ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা উপাখ্যান

প্রকাশিত: ২০:০১, ৮ জুলাই ২০২০

করোনা উপাখ্যান

আমাদের দেশে অনেক মানুষ আছেন যারা করোনা ও করুণাকে পৃথক করে দেখছেন না। এ কথা অফিশিয়াল রেকর্ডে স্থান না পেলেও উচ্চারণে স্পষ্ট। তবে মনে হচ্ছে করোনা রফতানিকারক দেশ আমাদের জন্য কিছুটা করুণাই করেছে। তারা ঠিক আমাদের ২ কি ৩ নম্বর পাঠিয়েছে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছে এক নম্বর! ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশের মৃতের সংখ্যা এখনও যেখানে দুই হাজারে ছাড়ায়নি, সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা এক লক্ষ ত্রিশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ২ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে এখনও শ্রেষ্ঠ সে প্রমাণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট রেখেছেন। সম্প্রতি ৪টি রাজ্যে লকডাউন ঘোষণা ছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট বরং করোনার প্রতি এক ধরনের ল-পরোয়া ভাব দেখিয়ে আসছেন। তবে বিনে পয়সায় পাওয়া করোনার মূল্য পরিশোধ করছে চীনা দ্রব্যাদি আমদানি সংকোচনের মাধ্যমে। ইতোমধ্যে করোনা চিহ্নিত হয়েছে নতুন নামে। তাই তার নাম হয়েছে কোভিড-১৯। অনেকে এই নামটা নিয়ে তামাশা করেছে। কোভিড এখন বিশ্বময়। পৃথিবীর ২১৩টি দেশে তার প্রাদুর্ভাব লক্ষণীয়। কোথাও বাড়ছে, কোথাও কমছে, কোথাও আবার কমে গিয়ে নতুন করে বাড়ছে। একমাত্র ভিয়েতনাম ছাড়া আর কোন দেশ প্রায় শূন্য করোনায় আক্রান্ত, তা বলা যাচ্ছে না। হংকং, তাইওয়ান, নেপাল, ভুটান, বার্মা, থাইল্যান্ডের অবস্থাও ভাল। ব্রাজিল হাবুডুবু খাচ্ছে বেশি। দেশে দেশে হাহাকারের জন্ম দিয়েছে করোনা। তার জীবন বৃত্তান্ত বিশ্লেষণের হিড়িক পড়েছে। হিড়িক পড়েছে ভ্যাকসিন ও উচ্চ প্রতিষেধক আবিষ্কারের। প্রথমেই জেনোম বিশ্লেষণ নিয়ে কথা বলছি। ক্যান্সার আক্রান্ত উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে যশোর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনার জীবন বৃত্তান্ত বা চক্র উন্মোচন করেছে। তবে তারা এর লিঙ্গ চিহ্নিত করতে পেরেছে কিনা জানি না। মৃত ও আক্রান্তদের সংখ্যা বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে পুরুষরাই করোনার শিকার বেশি হচ্ছে। তাই মনে হচ্ছে করোনায় নারীদের সংখ্যা বেশি কিংবা সংখ্যা ৫০:৫০ হলেও নারী করোনা প্রবল পুরুষ বিদ্বেষী। সহসা এ বিদ্বেষ প্রশমিত হবে তা বলা যাচ্ছে না। করোনা এ যাবত নাকি নয়বার রূপ ও প্রকৃতি বদলিয়েছে। অর্থাৎ তার চরিত্র নিয়ে কথা উঠছে। চরিত্রহীন বলেও তার অপবাদ শীঘ্রই উঠবে। তাকে সামাল দেয়ার এক ধরনের ওষুধ বা ভ্যাকসিন বাজারে আসার আগেই হয়তো এই নয় ধরনের করোনা যে নিরানব্বই ধরনে রূপান্তরিত হবে না, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তাই লকডাউনের বিরোধী ও পক্ষীয়দের অনেকেই বলছে আগামী বছরের মার্চ মাসের আগে এর প্রতিষেধক হচ্ছে লকডাউন। এরই মাঝে জীবন-জীবিকার কি হবে? করোনায় যত লোক মারা যাচ্ছে, কোন কোন দেশে সড়ক দূর্ঘটনায় এবং কোন কোন দেশে না খেয়ে মরা মানুষের সংখ্যা তার চেয়ে কম নয়। এমতাবস্থায় জীবন ও জীবিকা নিয়ে একটা ভারসাম্য অবস্থার কারণে আমরা কখনও ঘরমুখী ও কখনও বহির্মুখী হচ্ছি, সময় ও সুযোগ পেলে গ্রামে যাচ্ছি, আবার ফিরে আসছি, আবারও যাচ্ছি। এরই মধ্যে সন্দেহ জেগেছে করোনা কি ভাইরাস না ব্যাকটেরিয়া! ভাইরাস হলে এক ধরনের চিকিৎসা এবং ব্যাকটেরিয়া হলে ভিন্ন চিকিৎসা-এ কথা আমার মতো অবুঝ মানুষও জানে। তা হলে এদ্দিনের করোনার চিকিৎসার এই প্রয়াস কি ব্যর্থ হবে? আমাদের দেশের এক সোনার ছেলেও করোনাভাইরাসের প্রতিরোধক ও প্রতিষেধক হয়ত পেয়ে যাবে। কিন্তু তার পরও যদি করোনা তার মৌলিক চরিত্রই যদি বদলিয়ে ফেলে কিংবা দুর্বল চরিত্র নিয়ে আবির্ভূত হয়, তখন অনেক পরিশ্রম বৃথা যাবে। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে, এখন দেশে প্রায় শতভাগ মানুষই ডাক্তার। এ কথা নাকি গোপাল ভাঁড় রাজদরবারে বহু বছর আগে বলেই বিপদে পড়েছিল। গল্পে আছে গোপাল ভাঁড় একবার রাজ দরবারে সাড়ম্বরে ঘোষণা করল যে, দেশে প্রতিটি মানুষই ডাক্তার। কথাটি শোনামাত্র রাজা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন এবং প্রমাণ না করতে পারলে গোপাল ভাঁড়ের জীবন যাবে বলে ঘোষণা দিলেন। রাজার নির্মোহ সমর্থনে জোরেজোরে আওয়াজ তুললেন রাজমন্ত্রী ও রাজণ্যবর্গ। গোপাল ভাঁড়কে সাত দিনের সময় দেয়া হলো। শুনেই গোপাল ভাঁড় উধাও। খোঁজ নিতে রাজাদেশ জারি হলো। জানা গেল গোপাল অসুস্থ। ৭ দিনের মাথায় গায়ে চাদর জড়িয়ে গোপাল ভাঁড় রাজদরবারে হাজির হলেন। অসুস্থতা হেতু জিহ্বা জড়িয়ে কথা বললেন। রাজা মশায় প্রথমে বললেন, ‘গোপাল, তোমার কি হয়েছে’? তখন তো আর করোনা ছিল না, তাই গোপাল ভাঁড় ম্যালেরিয়া, কালাজ¦র বা এই জাতীয় কিছু হয়েছে বলা শেষ করার আগেই রাজা বললেন, ‘দেখি গোপাল ভাঁড়, তোমার গায়ে জ¦র তো আছে, নাড়ির স্পন্দনও বেশি, তা তুমি কি ডাক্তার দেখিয়েছ?’ গোপাল ভাঁড় না-সূচক জবাব দেয়া মাত্র রাজা তাকে তৎকালে প্রাপ্য আধাডজন ওষুধ সেবনের পরামর্শ দিলেন। রাজার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী অতি বিচক্ষণ নির্ণয় প্রণালী প্রয়োগ করে রাজার অনুরূপ না হলেও প্রায় ভিন্ন জাতীয় ওষুধ সেবন ও সাবধানতা অবলম্বনের নির্দেশ দিলেন। তারপর রাজ দরবারের একের পর একজন গোপাল ভাঁড়ের পরামর্শক বনে গেলেন। গোপাল ভাঁড় স্মিত হেসে দেহটাকে ঋজু করে দাঁড়ালেন আর গা থেকে চাদরটা ছুড়ে ফেলে রাজাকে প্রশ্ন করলেন, ‘রাজা মশায় আমি প্রমাণ করতে পারলাম যে অন্তত রাজদরবারের সবাই ডাক্তার? দরবারের সবাই যদি ডাক্তার হয়ে যান, তাহলে সাধারণ মানুষ যে এক একজন ডাক্তার তাও আমি প্রমাণ করতে পারব। নিমীলিত চোখে রাজা বললেন। ‘তুমিই ঠিক, আমরা সবাই কমবেশ ডাক্তারই, অতএব তোমার গর্দান তো রক্ষা পেলই, তদুপরি তোমার বুদ্ধির তারিফ হিসেবে এক ব্যাগ স্বর্ণমোহর দেয়া হলো।’ করোনা আসার পর এমন অভিজ্ঞতা কার না হয়েছে? আমি যাকেই টেলিফোন করেছি, তিনি আমাকে এমন সব প্রশ্ন করেছেন যাতে মনে হয়েছে পেশাদার চিকিৎসকের মতো প্রশ্নগুলো তিনি করেছেন এবং এ ব্যাপারে যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা পেশাদার চিকিৎসকের মতোই বটে। করোনার সুযোগ নিয়ে সবাই পত্রিকা কিংবা ব্যক্তিগত পত্রিকা মানে ফেসবুক থেকে তথ্য জেনে নিয়েছেন। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে তারা বন্ধুবর ডাক্তার এ বি এম আবদুল্লাহ কিংবা প্রাণ গোপাল দত্ত বা ডাক্তার মাইনুল আহসানকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। করোনা আবার প্রমাণ করল যে, দেশের শতভাগ না হলেও বৃহদাংশ মানুষই ডাক্তার। করোনার সুযোগ নিয়ে ম্যানেজমেন্ট বা ব্যবস্থাপনার নতুন সংজ্ঞা বের করেছি। আর আবিষ্কার করলাম যে, দেশে ম্যানেজার বা ব্যবস্থাপক ও প্রফেসরের সংখ্যা একবারে কম নয়। সময় ও সুযোগ পেলে আর একবার সবাইকে জানব। তবে করোনা নিয়ে শেষ কথা হলো, করোনা এক ধরনের ভয়ঙ্কর মেহমান। তাকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে না পারলে তার সঙ্গে সহবাস করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো যে এই সকালেই জানলাম যে, এক ধরনের করোনা আসছে যা হবে বন্ধুপ্রতিম। তার জন্যও যখন ভ্যাকসিন বা ওষুধ আবিষ্কৃত হয়ে যাবে করোনা তখন হয়তো আর্তস্বরে গাইবে, বন্ধু হতে এসেছিলাম, শত্রু বলে গণ্য হলাম, একটা কিছু হয়েছি তাতে আমি ধন্য হলাম। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
×