ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ ফারুক হোসেন

অনাকাক্সিক্ষত সড়ক ও নৌদুর্ঘটনায় ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ

প্রকাশিত: ১৯:৪৪, ৭ জুলাই ২০২০

অনাকাক্সিক্ষত সড়ক ও নৌদুর্ঘটনায় ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ

সম্প্রতি ঘটে গেল একটি অনাকাক্সিক্ষত নৌদুর্ঘটনা। এতে প্রাণ চলে যায় অনেক মানুষের। ফরাশগঞ্জ ঘাটের এক দোকানের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে লঞ্চ দুর্ঘটনার এ ভয়াবহ দৃশ্য ধরা পড়েছে। ৩৭ সেকেন্ডের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, সকাল ৯টা ১৩ মিনিটে ফরাশগঞ্জ ঘাটে প্রতিদিনের মতো লোকজন ব্যস্ত তার দৈনন্দিন কাজ নিয়ে। ঘাটে বিআইডব্লিউটিএ’র একটি ভেঁকু দিয়ে মাটি সরানোর কাজ করছে। এরই মধ্যে একটি সাদা রঙের লম্বাকৃতির তিন তলা লঞ্চ দ্রুতগতিতে লালকুঠি ঘাটের দিকে পিছনের দিক দিয়ে দ্রুতগতিতে চলে যাচ্ছে। লঞ্চের পিছনের অংশ স্পর্শ করে আরও একটি ছোট লঞ্চ যাচ্ছে। বড় লঞ্চটি ছোট লঞ্চটিকে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকে। ময়ূর-২ লঞ্চটি ছোট লঞ্চ মর্নিং বার্ডকে চাপা দিয়ে দুমড়েমুচড়ে ডুবিয়ে দিচ্ছিল। মাত্র ১৫ সেকেন্ড সময়ে চোখের নিমিষেই মর্নিং বার্ড লঞ্চটি পানির অতলে হারিয়ে যায়। বড় লঞ্চটি এবার সামনের দিকে এগুতে থাকে। এ দৃশ্য দেখে ফরাশগঞ্জ ঘাট থেকে মানুষ কাজ ফেলে ট্রলার নিয়ে ছুটে যায়। শুরু হয় উদ্ধার কাজ। চোখের পলকে ডুবে গেল যাত্রীবোঝাই লঞ্চটি। মাত্র ১৫ সেকেন্ডে মর্মন্তুদ দৃশ্য অবলোকন করল বেশুমার মানুষ। চালকের অসচেতনতা এবং বেপরোয়াভাবে চালানোর ফলেই মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটল যার ফলে প্রাণ দিতে হলো অনেক নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে। নৌযান চালকদের অসাবধানতা এবং অসতর্কতা এই ধরনের অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। অনেক সময় দেখা যায় নৌযান চালকেরা একটি আরেকটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলাচল করে। এর ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। নৌযান চালকদের আরও সাবধানতা এবং সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে যে তাদের একটু অসাবধানতা কেড়ে নিতে পারে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের প্রাণ। এ প্রাণহানির ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন নৌ প্রতিমন্ত্রী। স্বাভাবিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে সৃষ্ট সবচেয়ে প্রধান সমস্যা-অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘সড়ক ও নৌ দুর্ঘটনা’। প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনায় চলছে। কোনভাবেই যেন কমছে না সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু। প্রায় প্রতিদিনই ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করছেন বহু মানুষ। একটি সড়ক বা নৌদুর্ঘটনা একটি পরিবারের সারা জীবনের কান্না হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে ভেঙ্গে যাচ্ছে সাজানো স্বপ্ন, তছনছ হয়ে যাচ্ছে সুখের সংসার। এখন কর্মজীবী মানুষ যথাসময়ে বাসায় না ফিরলে প্রথম যে ‘আশঙ্কা’ মনে দানা বাঁধে সেটি হলো সড়ক দুর্ঘটনা। একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। এই সচেতনতামূলক কথাটির সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। যাত্রী ছাউনিতে বা সড়কের বিশেষ স্থানে এই সচেতনতামূলক লেখাটি দেখা যায়। দুর্ঘটনা একটি অনাকাক্সিক্ষত বিষয়। হয়ত অনেকটা অজান্তেই সামনে চলে আসে আর ধ্বংস করে দেয় জীবন বা জীবনের ভবিষ্যত। সড়ক দুর্ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ হলো চালকদের বেপরোয়া মনোভাব এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক। মহাসড়কে এবং আন্তঃজেলা সড়কে যারা তিন চাকার যানবাহন চালক, তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নেই আবার ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই। বড় একটি সতর্কবার্তা হলো যাত্রীবাহী যানবাহন চালাতে গেলে অবশ্যই চালকের বয়স কমপক্ষে ২১ বছর হতে হবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, অপ্রাপ্তবয়স্করা এসব গাড়ি চালাচ্ছে। অথচ তাদের দক্ষতা ওভাবে গড়ে ওঠেনি। আর তিন চাকার যান এবং মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে তো বয়সের কোন তোয়াক্কাই নেই। এগুলো দুর্ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। অনিরাপদ সড়ক ব্যবস্থায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মৃত্যু ঝুঁকি। দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও তাই দৈনিক বিষয়বস্তু হিসেবে রূপ নিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। বর্তমান বাংলাদেশে দৈনিক মৃত্যুর হার গণনা করলে যা দাঁড়ায়। তার একটি বড় অংশ জুড়ে আছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু। এর প্রধান কারণ অনিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা। সড়ক পথে ট্রাফিক আইন তোয়াক্কা না করেই বেপরোয়াভাবে দূরপাল্লার যান চালানো হয় যেখানে ট্রাফিক আইন না মানলে চালকদের জন্য কঠিন রকম বিচার ব্যবস্থা রাখা আছে। সড়ক ব্যবস্থায় যদি আরও নজরদারি বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয় তাহলে হয়তো সড়ক দুর্ঘটনা নামক অনাকাক্সিক্ষত এ বিষয়টি অনেকটাই কমে আসবে। আমাদের একটু বাড়তি সচেতনতাই হতে পারে সড়ক দুর্ঘটনা থেকে মুক্তির উপায়। দূরপাল্লার যানের মধ্য চলে প্রতিযোগিতামূলক আচরণ। যেখানে সামান্য একটু অসাবধানতাই ডেকে আনতে পারে অসংখ্য মৃত্যুর মিছিল। গাড়ি চালকরা প্রায়ই রাস্তার সর্বোচ্চ গতিসীমা নামক সঙ্কেত উপেক্ষা করে গাড়ি চালান। এটা অবশ্যই একটি খারাপ দিক। আরেক দিকে অনেক চালক তাদের অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে বিরামহীনভাবে গাড়ি চালায়। এতে করে একসময় তারা ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাদের এই ক্লান্তি আর অবসাদই একটি চলন্ত গাড়িকে ভয়ঙ্কর রকম দুর্ঘটনার দিকে নিয়ে যেতে যথেষ্ট। এটা গাড়ি চালকদেরকেও বুঝাতে হবে দুর্ঘটনা ওনাদেরও কাম্য নয় তবুও শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে যেন তারা গাড়ি চালায়। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইলে কথা বলা থেকে বিরত থাকা এবং চলতি পথে সকল প্রকার ট্রাফিক আইন মেনে চলাই বাঁচাতে পারে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনার হাত থেকে। আবার যত্রতত্র, ভাঙ্গা সড়কও কম দায়ী নয় সড়ক দুর্ঘটনার জন্য। আর যেখানে-সেখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি তো এখন সারা বছরের একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে যাত্রাপথে যুক্ত হচ্ছে আরও বাড়তি দুর্ভোগ। সড়কের এমতাবস্থার সঙ্গে আনফিট গাড়ি আজকাল হরহামেশাই চোখে পড়ছে তদারকির অভাবে দিন দিন সড়কে বাড়ছে এরকম গাড়ির সংখ্যা। সাধারণ যাত্রীরা অনেকটা বাধ্য হয়েই এ সকল গাড়িতে যাত্রা করছেন। একটু সাবধানতা সড়ক ও পরিবহনের দুর্ঘটনার পঙ্গুত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারে। আমরা যারা সড়কে চলি পায়ে হেঁটে কিংবা গাড়িতে। রাস্তা পারাপারে, চলাচলে আমাদের চাই বাড়তি সচেতনতা। গাড়িতে ওঠা-নামাও যেন হয় ন্যূনতম ধৈর্য সহকারে। আমাদের সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে কোন দুর্ঘটনাই যেন আমাদের পৌঁছে না দেয় অনিশ্চিত কোন ভবিষ্যতের কাছে। জনসচেতনতাই অনেকাংশে রোধ করতে পারে সড়ক দুর্ঘটনা। সড়ক পথে নিজে সচেতন হই অন্যকে সচেতন করি। দুর্ঘটনার অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সারা জীবন একটি দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করতে থাকে। তার স্বাভাবিক জীবন যাপন সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হতে থাকে। সঠিক মনিটরিংয়ের অভাব ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে মূলত এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। তবে প্রতিনিয়ত বিপুলসংখ্যক মানুষ মারা গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চালক বা মালিকের উপযুক্ত শাস্তির নজির নেই। চালক ও মালিকদের সাজা শিথিল এবং দোষীদের কঠোর শাস্তির অভাবে সড়ক দুর্ঘটনা কমছে না। গাড়ি এবং নৌ যান চালায় চালক। চালক ও পথচারী এবং যাত্রীদের আরও সচেতন হয়ে আইন মেনে চলার জন্য কঠিন আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে পুলিশ এবং প্রশাসনকে যেন অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা ঘটে। একেক দুর্ঘটনার জন্য একেকজন দায়ী। কোথাও চালক দায়ী, কোথাও হেলপার দায়ী। কোথাও গাড়ির ফিটনেস না থাকা দায়ী। মোটকথা প্রত্যেকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব। একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না-এ কথা মনে রেখে প্রয়োজন মোটরযান অধ্যাদেশ, ট্রাফিক আইন, রোড সাইন, সিগন্যাল ও লেনবিধি মেনে চলার বাধ্যবাধকতা, গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ও গাড়ির যন্ত্রাংশ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা, নিরাপদে নৌযান সম্পর্কিত সচেতনতা, নিরাপদে গাড়িচালনা সম্পর্কিত সচেতনতা, শব্দ দূষণরোধে গাড়িচালকদের ভূমিকা, নিরাপদে গাড়িচালনা সম্পর্কিত সচেতনতা, চালকদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা যাতে করে তারা দুর্ঘটনার বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হয়। নৌযানের ক্ষেত্রে প্রয়োজন সঠিকভাবে তদারকি করা যেন চালকরা বেপরোয়াভাবে নৌযান না চালায় এবং একটি যেন আরেকটির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করে। প্রশাসন ও নৌ-পুলিশের নজরদারি আরও বাড়াতে হবে যেন নৌযান চালকরা অসচেতন এবং বেপরোয়া হয়ে না ওঠে। লেখক : কলামিস্ট
×