ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সুস্মিতা জাফর

একজন করোনাযোদ্ধা

প্রকাশিত: ০০:২১, ১ মে ২০২০

একজন করোনাযোদ্ধা

নরসিংদী সদর হাসপাতালে পোস্টিং থাকলেও, দেশের দুর্যোগের সময়ে মেডিক্যাল অফিসার রাফির হঠাৎ পোস্টিং হয়ে গেল বরিশালে। করোনা ইউনিটে রোস্টার পড়েছে ডাক্তার রাফির। রোস্টারটা এমন- ৭ দিন হাসপাতালে টানা কাজ করার পর ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। কোয়ারেন্টাইন মানে যে ১৪ দিন নিজ বাসায় ফিরে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে আরাম আয়েশ করবে তা না। দায়িত্বরত হাসপাতালের কাছেই লোকালয় থেকে দূরে একটা নিরিবিলি হোটেলের অতি নীরব ক্যামরায় অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে নিজেকে আটকে রাখতে হবে, সেখানে পরিবার তো দূরের কথা, কথা বলার জন্য আর একটা আপন মানুষও থাকবে কিনা সন্দেহ! এত কিছুর পরেও বাসায় ছোট বাচ্চা ফেলে, কর্মজীবী স্ত্রী, বিধবামা, সাজানো সংসার, সবকিছু ফেলে; নিজের কথা, পরিবারের কথা না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ল অদ্ভুত, অজানা এক সংক্রামক অসুখে অসুস্থ রোগীদের সেবা করতে! ৭ দিন, ৭ রাত, খেয়ে-না খেয়ে, তীব্র গরমে চবৎংড়হধষ চৎড়ঃবপঃরাব ঊয়ঁরঢ়সবহঃ (চচঊ) নামক দম বন্ধ করা এক পোশাকের মাঝে আবদ্ধ হয়ে কঠোর হস্তে সেই সংক্রামক রোগের হাত থেকে অসহায় মানুষের জীবন রক্ষার্থে কাজ করে গেলেন তিনি। ইতোমধ্যে তারই তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিতে এসে গত ৭ দিনে অন্তত ১১ জন ‘কোভিড ১৯’ রোগে আক্রান্ত রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন! রাফির মনে হচ্ছিল, এর চেয়ে বড় জয়, বড় পুরস্কার আর হতে পারে না! একবারের জন্যও সে ভাবল না, তার কর্মক্ষেত্র, তার বাসস্থান থেকে বহু দূরের এক জায়গায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে এসে, সেই কাজে সফল হওয়ার জন্য কোন ঝুঁকি ভাতার কথা কিংবা অন্য আরও অনেক সুযোগ সুবিধা পাওয়ার কথা। ৭ দিন এর দায়িত্ব শেষে নীরব নিরিবিলি সেই হোটেলের কোয়ারেন্টাইনের প্রথম দিন আজ। অসম্ভব ভাললাগা নিয়ে স্ত্রী তারান্নুমকে ফোন দিয়ে ফেলল ডাক্তার রাফি। এই ৭ দিন কোন যোগাযোগ হয়নি পরিবারের সঙ্গে। তারান্নুমকে ফোন দিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে নিজের সফলতার গল্প জানাতে যাচ্ছিল রাফি, ঠিক সেই মুহূর্তেই তার স্ত্রীর মুখে শুনতে পেল বাড়িওয়ালা নোটিশ দিয়েছে, ৭ দিনের মাঝে বাসা ছাড়তে হবে। কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসা প্রদানরত চিকিৎসক কে ভাড়াটিয়া হিসেবে কোনভাবেই মেনে নেয়া যাচ্ছে না! আশপাশের এলাকার লোকজন এসেও দল বেঁধে শাসিয়ে গিয়েছে গতকাল বিকেলে। তাছাড়া আরও ৪ দিন আগে থেকেই বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটিয়ারা তারান্নুমের হাসপাতালে পড়ে যাওয়া সাবান দিয়ে ধোয়া জামা-কাপড় ছাদে শুকাতে দেয়াতে অভিযোগ জানিয়েছিল! রীতিমতো হতবম্ব হয়ে গেল রাফি এসব কাহিনী শুনে। সে আর তার স্ত্রী তাহলে কাদের জন্য জীবন দিয়ে লড়ে যাচ্ছে এই কয়দিন? কোয়ারেন্টাইনের তৃতীয় দিন সকাল থেকে না খেয়ে আছে রাফিসহ আরও ৫ জন ডাক্তার এবং নার্স। গত সপ্তাহে এই ছয়জনেরই রোস্টার করে ডিউটি ছিল করোনা ইউনিটে। তাই এখন ৬ জনই কোয়ারেন্টাইনে আছে তারা একই হোটেলে। গতকাল রাতে হোটেলের বাবুর্চি সোলেমান মিয়া পালিয়ে গিয়েছেÑ কোয়ারেন্টাইনে থাকা কোন স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য রান্না করতে যেয়ে রোগ বাঁধিয়ে বসার কোন ইচ্ছে নাকি তার নেই! এখন রাফিরা কেউ বের হতেও পারছে না হোটেল থেকে। কেননা, তাদের বের হওয়া মানে, তাদের মাধ্যমে আরো অনেকের মাঝে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়! অবশেষে পাশের থানার এক পরিচিত লোককে ফোন দিলে, সে খাবার দিয়ে যেতে রাজি হলো সে দিনের মতো! কোয়ারেন্টাইনের ৭ম দিন, এখনও পর্যন্ত ডাক্তার রাফি কিংবা তার কোন সহকর্মীর মাঝে কোভিড- ১৯ রোগের কোন লক্ষণ দেখা যায়নি, আলহামদুলিল্লাহ। আরও ৭ দিনের অপেক্ষা। রাফিকে ছাড়াই তার মা, বউ-বাচ্চাকে বাসা ছেড়ে দিতে হয়েছে, প্রচ- চাপের মাঝে, এলাকা লকডাউনের ভেতরেই কী ভয়াবহ অবস্থা! কেমন আছে ওরা, কোথায় আছে– এসব প্রচ- মানসিক যন্ত্রণার মাঝেই কোয়ারেন্টাইন শেষে আগামী সপ্তাহে শুরু হতে যাওয়া দ্বিতীয় ধাপের রোস্টার এ চিকিৎসা দেয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিল রাফি। কোয়ারেন্টাইনের ১০ম দিন। তারান্নুম ভিডিওকল দিয়েছে, বাচ্চাটা নাকি বাবাকে খুব করে দেখতে চাইছিল। কিন্তু ভিডিওকল দিয়েই করেছে আসল ভুলটা, একমাত্র সন্তান, রাফির অতি আদরের কন্যা ইনায়ার কান্নার বাঁধ আর কিছুতেই মানছে না। বাবাকে সে দেখতে পায় না অনেকদিন। শেষ আদরটা খেয়েছে সেই ১৮ দিন আগে! আজকের মতো বাবা সামনে এসেছে ঠিক, কিন্তু কন্যা ইনায়া, বাবাকে ছুঁতে পারছে না কেন, কেউ বলতে পার? বাবা আর ইনায়ার মাঝে ট্যাবের স্বচ্ছ এই স্ক্রিনটা সামনে চলে এল যে! বাবাকে কি আর একবার ছুঁয়ে দেখা যাবেনা কখনও? ১১ মাসের ইনায়া কিছু বলতে পারে না, কথা তেমন শেখেনি, ট্যাবের স্ক্রিনেরও পাশ দিয়ে হাত বাড়িয়ে রেখেছে বাবার কোলে আসবে বলে। কিন্তু এপাশ থেকে মামনি ডুকরে কাঁদছে, ওপাশে অবিরাম কেঁদে চলেছে বাবা! কেন কাঁদছে ওরা দুজন? কেন ইনায়া স্পর্শ করতে পারছে না তার বাবাকে? কোয়ারেন্টাইনের ১২তম দিন, পরশু থেকে রাফির দ্বিতীয় ধাপের রোস্টার শুরু। পরিবার পরিজন, নিজের ভবিষ্যত, নিজের জীবন সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে, আবারও সম্মুখযুদ্ধে প্রস্তুত আমাদের করোনা যোদ্ধা। ঠিক এমন সময় হাসপাতাল থেকে ফোন এল একটা, সহকর্মী রেজার ফোন, জানাল, ২১ দিন আগে ডাক্তার রাফিকে করোনা ইউনিটে যোগদানের কথা থাকলেও, ৭ দিন কাজ করেই পালিয়ে যাওয়ার অপরাধে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে চাকরি থেকে! কী? পালিয়ে গিয়েছে অর্থ কী? সেই মুহূর্তে রাফির মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না, গলায় কী যেন একটা দলা পাকিয়ে আসছিল! রাফি বলতে চাচ্ছিল যে, আসলে করোনা ইউনিটে কাজ করা সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের রোস্টারটা এভাবেই বানাতে হয়, এটাই প্রোটোকল- ৭ দিন হাসপাতালে ডিউটি করার পর, ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয়। রাফি কিংবা রাফিরা ৭ দিন চরম পরিশ্রমের পর, গত ১৪ দিন ধরে পালিয়ে থাকেনি, এটাকে পালিয়ে থাকা বলে না, এটাকে কোয়ারেন্টাইনে থাকা বলে! যত্তসব! আচ্ছা, কেউ কি শুনতে পাচ্ছেন রাফির চিৎকার? শুনতে পাচ্ছেন একজন সম্মুখ করোনা যোদ্ধার তীব্র কষ্টের আর্তনাদ? বুঝতে পারছেন তার অসহায়ত্ব?
×