ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আদালতের পরোয়ানা- যে কোন সময় গ্রেফতার

প্রতারক সাহেদ এখন ৫৬ মামলার আসামি

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ১৪ জুলাই ২০২০

প্রতারক সাহেদ এখন ৫৬ মামলার আসামি

শংকর কুমার দে ॥ রূপ কথাকেও হার মানায় রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম ওরফে মোঃ সাহেদের প্রতারণার কাহিনী। এক মামলা থেকে এখন তিনি ৫৬ মামলার আসামি। যে কোন সময়ে গ্রেফতার হতে পারেন শাহেদ। তার স্ত্রী সাদিয়া আরাবীও আছেন গোয়েন্দা নজরদারিতে। সাহেদকে গ্রেফতারে ইতোমধ্যে আদালত একটি পরোয়ানা জারি করেছে। প্রতারণা করে এক ব্যবসায়ীর সাড়ে ৩ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় সোমবার এই পরোয়ানা জারি করেন ঢাকার মহানগর হাকিম মাইনুল ইসলাম। এদিনই রাজধানীর উত্তরা এলাকার ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম মাসুদ মহানগর হাকিম আদালতে নালিশী মামলাটি দায়ের করেন। মামলার বাদী মাসুদ রাজধানীর কাওরান বাজারের মাসুদ এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। তার প্রতিষ্ঠান গৃহনির্মাণ সামগ্রী বিক্রি করে। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, সাহেদ বাদীর দোকান থেকে বিভিন্ন সময় রড ও সিমেন্টসহ বিভিন্ন মালামাল নিতেন। এক সময় তার অর্থমূল্য দাঁড়ায় ৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। কিন্তু বারবার চাওয়ার পরও ওই অর্থ দেননি সাহেদ। আদালত পুলিশের কর্মকর্তা এসআই জালালউদ্দিন বলেন, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মাসুদ দুটি মামলা করেন। আদালত মামলা দুটি আমলে নিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এদিকে দীর্ঘ ছয় দিনেও সাহেদ গ্রেফতার হননি। তবে সাহেদের অবস্থান শনাক্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। করোনাভাইরাসের ভুয়া রিপোর্ট প্রদানের একটি মাত্র অভিযোগের তদন্ত শুরু করে তার বিরুদ্ধে। একে একে বের হয়ে এসেছে তিনি ৫৬ মামলায় প্রতারণার আসামি। একদিনে এসব মামলা দায়ের হয়নি তার বিরুদ্ধে। তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ এসব মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পেয়েছে, সেই বিএনপির দুর্নীতির বরপুত্র তারেক রহমান, হাওয়া ভবন, যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর সঙ্গে রাজনৈতিক সখ্য স্থাপন করে ব্যবসার নামে তার প্রতারণার শুরুর পর্বটা। এমনকি ফকরুদ্দিন-মাঈনুদ্দিনের এক এগারোর সময়ে তারেক রহমানের ব্যবসায়ী পার্টনার খাম্বা মামুনের সঙ্গে দুই বছর জেল খাটার ঘটনা। প্রতারণার এসব ঘটনা আড়াল করে কৌশলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দলে ভিড়ে যায় সাহেদ। সরকারের সর্বোচ্চ মহলে সাহেদের এসব ঘটনা অবহিত করে গোয়েন্দা সংস্থা। সাহেদের এসব প্রতারণার গোয়েন্দা প্রতিবেদন পেয়ে তার হাসপাতাল সিলগালা করে তাকে গ্রেফতার করার অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদের প্রতারণার জাল কেবল স্বাস্থ্য খাত বা রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বছরের পর বছর ধরে যখন যে ক্ষমতাসীন ছিল তাদের সঙ্গে সখ্য করে দেশব্যাপী বিস্তৃত করেছে তার প্রতারণার জাল। সাহেদ যাতে দেশত্যাগ না করতে পারে সেজন্য নিষেধাজ্ঞা জারিসহ তার পাসপোর্ট জব্দ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রিজেন্ট হাসপাতালে র‌্যাবের অভিযানের পর গ্রেফতারদের মধ্যে রিমান্ডে থাকা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার হাসপাতালটিতে ও রিজেন্ট কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে তদন্তকারী দল। অভিযানকালে গুরুত্বপূর্ণ আলামতসহ পাসপোর্ট জব্দ করে তারা। র‌্যাবের অভিযানের সময়ে তদন্তকারী দলের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক অভিযান পরিচালনাকারী র‌্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেছেন, আগে জানতাম, সাহেদের নামে ৩২ মামলা রয়েছে। অভিযানের পর তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়। তবে এরপর নানা দিক থেকে তথ্য ও অভিযোগ আসতে থাকে। ভুক্তভোগীরা র‌্যাব ও থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। সব মিলিয়ে, সাহেদের বিরুদ্ধে ৫৬টি মামলা রয়েছে। এর অধিকাংশ মামলাই প্রতারণা ও ব্যবসায়িক জালিয়াতি সংক্রান্ত। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অপরাধ জগতের এই প্রতারক শাহেদ বহুমুখী প্রতারণা বাণিজ্য চালিয়ে যার আর বিভিন্ন টিভিতে মধ্যরাতের টাকার বিনিময়ে টকশোতে এসে নীতিবাক্য বলে নিজেকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচয় দেন। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে রাজনৈতিক সখ্য গড়ে তুলে প্রতারণার পর্বটা শুরু করেন সাহেদ। সখ্য গড়ে তোলেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে। তারেক রহমানের রাজনৈতিক কার্যালয় পরিচিত দুর্নীতি আখড়া অভিহিত বনানীর হাওয়া ভবনে শুরু হয় তার যাতায়াত। তারেক রহমানের সঙ্গে সখ্য গড়ার সুবাদে তার প্রতারণার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। পরিচয় হয় তারেক রহমানের বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সঙ্গেও। প্রতারণার ব্যবসায় শীর্ষে উঠে যান শাহেদ। তারেক-মামুনের সঙ্গে পরিচয় করার সুবাদে পরিচয় করতে সক্ষম হন বিএনপি-জামায়াতের মূল অর্থ যোগানদাতা, যুদ্ধাপরাধী, জামায়েতের শীর্ষ নেতা রাজাকার মীর কাশেম আলীর সঙ্গে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানের মীর কাশেম আলীর নানা ধরনের ব্যবসায় অংশীদার হয়ে যান শাহেদ। মীর কাশেম আলীর সঙ্গে ব্যবসায় যুক্ত হয়ে প্রতারণা শুরু করেন তিনি। যুদ্ধাপরাধে মীর কাশেম আলীর ফাঁসি হয়ে গেলে তার ব্যাবসায়িক পার্টনার হিসেবে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করে ফেলেন শাহেদ। এক-এগারোর সময়ে ফকরুদ্দিন-মাঈনুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারেক রহমানের বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে সে ২ বছর জেলও খাটেন শাহেদ। ২০১১ সালে ধানম-ির ১৫নং রোডে এমএলএম কোঃ বিডিএস ক্লিক ওয়ান এর ব্যবসা করেই সাধারণ মানুষের ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাত করে এই মোঃ সাহেদ করিম। আর সেখানে তার নাম ছিল মেজর ইফতেখার করিম চৌধুরী। কিন্তু গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে খাম্বা মামুনের সঙ্গে দুই বছর জেল খাটে তার বিরুদ্ধে ধানম-ি থানায় ২টি মামলা, বরিশালে ১ মামলা, বিডিএস কুরিয়ার সার্ভিস এ চাকরির নামে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রতারণার কারণে উত্তরা থানায় ৮টি মামলাসহ রাজধানীতে ৩২টি মামলা রয়েছে। এখন তদন্তে বের হয়ে এসেছে তার বিরুদ্ধে ৫৬টি মামলা রয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের সময়ে প্রতারণায় হাত পাকিয়ে সিদ্ধহস্ত বনে তার অপরাধী কার্যক্রম আড়াল করে আওয়ামী লীগর বনে গিয়ে টেলিভিশনের রাতের টকশোতে নীতিবাক্য শোনাতেন এই শাহেদ। গোয়েন্দা নজরদারিতে স্ত্রী সাদিয়া ॥ বিটিভির সংবাদ পাঠিকা ছিলেন সাদিয়া আরাবী রিম্মি। তার মা শাহিদা আরাবী বিটিভির প্রযোজক। ২০০৭ সালে সাদিয়ার মায়ের কাছে বাবা মারা যাওয়ার গল্প বলে সিমপ্যাথি আদায় করে সাদিয়াকে বিয়ে করে সাহেদ। আর সাদিয়ার দিক থেকে ছিল টাকার নেশা। আগের ঘরে একটি সন্তানও আছে সাদিয়ার। প্রথম স্বামী এক ব্যবসায়ী। সাদিয়া আবার বিয়ে করার পর প্রথম স্বামী গুলশানে প্রকাশ্যে সাহেদকে মারপিট করে রাস্তায় ফেলে চলে যায়। পরে তার বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। স্ত্রী সাদিয়া আরাবী রিম্মির সঙ্গে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ। রাজধানীর বনানী ডিওএইচএসের ৪ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাসার নিচতলায় স্ত্রী সাদিয়া আরাবী রিম্মি ও দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন সাহেদ। ৩ হাজার ৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ৯০ হাজার টাকা। সাইরেন বাজানোর হুটার লাগানো গাড়িতে দেহরক্ষী নিয়ে চলতেন শাহেদের স্ত্রী। শাহেদের পাপের টাকায় তিনি বিলাসী জীবনযাপন করতেন। কখনও এনজিও বস- কখনও বড় মাপের ঠিকাদার ॥ এইচএম এরশাদ কক্সবাজার থেকে জানান, রিজেন্ট হাসপাতালে সার্টিফিকেট প্রতারণা, পরের জমিতে লাগানো সাইনবোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নিজের জমি বলে চালিয়ে দেয়া বাটপার সাহেদের আরও বহু ভাওতাবাজির তথ্য বেরিয়ে আসছে। প্রতারক সাহেদ ২০ কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দে চারটি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের ঠিকাদার দাবি করে টেকনাফে আসেন। ২০১৮ সালে সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকল্পে মিলাদের আয়োজন করেছিল। সাহেদ ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ওইদিন টেকনাফ থানাধীন হোয়াইক্যং ফাঁড়ি থেকে পুলিশ এনেছিল। এছাড়া একটি এনজিওতে চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণা করে কক্সবাজারের বেকার শিক্ষিত যুবকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক লাখ টাকা। তদন্তে দুদক ॥ করোনাভাইরাসের ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রির দায়ে অভিযুক্ত রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোঃ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
×