ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দিলরুবা শাহানা

করোনার সময়-কাহন

প্রকাশিত: ০০:২০, ১ মে ২০২০

করোনার সময়-কাহন

কোভিড-১৯ বা করোনা নামের ভাইরাসের দর্পিত পদচারণায় বিশ্ব কম্পিত এখন। ধনসম্পদে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোও করোনাকে কাবু করতে অপারগ। রাজপুত্র-রাজকন্যা, রাষ্ট্রনায়ক কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না করোনা। এই রোগটির মনে হচ্ছে সমতায় আস্থা তাই ধনী-দরিদ্র সবাইকে সমান মমতায় আলিঙ্গন করছে করোনাভাইরাস। রাজনন্দিনী (স্পেনের রাজকুমারী মারিয়া তেরেসা করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মৃত) থেকে মন্ত্রী, স্পিকার তাদেরও কাউকে কাউকে হসপিটালে অথবা পরপারে পাঠিয়ে ছেড়েছে করোনাভাইরাস বা কোভিড- ১৯। শোনা যাচ্ছে ২০১৯ শেষে চীনের হুবে প্রদেশের অন্তর্গত উহান শহরের এক বন্য প্রাণীর (বাদুড় বা কোন সরীসৃপ) বাজার থেকে করোনাভাইরাস মানবদেহে সংক্রমিত হয়েছে। আজ মানুষ করোনার কারনে গৃহবন্দী। প্রকৃতির কি বিচিত্র খেলা এটি। মানুষ নানা প্রাণীকে বন্দী করে রেখেছে চিরকাল। আজ ওই প্রাণীরই কারণে মানুষ বন্দী আপন ঘরে। গোটা পৃথিবী বিপর্যস্ত আজ। ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর সময়ের আগমনী শোনা যাচ্ছে। দীর্ঘকাল মানুষ প্রকৃতিকে তোয়াক্কা করেনি। তারা নিজের আগ্রাসী সাধ মিটিয়েছে প্রকৃতিকে ব্যবহারের মাধ্যমে। পাহাড় জঙ্গল কেটে উজাড় করেছে, নদী ভরাট করে প্রাসাদ গড়েছে। এখন সুদে-আসলে প্রকৃতির প্রতি অন্যায়ের দেনা শুধবার সময় আসছে। করোনার কারণে পার্টি, মিটিং, খেলাধুলা বন্ধ, দূর-দূরান্তে বেড়ানো বন্ধ, আকাশে বিমানের ওড়াউড়ি ক্ষান্ত, কলকারখানার দরজায় তালা। ফলে বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইড কমেছে, শ্বাস নেয়া যাচ্ছে, আকাশে স্বচ্ছতা ফিরে আসছে, জলের প্রাণী জলকেলীতে মত্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সবই করোনাভাইরাসের কল্যাণে। করোনাকেন্দ্রিক কিছু কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হলো। হ ফোনে একজন মহাউৎসাহে আরেক জনকে বলছেন -চাইনিজরা যত্তসব আজগুবি জিনিস সাপ, বেঙ, বাদুড় খায় তা থেকেই ওদেরকে এই ভাইরাসে ধরেছে -আরে না, ভাই শুনলাম চাইনিজদের অর্থনৈতিক উন্নতি দাবানোর জন্য ল্যাবরেটরিতে নাকি এই জীবানুঅস্ত্র করোনাভাইরাস তৈরি করে চীনে ছেড়ে দেয়া হয়েছে -হলেও হতে পারে -হতে পারে কি বলছেন, এটাই ঠিক। চীনে যখন প্রতিদিন শত শত মানুষ করোনাতে মারা যাচ্ছে তখন আমেরিকাতে কোভিড-১৯ দেখা দেয়নি, সত্যি কি না? -মনে হচ্ছে তাই। হ কয়দিন পরেই আবার আরেক জনের ফোন -দেখেছেন আল্লাহর মার দুনিয়ার বাড়। আমেরিকার মতো দেশ কামান-গোলা, বন্দুক-বারুদ, পরমানু বোমা, ড্রোন ফ্রোন কি নাই আমেরিকার আর সেই আমেরিকাই পারছে না চোখে দেখা যায় না এমন এক ক্ষুদ্র জীবানুর সঙ্গে লড়তে! -ঠিক বলেছেন জনাব। আমেরিকা কতদূরে বসে ড্রোন না কি যেন পাঠিয়ে ইরানের কাসেম সোলায়মানীর মতো দক্ষ রণকুশলীযোদ্ধাকে কতল করে ফেলেকত্তোবড় কৃতিত্ব দাবি করল আর এখন কোভিড-১৯ কে নির্মূল করতে পারছে না! -প্রকৃতি উঠেছে খেপে, তার রুদ্ররোষ থেকে মহাপরাক্রমশালীও রেহাই পাবে কি না কে জানে? হ করোনার করুণ সময়ে নানাভাবে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রায় সবদেশেই জনগণকে কয়েকটি শব্দ ‘আইসোলেশন’, ‘ডিসট্যান্স মেনটেইন’, ‘কোয়ারেন্টাইন’ বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র হিসাবে শেখানো হচ্ছে। জনগণ এত সবকিছু বোঝেন না বা এতসব মানলে বাঁচবেনই বা কিভাবে। মানুষই কেবল আলাদা হয়ে কাজকর্ম বন্ধ করে হাত, পা কোলে নিয়ে বসে থাকবেন তাতো নয়। যে কাজগুলো করে আমজনতা জীবনধারণ করতেন কাজগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা গেছেও। প্রতিদিন করোনা আক্রান্ত দেশগুলোতে শত শত হাজার হাজার মানুষ কাজ হারাচ্ছে। কাজের খোঁজে হন্য হয়ে ছুটছে মানুষ। হ পৃথিবীর করোনা আক্রান্ত অন্যসব দেশের মতোই অস্ট্রেলিয়াও কোভিড-১৯-এর ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে মানুষের চলাফেরা সীমিত করেছে, স্কুল-কলেজসহ তাবত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে। ঘরে বসে যেসব কাজ ইন্টারনেটের মাধ্যমে করা যায় লোকজন সেসব কাজ ঘরে বসেই করছে বা করতে বাধ্য করা হচ্ছে। মানুষের মানসিকতাও বন্দীত্বের পেষণে বদলে যাচ্ছে, নিষ্ঠুরতাও প্রকট হচ্ছে। একদল মানুষ নিরাপত্তার জন্য শপিং সেন্টারে গিয়ে যতবেশি সম্ভব জিনিসপত্র কিনে এনে মজুদ করছে। আমেরিকাতে কেউ কেউ আবার লাভের আশায় বাজার উজাড় করে টয়লেট পেপার কিনে সেই পেপার আবার ই-বেতে সত্তরগুণ বেশি দামে বিক্রি করছে। পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছে বলে খবরে জানা গেল। আবার মানুষের মানবিকতাও এখন উদ্ভাসিত হচ্ছে। এক পারায় কোণের বাড়িতে একটি ছেলে একাই থাকে। ছোটখাটো মানুষটির সাইকেলটাও ছোট। মনে হয় স্পেসিয়ালি ওই সাইকেলটা ওর সুবিধার জন্য বানানো। তার সাইকেলের পেছনে বড়সড় একটি ক্যারিয়ারও আছে। পারার কারোর সঙ্গেই ছেলেটির কোন আলাপটালাপ হয় না কখনও। কারণ কি কে জানে? শো শো করে সাইকেলে যেতে সে আকাশে শিস ছুড়ে দেয়, কারও আঙ্গিনায় হঠাৎ কাউকে দেখলে ছুটে যাওয়ার মুহূর্তে ‘হ্যালো’ বলে চমকে দেয়। তার মা-বাবা বা ভাইবোন কেউ আছে কি না কেউ খবর রাখে না। সেই একাকী ছেলেটি বা তরুণটি করোনার দুর্যোগেরকালে একটি কাজ করল। পারার নিঃসন্তান বয়স্ক ক্যারোলাইনের দরজায় কয়েকটি টয়লেট রোলের প্যাকেট দিয়ে যায়। ক্যারোলাইন তার প্রতিবেশীকে বলে -দেখ ওই সাইকেল বয় আমার জন্য কি রেখে গেছে! দরজা খোলার আগেই তর তর করে নেমে চলে গেল। প্রতিবেশী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল -আমরা স্বজনহীন ছেলেটির কোন খবর রাখি না ও পারার সবার কথা হয়ত জানে, জানে টয়লেট পেপার জোগার করে দেবে তোমার তেমন কেউ নেই। হ মানুষ সামাজিক প্রাণী। ঘরে বসে থাকা মানুষের ধাতে সয়না। মানুষকে জীবন রক্ষা করার জন্যই অন্তরীণ থাকা যে দরকার গুরুত্বসহ কথাগুলো অনেকেই শুনতে ও মানতে রাজি নয়। তাই পুলিশ ঘুরছে, সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে শৃঙ্খলা মানানোর জন্য। রাস্তায় একই পরিবারের দুজন একসঙ্গে হাঁটতে পারবে এর বেশি হলেই পুলিশ জরিমানা করবে এবং করছেও। ফাঁকা লোকালয় নির্জনতা। সবাই ঘরে অন্তরীণ। এরই মাঝে মেলবোর্নের পাড়ায় বাসার কাছেই খোলামেলা জায়গায় পাঁচ/ছয়জন মিলে আনন্দে ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠলেন। হয়ত ঘরে বসে থেকে হাড়গোড়ে জং ধরা বন্ধ করতেই এই খেলাধুলার উদ্যোগ। পুলিশ এসে হাজির। নিয়ম ভেঙ্গে দুজনের জায়গায় পাঁচজন। জরিমানা করা হলো সঙ্গে সঙ্গে। আট হাজার ডলার জরিমানা গুনতে হলো। কর্তৃপক্ষ এবারের গুড ফ্রাই ডে. ইস্টার উইক এন্ডে লোকজনকে বাইরে বার না হতে, গাড়ি নিয়েও অযথা ঘোরাঘুরি না করতে বলছে। সাউথ ইয়ারা নামের জায়গায় গাড়িতে এক ব্যক্তি উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরছিলেন। পুলিশ গাড়ি থামিয়ে জানতে চাইল কি চায় বা কি কাজে সে এখানে। সে লোক জানালো পানি কিনতে এসেছে। পুলিশ তখুনি তার ড্রাইভার্স লাইসেন্স দেখাতে বলে। তা থেকে দেখা গেল লোকটি প্রায় ৩০ কি.মি. দূর থেকে এই এলাকাতে অযথা ঘুরতে এসেছে। তাকে জরিমানা করা হলো হাজার ডলার। (নিউজ.কম ও রেডিও) হ এবার শোনা যাক একদেশের মন্ত্রীর নিয়ম ভঙ্গের খেসারত। নিউজিল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী করোনার দিনে ঘরে থাকার নিয়ম না মেনে সপরিবারে ছুটির আনন্দভোগে গিয়েছিলেন। ধরাও পড়লেন। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জ্যাসিন্টা আর্ডেন ওই মন্ত্রীর পদানবতি করলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে পদচ্যুতই করতেন তবে এই দুঃসময়ে করোনা ঠেকানোর কাজে তাকে দরকার। তাই কম শাস্তিই দিলেন মন্ত্রীকে। হ সপ্তাহ তিন আগে রোদালো বিকেলে রোববারে মেলবোর্নে এক যুগল ঘর থেকে একটু বাইরে ঘুরতে বের হলেন। আধ ঘণ্টা গাড়িতেই সমুদ্রের পাশের প্রায় যন্ত্রদানবহীন, জনমানব শূন্য রাস্তাতে তারা ঘুরলেন। পুরো রাস্তাতে গাড়ি-টাড়ি তো কমই এমনকি সমুদ্রের ধারে হাঁটার পথেও খুব কম লোক দেখা গেল। ফেরার পথে ঝম ঝম করে নামলো বৃষ্টি। গাড়ি আস্তে আস্তে চলছে। হঠাৎ করে গাড়ি থেকে মহিলা দেখলেন রাস্তার অপর পাশে একজন বয়স্ক মহিলা দুহাতে দুটি শপিং ব্যাগ নিয়ে দ্রুত হাঁটছেন। বৃষ্টিতে ভিজতে হবে তাকে। ব্যাগে হয়ত রুটি, মাখন, পনির, ডিম যা এরা প্রতিনিয়তিই খায়। আরেক ব্যাগে হয়ত দুধের কন্টেইনার, সামান্য ফলমূল। বেশি ভারি কিছু না। তারপরও বয়স ও বৃষ্টির দাপট মহিলাকে ক্লান্ত শ্রান্ত করছে। হঠাৎ প্রয়োজনে কাউকে মহিলা ডাকেন নি বা তেমন কেউ নাই তার। গাড়িতে বসা দুজনের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল নেমে গিয়ে মহিলাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কিন্তু করোনার নিয়ম ভঙ্গের ভয়ে তারা এগোতে সাহস পেলেন না। তারা ব্যথিত মনে সওদাপাতির বোঝা হাতেঝর ঝর বৃষ্টির মাঝে মহিলাকে পায়ে চলা নির্জন রাস্তায় একা রেখে নীরবে ফিরে আসলেন। এই হচ্ছে করোনা কালের বাস্তবতা।
×