ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রেফতারদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য

সুযোগ হলেই সশস্ত্র জিহাদের ডাক দেবে ‘আল্লাহর দল’

প্রকাশিত: ২২:০৪, ১১ জুলাই ২০২০

সুযোগ হলেই সশস্ত্র জিহাদের ডাক দেবে ‘আল্লাহর দল’

গাফফার খান চৌধুরী ॥ জঙ্গীবাদের ভয়াবহ উত্থান ঘটানোর চেষ্টা করছে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আল্লাহর দল। সম্প্রতি জঙ্গী সংগঠনটির বেশ কয়েকটি উইং নতুন করে কাজ শুরু করেছে। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার তথ্য ও তদন্ত সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা, তাদের জামিন করাতে অর্থ জোগাড়, আইনজীবী নিয়োগ করা, জেলখানার ভেতরে খোঁজখবর রাখা ও সর্বোপরি তদ্বির থেকে শুরু করে পূর্ণাঙ্গ জঙ্গী কার্যক্রম শুরু করেছে সংগঠনটি। গত ছয় মাসে জেএমবির সঙ্গে সিরিজ বোমা হামলায় অংশ নেয়া এ জঙ্গী সংগঠনটির শীর্ষ পর্যায়ের ২০ নেতা গ্রেফতারের পর বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। এমন তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিটের প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোঃ কামরুল আহসান। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, দীর্ঘদিন ধরেই জঙ্গী সংগঠনটি তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে। ইতোমধ্যেই অনেক আন্ডারকাভার অপারেশন চালানো হয়েছে। এসব অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে দলটির শীর্ষস্থানীয় ২০ নেতা। এদের দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে তাদের অর্থের উৎস সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করা হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে তৎপর থাকা আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের আদলে জঙ্গী সংগঠনটি তাদের ছক সাজিয়েছে। সে মোতাবেক তারা তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করছে। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত আছে। গ্রেফতারের ক্ষেত্রে কোন সংগঠন, দল বা অন্য কোন কিছুর প্রভাব দেখা হচ্ছে না। পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানও এমন তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেছেন। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, জঙ্গীদের গ্রেফতারে তাদের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত আছে। চলতি বছর এন্টি টেররিজম ইউনিট অভিযান চালিয়ে ২০ শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করে। যার মধ্যে রয়েছে খুলনা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের প্রধান। খুলনা, সাতক্ষীরা, সিলেট ও হবিগঞ্জ জেলার প্রধান এবং সিলেট মেট্রোপলিটন বিভাগের প্রধান। সর্বশেষ গত ২ জুলাই ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানার বেগুনবাড়ি এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন আল্লাহর দলের ঢাকা দক্ষিণের দাওয়াতি শাখার আমির মোঃ ফারুক শেখকে (৩৩)। তার কাছে পাওয়া যায় জঙ্গীবাদের বহু আলামত। যার মধ্যে শপথনামা ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন দলীয় কাগজপত্র। সে কেরানীগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত আমির লোটাস ও নাজমুলের মাধ্যমে জঙ্গী সংগঠনটিতে প্রবেশ করে। বর্তমানে ১০ বছর ধরে কাজ করছে। তার তথ্য মতে জঙ্গী সংগঠনটি বর্তমানে বহু উইং খুলেছে। ফারুক নিজেই একাধিক উইংয়ের হয়ে কাজ করছিল। তার প্রধান কাজগুলোর মধ্যে ছিল ধনী বা দরিদ্র তরুণ বা তরুণী, কিশোর বা কিশোরীদের দাওয়াতের মাধ্যমে দলে ভেড়ানো। দলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। গ্রেফতারকৃত সদস্যদের বিরুদ্ধে কোন থানায় মামলা হচ্ছে। দায়েরকৃত মামলায় কি কি অভিযোগ আনা হয়েছে তার তথ্য সংগ্রহ করা। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কাকে করা হয়েছে। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে নিখুঁত তথ্য সংগ্রহ করা। কবে কাকে কোন আদালতে সোপর্দ করা হচ্ছে। কারাগারে কোথায় রাখা হচ্ছে। সব খোঁজখবর রাখা। আদালতে গ্রেফতার সদস্যদের পক্ষে সমমনা বা যে আইনজীবী ধরলে জামিন করানো সম্ভব তাকে ম্যানেজ করা। প্রয়োজনে মতাদর্শের বাইরের আইনজীবীদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা। আদালতে ও কারাগারে গ্রেফতারদের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ রাখা। তাদের নানাভাবে সহযোগিতা করা। প্রয়োজনে তাদের জামিন করাতে রাষ্ট্র বা সরকারের বা আদালত পাড়ার বড় কাউকে দিয়ে তদ্বির করা। তার কাছে আল্লাহর দলের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত এবং তাদের সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বহু মামলার নথিপত্র পাওয়া গেছে। যেসব নথিপত্র পাওয়া গেছে, স্বাভাবিকভাবে তা পাওয়ার কথা নয়। গ্রেফতারকৃতরা এক পর্যায়ে স্বীকার করেছে, তাদের প্রায় সারাদেশেই নেটওয়ার্ক আছে। তারা নানাভাবে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। তবে ঠিক এই মুহূর্তে তাদের সশস্ত্র জিহাদ করার কোন পরিকল্পনা নেই। তারা নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে। সুযোগ হলেই সশস্ত্র জিহাদের ডাক দেবে। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক তারা আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনগুলোর আদলে তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। যা যথেষ্ট ভীতির কারণ। তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোন জঙ্গী সংগঠনের যোগাযোগ থাকার তথ্য মেলেনি। তবে তারা নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা আল কায়েদা, ইসলামিক স্টেট, তালেবান জঙ্গীদের অনুকরণ করে থাকে। আল্লাহর দলের বাইরেও নব্য জেএমবি, আনসার আল ইসলাম ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনের তৎপরতা আছে। র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল মোঃ সারওয়ার-বিন-কাশেম জনকণ্ঠকে জানান, দেশের সব বিভাগ ও জেলাতে জঙ্গী সংগঠনটির কার্যক্রম রয়েছে। থানা পর্যায়েও তারা কার্যক্রম শুরুর চেষ্টা করছে। পঁচিশ বছর ধরে জঙ্গী সংগঠনটি তৎপর থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বািহনীর তৎপরতার কারণে বড় ধরনের কোন নাশকতার ঘটনা ঘটাতে পারেনি। তারা জেএমবির স্টাইলে কাজ করছে। তাদের গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে। সারাদেশে সশস্ত্র হামলা চালাতে ছোট ছোট সুইসাইডাল সামরিক স্কোয়াড গড়ে তুলছে। সংগঠনটির যোগাযোগ, প্রযুক্তি, সামরিক, প্রশিক্ষণ ও দাওয়াতিসহ বেশ কয়েকটি উইং নতুন করে কাজ শুরু করেছে। হামলাকারী বা সুইসাইডাল স্কোয়াড বা সশস্ত্র ইউনিটগুলোকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে জঙ্গী সংগঠনটিতে যোগ দেয়া বিভিন্ন বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরা। ভবিষ্যতে সংগঠনটি জেএমবির মতো বড় ধরনের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিভিন্ন ব্যাংকে বেনামে সংগঠনটির বিশটি এ্যাকাউন্টে কোটি টাকারও বেশি অর্থ গচ্ছিত থাকার তথ্য মিলেছে। এসব এ্যাকাউন্ট জব্দ করতে এবং এ্যাকাউন্টগুলোতে লেনদেন বন্ধ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। সংগঠনটিকে নানাভাবে সহযোগিতা করছে স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। জঙ্গী সংগঠনটির গোড়াপত্তন হয় ১৯৯৫ সালে। জঙ্গী মতিন মেহেদী ওরফে মুমিনুল ইসলাম ওরফে মহিত মাহবুব ওরফে মেহেদী হাসান ওরফে মতিনুল হকের নেতৃত্বে জঙ্গী সংগঠনটি গঠিত হয়। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবির সঙ্গে সারাদেশের ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) সিরিজ বোমা হামলায় অংশ নিয়েছিল জঙ্গী সংগঠনটি। পরবর্তীতে জেএমবি নিষিদ্ধ হলে তারা আলাদা হয়ে যায়। ২০০৭ সালে আল্লাহর দলের প্রধান মতিন মেহেদী গ্রেফতার হয়। এরপর থেকেই তার অনুসারীরা জঙ্গী সংগঠনটিকে পুনরায় সংগঠিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। পাশাপাশি মতিন মেহেদীকে ছাড়িয়ে নেয়ার বা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। জঙ্গী সংগঠনটির প্রধান টার্গেট পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় চাকরিচ্যুত সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা। সশরীরে যোগাযোগের মাধ্যমে সনাতন পদ্ধতিতে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। সারাদেশে মারাত্মক নাশকতা চালিয়ে সরকার উৎখাত করাই তাদের প্রধান টার্গেট। দেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে তারা তৎপরতা চালাচ্ছে।
×