোবস্ত (কৃষি-অকৃষি জমি, চা বাগানের মেয়াদী লিজ) করা হবে। ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটালাইজেশনের আওতায় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে সহজে নাগরিকদের কাছে পৌঁছানো হবে। চলতি সময় থেকে জুন ২০২৫ মেয়াদে প্রকল্পটি সারাদেশে বাস্তবায়ন করা হবে। একনেকে অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পগুলো হচ্ছে ৫৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নসহ নর্দমা ও ফুটপাথ নির্মাণ (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্প। এছাড়া ৪ হাজার ২৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের সড়ক অবকাঠামো ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার নির্মাণ ও উন্নয়ন-ফেজ-১, ২৭৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি, ৩ হাজার ২০ কোটি ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প, ১২১২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করার জন্য ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের ডিজিটাল জরিপ পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ, ১১৯৭ কোটি ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন, ২১৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুত সরবরাহ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্প এবং ৯৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা ব্যয়ে বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়ন, রংপুর জোন (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্প। সভায় আরও সংযুক্ত ছিলেন- কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা অংশ নেন। এছাড়া সভায় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, এসডিজি’র মুখ্য সমন্বয়ক, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সচিব এবং উর্ধতন কর্মকর্তারা ছিলেন।
×