ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে কাঙ্গালিনী সুফিয়ার

প্রকাশিত: ২২:৩৬, ২৯ এপ্রিল ২০২০

অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে কাঙ্গালিনী সুফিয়ার

মনোয়ার হোসেন ॥ চারদিকে চলছে মহামারী করোনার অভিঘাত। অদৃশ্য ভাইরাসের প্রভাবে বন্ধ হয়েছে অগণন মানুষের আয়ের পথ। জুটছে না অনেকের তিন বেলার খাবার। সেই অসহায় মানুষদের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন কাঙ্গালিনী সুফিয়া। কোভিড-১৯-এর প্রভাবে দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়েছেন ‘পরাণের বান্ধব রে’ গান শুনিয়ে প্রাণপ্রিয় হওয়া এই লোকসঙ্গীত শিল্পী। ক্ষুধার জ্বালায় দিনের বেলায়ও যেন দেখছেন অন্ধকার। লাখো শ্রোতার হৃদয় রাঙানো এই বাউল শিল্পীর ঘরে এখন নেই খাবার। লোকজ সুরের মায়াজালে বাংলার পথ-প্রান্তর রঙিন করা শিল্পীর নেই ওষুধ কেনার পয়সা। দুই মাসের বেশি সময় আগে তিনি দোল পূর্ণিমায় ফকির লালন সাঁইয়ের আখড়ায় গান গাইতে কুষ্টিয়ায় যান। এরপর লকডাউনের কবলে পড়ে আর ফেরা হয়নি রাজবাড়ি জেলার রামদিযা গ্রামের বসতভিটায়। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে কথা হয় এই লোকগানের শিল্পীর সঙ্গে। কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করতেই অস্ফুট স্বরে বলেন, ভালো নাই। ফোন করছেন কেন? আপনি কি আমাকে কিছু সাহায্য করবেন? পারলে কিছু সাহায্য করেন। আমার আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। এখন গান গাওয়ার মতো শারীরিক অবস্থাও নেই আমার। এছাড়া সব অনুষ্ঠানও বন্ধ। দুই মাসের বেশি সময় ধরে কুষ্টিয়ায় আটকা পড়ে আছি। এখানে লালন ফকিরের আখড়ায় গান গাইতে এসেছিলাম। পরবর্তীতে লকডাউনে কবলে পড়ে আর বাড়িতে ফিরতে পারি নাই। কুষ্টিয়ার জেলখানা মোড়ের এরশাদ নগরের আশ্রম পরিকল্পনার ৯/১০ নম্বর বাড়িতে। এই খুপড়ি ঘরে অর্ধাহারে-অনাহারে কাটছে দিন। ঘরে কোন খাবার নেই। দুই সপ্তাহের বেশি সময় আগে কুষ্টিয়া ডিসি অফিস থেকে ১৩০ পরিবারের সঙ্গে আমিও কিছু চাল, ডাল ও আলু পেয়েছিলাম। সবই এখন ফুরিয়ে গেছে। জুটছে না তিন বেলার খাবার। ভুগছি ক্ষুধার কষ্টে। এই জ্বালা আর সহ্য হয় না। সঙ্গে আছে হৃদযন্ত্রের সমস্যাসহ নানা রোগ। অথচ পয়সার অভাবে ওষুধও কিনতে পারছি না। এই অবস্থায় আমি প্রশাসনের সহযোগিতা চাই। তারা যদি আমার জন্য কিছু করে তাহলে এই যাত্রায় বেঁচে যাব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও সাহায্য চাই। কুষ্টিয়ায় এখন যে ঘরে আছি সেটাও প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকেই পেয়েছিলাম। আমি তো চাইলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব না। কোথাও আমার কোন খবর দেখে তিনি যদি কোন সহায়তার উদ্যোগ নেন তাহলে হয়তো প্রাণে বেঁচে যাব। আলাপচারিতায় নিজের অপ্রাপ্তির কথা বলেন কাঙ্গালিনী সুফিয়া। একুশে পদকপ্রাপ্তির আকাক্সক্ষা প্রকাশ করে বলেন, আবদুর রহমান বয়াতী এই পুরস্কার পেলে আমি কেন পাব না। তাকে মরণোত্তর পদক প্রদান করা হয়েছিল। মৃত্যুর পরে আমি কিছু চাই না। যদি কিছু পাওয়ার থাকে সেটা জীবদ্দশাতেই চাই। তাইলে কিছুটা ভাল থাকব এবং মরেও শান্তি পাব। এর আগে সরকারীভাবে কেবল শিল্পকলা একাডেমি পদক পেয়েছি। বড়ই বিচিত্র কাঙ্গালিনী সুফিয়ার জীবন পরিক্রমা। জন্মেছিলেন হিন্দু পরিবারে। নাম ছিল অনিতা ঠেপি। পরবর্তীতে মুসলিম ধর্ম গ্রহণের পর নাম হয় সুফিয়া খাতুন। একপর্যায়ে সেই নামটিও বদলে যায়। চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের দেয়া ‘কাঙ্গালিনী’ উপাধিতে পরবর্তী সেই নামটি হয় কাঙ্গালিনী সুফিয়া। ১৯৬১ সালে রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার রামকান্দি গ্রামের জন্মগ্রহণ করেন লোকসঙ্গীত শিল্পী। গ্রামের একটি অনুষ্ঠানে গাওয়ার মাধ্যমে মাত্র ১৪ বছর বয়সে শুরু হয় তার সঙ্গীতজীবন। এরপর ১৫ বছর বয়সে বিয়ে সুধির হালদার নামের এক বাউলের সঙ্গে। যদিও সে বিয়ে টেকেনি বেশিদিন। ১৯৭৮ সালে গ্রহণ করেন ওস্তাদ হালিম বয়াতির শিষ্যত্ব। সেই সময়ই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সুফিয়া খাতুন নাম ধারণ করেন। গান গাওয়ার পাশাপাশি নিজেও অসংখ্য গান লিখেছেন কাঙ্গালিনী সুফিয়া। সেসসব গানে সুরও দিয়েছেন নিজে। এসব গানের মধ্যে ‘কোন বা পথে নিতাইগঞ্জে যাই’, ‘আমরা নারী কত কষ্ট করি’ ‘বুকের মধ্যে আগুন জ্বলে’ ‘নারীর কাছে কেউ যাইও না’ অন্যতম। এছাড়া তার গাওয়া তুমুল শ্রোতাপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘পরাণের বান্ধব রে, বুড়ি হইলাম তোর কারণে’। কণ্ঠ দিয়েছেন বেশকিছু চলচ্চিত্রের গানে। এছাড়া অভিয় করছেন দেয়াল, নোনাজলের গল্প শিরোনামের নাটকে।
×