ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসা প্রতারক সাহেদের উত্থান বিস্ময়কর

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ৯ জুলাই ২০২০

চিকিৎসা প্রতারক সাহেদের উত্থান বিস্ময়কর

আজাদ সুলায়মান ॥ রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারিত রোগীরা এখন র‌্যাবের কাছ থেকে নিশ্চিত হতে চাচ্ছেন তাদের রিপোর্ট ভুয়া নাকি আসল। গত দুদিনে তিন সহ¯্রাধিক ভিকটিম ফোনে জানতে চেয়েছেন- তাদের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে। এই হাসপাতালে যারা করোনা উপসর্গ নিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিয়েছেন- তারা এখন চরম আতঙ্কে আছেন। র‌্যাব জানিয়েছে, তাদের কাছে ৬ হাজার রোগীর রিপোর্ট রয়েছে। সেগুলো এখন যাচাই করে দেখা হচ্ছে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার মূল হোতা রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ রাজধানীতেই ঘাপটি মেরে আছেন। তিনি যে কোন সময় গ্রেফতার হতে পারেন বলে জানিয়েছেন র‌্যাব গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাসেম। গতকাল বুধবার তিনি নিশ্চিত করেছেন- সাহেদ কিছুতেই দেশত্যাগ করতে সক্ষম হবে না। সে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। তাকে ধরতে একাধিক বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। গত পরশু উত্তরার অভিযানের সময় করোনার চিকিৎসার নামে নকল সনদ বাণিজ্য ও রোগীর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে হাসপাতালটি সিলগালা করা হয়। টনক নড়ার পর স্বাস্থ্য অধিদফতরও হাসপাতালটির সার্বিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। বুধবার সকালে হাসপাতালের সামনে গিয়ে বেশ ক’জন ভুক্তভোগী রোগীকে অশালীন ভাষায় সাহেদকে গালিগালাজ করতে শোনা যায়। র‌্যাবের তদন্তেও বেরিয়ে আসছে শাহেদের বিস্ময়কর উত্থানের কাহিনী। করোনা মহামারীর সুযোগে সাহেদ নিজেকে স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম মাফিয়া হিসেবে গড়ে তোলার নেপথ্যে সবটাই ছিল নিপুণ প্রতারণার কৌশল। ভুক্তভোগীরা তাদের প্রতারিত হওয়ার অসংখ্য অভিযোগ র‌্যাব সদর দফতরে জানাচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে ফোনের পর ফোন রিসিভ করতে হচ্ছে র‌্যাবকে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় চেয়ারম্যানসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করা হয়। মামলা নম্বর-৫। উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তপন চন্দ্র সাহা জানান, করোনা টেস্ট না করে রোগীদের জাল রিপোর্ট দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে র‌্যাব মামলা করেছে। প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার আসামিরা হলো হাসপাতালের এডমিন আহসান হাবীব (৪৫), এক্সরে টেকনিশিয়ান হাসান (৪৯), মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট হাকিম আলী (২৫), রিসিপশনিস্ট কামরুল ইসলাম (৩৫), প্রজেক্ট এডমিন রাকিবুল ইসলাম (৩৯), এইচআর এডমিন অমিত অনিক (৩৩), গাড়িচালক আব্দুস সালাম (২৫), এক্সিকিউটিভ অফিসার আব্দুর রশীদ খান জুয়েল (২৮), প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোঃ সাহেদ (৪৩), ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসুদ পারভেজ (৪০), হাসপাতাল কর্মচারী তরিকুল ইসলাম (৩৩), স্টাফ আব্দুর রশিদ খান (২৯), স্টাফ শিমুল পারভেজ (২৫), কর্মচারী দীপায়ন বসু (৩২) এবং মাহবুব (৩৮)। অপর দু’জনের নাম জানা যায়নি। ১৭ আসামির মধ্যে এমডি মাসুদ পারভেজসহ আট জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে রিজেন্ট চেয়ারম্যান সাহেদসহ ৯ জন পলাতক রয়েছেন। তাদের গ্রেফতারে র‌্যাবের অভিযান চলছে। গ্রেফতারকৃতদের ৮ দিনের রিমান্ড চাইবে পুলিশ। এদিকে সাহেদকে আটকের বিষয়ে লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাসেম জানান, তিনি যে কোন সময় গ্রেফতার হয়ে যেতে পারেন। তার পালিয়ে থাকার কোন সুযোগ নেই। বিদেশেও যেতে পারবেন না। কেননা তিনি এত মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন যে, চাইলেও দেশ ত্যাগ করার সুযোগ পাবেন না। সাধারণ মানুষই তাকে ধরে ফেলতে পারবে। তার পক্ষে বেশি সময় আত্মগোপন করাও সম্ভব হবে না বলে নিশ্চিত করেন সারোয়ার বিন কাসেম। তিনি জানিয়েছেন, করোনার নমুনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার নামে প্রতারণা করায় রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোঃ সাহেদকে ধরতে মাঠে রয়েছে র‌্যাব। র‌্যাব ছাড়াও অন্যান্য বাহিনী সতর্ক থাকায় তিনি দেশ ছেড়ে পালাতে পারবেন না। শীঘ্রই তাকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, দুই রাত ধরেই তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন জায়গায় আমরা খোঁজ করছি। বলে রাখতে চাই, তিনি অবশ্যই ধরাছোঁয়ার বাইরে নন। কারণ কেউ ধরাছোঁয়ার বাইরে নন। যারাই আইনের উর্ধে যাওয়ার চেষ্টা করবে অবশ্যই তাকে আমরা আইনের আওতায় আনতে সক্ষম। তার বিষয়ে অন্যান্য সংস্থাও সতর্ক। অভিযানের পরই সে গাঢাকা দিয়েছেন। মঙ্গলবার রাতেও আমরা বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়েছি। সাহেদের মোবাইল নম্বর বন্ধ। প্রথম দিন দেখেছিলাম ফেসবুকে এ্যাক্টিভ ছিলেন, কিন্তু এখন তিনি সবকিছু থেকেই নিষ্ক্রিয়। তবে আশা করছি দ্রুত তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হবো। তিনি বলেন, করোনাকে ঘিরে আমরা নানা অপতৎপরতা দেখেছি। শুরু থেকেই ভুয়া হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ব্যবহৃত গ্লাভস-মাস্ক বিক্রির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছি। বিভিন্ন ভুক্তভোগীর মাধ্যমে জানতে পারি, কিছু হাসপাতাল করোনা টেস্টকে ঘিরে নৈরাজ্য শুরু করেছে। ব্যক্তি পর্যায় থেকেই অনুসন্ধানের কাজ শুরু করেছিলাম। রিজেন্ট হাসপাতাল হোম ডেলিভারির মতো বাসায় গিয়ে করোনার নমুনা সংগ্রহ করে দ্রুততার সঙ্গে রিপোর্ট সরবরাহ করছিল। প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে আমরা গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছি। এরপর কেঁচো খুঁড়তে সাপ নয়, এনাকোন্ডা বের করে আনতে সক্ষম হই। দুদিন ধরে রিজেন্টের বিরুদ্ধে আমরা ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করছি। তাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, তারা নমুনা নিয়ে টেস্টের সঠিক রিপোর্ট পাঠায় না। প্রায় সাড়ে চার হাজার নমুনার টেস্ট না করেই কম্পিউটার অপারেটর মনগড়া রিপোর্ট দিয়ে সরবরাহ করেছে। ফলে বুঝে না বুঝে অনেকেই ভুয়া পজিটিভ হয়ে কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছেন। তারা প্রথমবার টেস্টে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা নিতেন পরবর্তী টেস্টের জন্য আবার এক থেকে দেড় হাজার টাকা আদায় করতেন। র‌্যাব গোয়েন্দা প্রধান আরও বলেন, সরকারের সঙ্গে বিনামূল্যে চিকিৎসার চুক্তি স্বাক্ষরের নামে আসলে হঠকারিতা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তারা রোগীদের মোটা অঙ্কের বিল দিতে বাধ্য করেছে। রিজেন্টের কম্পিউটার অপারেটর আমাদের বলেছে, চেয়ারম্যান নিজে ব্যক্তিগতভাবে এসব করিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি তিন মাসে প্রায় আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা নিয়েছে। সেসব টাকা কোথায় গেছে তা খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজনে তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হবে। সাহেদের বিষয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে তার নানা অপকর্মের কথা জানতে পেরেছি। বিভিন্ন সময় তিনি প্রতারণার দায়ে আটক হয়েছিলেন, জেলও খেটেছেন। মিথ্যাকে কেন্দ্র করেই তার উত্থান। ভুয়া পরিচয় দিয়ে নানাভাবে প্রতারণা করেছেন মানুষের সঙ্গে। তিনি একটা এমএলএম কোম্পানি খুলে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন, যার জন্য জেলও খেটেছেন। আমরা জানতে পারছি তার আরও অনেক নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে লাইসেন্সও নেয়া হয়নি। উল্লেখ করতে চাই, প্রতিদিন নানা জায়গা থেকে অসংখ্য ফোন রিসিভ করছি, তারা সাহেদের অপকর্ম-অরাজকতার বিষয়ে জানাচ্ছে। তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তোলাকে কেন্দ্র করেই তিনি প্রতারণা করতেন। প্রতারণার জন্যই ছবিগুলো তুলেছে বলে তদন্তে এসেছে। জানা গেছে, তার এই উত্থানের বিষয়ে এলাকাবাসীও হতবাক। অবশ্য এলাকাতেও তাকে সবাই প্রতারক সাহেদ হিসেবেই চেনে। মঙ্গেলবার রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর সাহেদের অপকর্ম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। র‌্যাব জানিয়েছে, মূলত শুধু প্রতারণার মাধ্যমেই তার বিস্ময়কর উত্থান ঘটে । একসময় মাল্টিলেভেল মার্কেটিং ব্যবসা করে গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। প্রতারণা মামলায় জেলও খেটেছিলেন। ২০১১ সালে দুবছর জেল খাটার পর তিনি বের হয়ে আসেন। তার বিরুদ্ধে অন্তত ৩৩টি মামলা রয়েছে। তারপরও তাকে ধরার সাহস করেনি কোন সংস্থা। কারণ তিনি নিজেকে কখনও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, কখনও গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ঠ, আবার কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংশ্লিষ্ট বলে পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন। নিজেকে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জাহির করে অর্থের বিনিময়ে টকশোতে অংশ নিতে শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি রিজেন্ট হাসপাতালের কর্ণধার মোঃ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের। তার একাধিক নাম রয়েছে। প্রতারণর অন্যতম উপায় ছিল কৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তোলা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্পন্সর সহযোগিতা করে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতেন। এসব কিছু কাজে লাগাতেন নিজের স্বার্থে। অফিস, হাসপাতাল বা বাসা সবখানেই সরকারের ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্র্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তোলা ছবি বাঁধাই করে টাঙিয়ে রাখতেন। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে হুমকি দিতেন পুলিশের কর্মকর্তাদের নামে। চার-পাঁচ বছর ধরে নিজেকে কথিত বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি। সেন্টার ফর পলিটিক্যাল রিসার্চ বা রাজনীতি গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠানও চালাতেন তিনি। এজন্য অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন টকশোতে অংশ নিতেন। টকশোতে বিরোধী রাজনীতিকদের বিষয়ে তুলোধুনা করা এই সাহেদ ছিলেন হাওয়া ভবনের গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের ঘনিষ্ঠ। সে সময় কয়েকটি পত্রিকায় মামুনের ঘনিষ্ঠতার ছবিও তিনি ছাপার ব্যবস্থা করেন। সাহেদের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইলে র‌্যাব গোয়েন্দা প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ার বিন কাসেম জানান, তার কোন রাজনৈতিক পরিচয় নেই। যখন যার নাম ভাঙ্গানোর দরকার তখন তারই সঙ্গে সখ্য গড়ে, অত্যন্ত সুকৌশলে প্রতারণা ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে ফায়দা লুটেছে। এর বাইরে তার কোন পরিচয় নেই। তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে র‌্যাব অফিসে বিপুলসংখ্যক ভুক্তভোগী ফোন করে তাদের প্রতারিত হওয়ার কাহিনী ফাঁস করছেন এবং করোনার সনদটি নকল নাকি আসল নিশ্চিত হতে চাচেছন। ৫ সদস্যের একটি পরিবারের সবাই এই রিজেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসা করতে গিয়ে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করেন। রিজেন্টের স্টাফ পলাশের মাধ্যমে এ টাকা গ্রহণ করেন সাহেদ। এভাবে চার হাজারেরও বেশি লোকÑ যারা করোনার চিকিৎসা নিতে আসেন, তাদের নকল সনদ দেয়া হয়। এতে অনেকেই রোগী না হয়েও বাসায় ১৪ দিন আইসোলেশনে কাটান। আবার রোগী হয়ে অনেকে ঘুরে বেড়ান। যা ছিল খুবই ভয়ঙ্কর ব্যাপার। এসব লোক এখন ফোন করে জানতে চান তাদের রিপোর্ট সত্য না মিথ্যা। দুর্ধর্ষ এই প্রতারক সাহেদের বাড়ি সাতক্ষীরায়। গরিব ঘরের সাহেদের উত্থান ছিল বিস্ময়কর। শুধু প্রতারণায় স্বল্প সময়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এখন বিভিন্ন টিভিতে মধ্যরাতের টকশোতে এসে নীতিবাক্য বলে নিজেকে বুদ্ধিজীবী বলে পরিচয় দেন। বর্তমানে মোঃ সাহেদ হিসেবে পরিচয় দিলেও তার আসল নাম মোঃ সাহেদ করিম। পিতা সিরাজুল করিম, মাতা মৃত সুফিয়া করিম। শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি। তার মা মৃত্যুবরণ করেন ৬ নবেম্বর ২০১০ সালে। তিনি কখনও কখনও মেজর ইফতেকার আহম্মেদ চৌধুরী, কর্নেল ইফতেকার আহম্মেদ চৌধুরী, কখনও মেজর সাহেদ করিম হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। তার আসল নাম জাতীয় পরিচয়পত্রে সাহেদ করিম লেখা। বর্তমানে তিনি মোঃ সাহেদ নামে আরেকজাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করছেন যার নাম্বার হলো : ২৬৯২৬১৮১৪৫৮৮৫। আর এ জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া হয় ২৫-৮-২০০৮। কিন্তু তাতে তার মা মারা গেছে লেখা রয়েছে, অথচ তার মা মৃত্যুবরণ করেন ৬ নবেম্বর ২০১০ সাল। তাতেই প্রমাণ হয় এটাও ভুয়া। ঠিকানা হরনাথ ঘোষ রোড, লালবাগ, ঢাকা-১২১১ রয়েছে। গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলায়। এক নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও প্রতারণা বাটপারি করে আজ শত শত কোটি টাকার মালিক। বিএনপি সরকারের আমলে রাজাকার মীর কাসেম আলী ও গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তাদের মাধ্যমে তারেক জিয়ার হাওয়া ভবনের অন্যতম কর্তাব্যক্ত হয়ে উঠেন তিনি। ১/১১ ফকরুদ্দন সরকারের সময় খাম্বা মামুনের সঙ্গে তিনি ২ বছর জেলও খাটেন। জেল থেকে বের হয়ে সাহেদ ২০১১ সালে ধানম-ির ১৫নং রোডে এমএলএম কোম্পানি বিডিএস ক্লিক ওয়ান নাম বাটপারি ব্যবসা প্রষ্ঠান খুলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাত করেন। সে সময় তার নাম ছিল মেজর ইফতেকার করিম চৌধুরী। নিরীহ মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রতারণার দায়ে উত্তরা থানায় ৮টি মামলাসহ রাজধানীতে ৩৩টি মামলা রয়েছে। অন্যদিকে তিনি মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক বিমানবন্দর শাখা থেকে ৩ কোটি টাকা লোন নেন। সেখানে তিনি নিজেকে কর্নেল (অব.) পরিচয় দিয়ে কাগজপত্র দাখিল করেন। ওই ঘটনায় আদালতে ২টি মামলা বিচারাধীন। সাহেদ প্রকাশ্যে অনেক প্রভাবশালীর নাম ব্যবহার করেই মানুষকে হুমকি-ধমকি দিয়ে থাকেন। তার গাড়িতে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড ও সাইরেনযুক্ত হর্ন ব্যবহার করে। তিনি নিজেকে কখনও মেজর, কর্নেল, সচিব পরিচয় দিতেন। এভাবেই তিনি উত্তরা ১১নং সেক্টরের ১৭নং রোড, বাড়ি নং-৩৮-এ হাসপাতাল করেন। মূলত করোনার মহামারী তার জীবনে বড় আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। হাজার হাজার রোগীর নকল করোনা সনদ ও চিকিৎসা দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এছাড়াও প্রতারণার টাকায় তিনি উত্তরা পশ্চম থানার পাশে গড়ে তুলেছেন রিজেন্ট কলেজ ও ইউনিভার্সিটি, আরকেসিএস মাইক্রোক্রেডিট ও কর্মসংস্থান সোসাইটি। যদিও এর একটিরও কোন বৈধ লাইসেন্স নেই। আর অনুমোদনহীন আরকেসিএস মাইক্রোক্রেডিট ও কর্মসংস্থান সোসাইটির ১২টি শাখা করে হাজার হাজার সদস্যদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। এর আগেও তিনি উত্তরাস্থ ৪, ৭ ও ১৩ নম্বর সেক্টরে ভুয়া শিপিংয়ের ব্যবসা করেছেন সেই ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে মেরে দিয়েছে। বর্তমানে তার ভিজিটিং কার্ডে তিনি রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান প দেন। কিছুদিন আগে তিনি একঅস্ত্রের লাইসেন্সও নিয়েছেন। অথচ অস্ত্রের লাইসেন্স করতে বার্ষিক ন্যূনতম ৩ লাখ টাকা ইনকাম ট্যাক্স দেয়া লাগে। যদিও তিনি কোনদিনও ইনকাম ট্যাক্স দেন না। তার প্রতারণা সম্পর্কে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় ১১-১২-২০১৪ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সাহেদের কয়েকগাড়ি রয়েছে যেগুলোর কোন বৈধ কাগজপত্র নেই। তার গাড়িতে ভিফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড, অবৈধ ওয়ারল্যাস সেট আর অস্ত্রসহ ৩ জন বডিগার্ড থাকার কারণে সাধারণত পুলিশ তার গাড়ি থামাবার সাহস পায় না। তার অফিসে লাঠিসোটা রাখা হয়। এমনকি তার অফিসের ভেতরে একটি টর্চার শেলও রয়েছে। কোন পাওনাদার টাকা চাইতে আসলে পাওনাদারদের সেখানে টর্চার করা হয়। পুলিশ ও র‌্যাব জানিয়েছে- তার বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা রয়েছে দেশের বিভিন্ন থানায়। এর মধ্যে ধানমন্ডি, মিরপুর, উত্তরায় বেশি সেগুলোর কয়েকমামলার নং-বাড্ডা-৩৭(৭)০৯, আদাবর-১৪(৭)০৯, লালবাগ-৪৭(৫)০৯, উত্তরা ২০(৭)০৯, উত্তরা১৬(৭)০৯, উত্তরা ৫৬(৫)০৯, উত্তরা ১৫(৭)০৯, ৩০(৭)০৯, ২৫(৯)০৯, ৪৯(০৯)০৯, ১০(৮)০৯ সব মামলা ৪২০ ধারায়। তার প্রতিষ্ঠান রিজেন্ট কেসিএস লিঃ ইউসিবি ব্যাংক উত্তরা শাখায় এ্যাডকাউন্ট নং-০৮৩২১০১০০০০১০০০৩, রিজেন্ট হাসপাতাল লিঃ ইউসিবি ব্যাংক উত্তরা শাখায় এ্যাকাউন্ট নং-০৮৩১১০১০০০০০০৬১৬,সহ ব্র্যাক ব্যাংক উত্তরাসহ বিভিন্ন ব্যাংকে শত শত কোটি রয়েছে। এত সব মামলা থাকার পরও সাহেদ ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তারা। গত সোমবার র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। তারপরই ফাঁস হতে থাকে সাহেদের বিস্ময়কর সব কাহিনী। ৭ জনের ৫দিনের রিমান্ড ॥ এ মামলায় গ্রেফতার ৭ জনের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। বুধবার তাদের সাতজনকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ। উত্তরা পশ্চিম থানায় তাদের বিরুদ্ধে করা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওই থানার পরিদর্শক আলমগীর গাজী। শুনানি শেষ ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াসির আহসান চৌধুরী প্রত্যেকের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তারা হলেন- রিজেন্ট হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আহসান হাবীব (১), হেলথ টেকনিশিয়ান আহসান হাবীব (২), হেলথ টেকনোলজিস্ট হাতিম আলী, রিজেন্ট গ্রুপের প্রকল্প প্রশাসক মোঃ রাকিবুল ইসলাম, রিজেন্ট গ্রুপের মানবসম্পদ কর্মকর্তা অমিত বণিক, রিজেন্ট গ্রুপের গাড়িচালক আবদুস সালাম ও হাসপাতালের কর্মী আবদুর রশিদ খান জুয়েল। অন্যদিকে রিজেন্ট হাসপাতালের অভ্যর্থনাকারী কামরুল ইসলাম নামে এক আসামি শিশু হওয়ায় তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াসির আহসান চৌধুরী তাকে গাজীপুরের কিশোর সংশোধনীতে পাঠানোর আদেশ দেন। করোনা পরীক্ষার জন্য আসা রোগীদের বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহ করানোর কথা থাকলেও টাকা নেয়া এবং নমুনার অর্ধেকের বেশি পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট দেয়াসহ রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনেক অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। সেসব ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গ্রেফতারদের সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়।
×