ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা প্রতিরোধে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ শেরপুরে

সাড়া ফেলেছে ‘নো মাস্ক নো মেডিসিন- নো বাজার’ প্রচার

প্রকাশিত: ২২:২৭, ২৮ এপ্রিল ২০২০

সাড়া ফেলেছে ‘নো মাস্ক নো মেডিসিন- নো বাজার’ প্রচার

রফিকুল ইসলাম আধার ॥ প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউনের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেও যখন লোকজন মাস্ক ব্যবহারসহ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না, তাদের ফেরানো যাচ্ছে না ঘরে, অন্যদিকে প্রতিনিয়ত বাড়ছে করোনা ঝুঁকি, ঠিক তখন শেরপুরে এবার সাড়া ফেলেছে ‘নো মাস্ক, নো মেডিসিন’ ও ‘নো মাস্ক, নো বাজার’ প্রচারাভিযান। সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে ‘নো হেলমেট, নো ফুয়েল’ প্রচারাভিযানে সফলতা পাওয়ায় তারই আদলে এবার করোনা প্রতিরোধে জেলায় ওই ব্যতিক্রমী প্রচারাভিযান শুরু করেছে জেলা পুলিশ। গত ১৮ এপ্রিল শনিবার থেকে শুরু হওয়া ওই অভিযানের আওতায় এখন জেলা শহরসহ উপজেলা সদরগুলোর ওষুধের দোকান ও কাঁচাবাজারের দোকানে ঝুলছে ওই সচেতনতামূলক প্রচার ব্যানার। অন্যদিকে ওই প্রচারে সাড়া দিয়ে এখন বিক্রেতাদের পাশাপাশি ক্রেতা সাধারণও মুখে ব্যবহার করছেন মাস্ক। সেই সঙ্গে মানছেন সামাজিক দূরত্বসহ স্বাস্থ্যবিধি। জানা গেছে, বাংলাদেশেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তা প্রতিরোধে নানা সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান শুরু করে। তারই আওতায় জেলা পুলিশের উদ্যোগে পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম পিপিএম’র নেতৃত্বে জেলায় হাটবাজার ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় ১০ লাখ সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করেন। সেই সঙ্গে পুলিশ ভ্যানে, পুলিশের মুখে মাইকে প্রচার চালানো হয় জেলা সদর থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত। এরপর দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের তরফ থেকে নিয়মিত সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়ার প্রচারসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে বসানো হয় সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বেসিন। সেইসঙ্গে ওষুধের দোকানসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অন্যান্য বড় বড় দোকানগুলোর সামনে কেনাকাটার সময়কালে ক্রেতা সাধারণের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য পুলিশ সদস্যদের নিজ হাতে এঁকে দেয়া হয় গোলবৃত্ত। এছাড়া বিভিন্ন জেলায় অঘোষিত লকডাউন কার্যক্রম শুরু হলে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে শহরে অবাধ জন যাতায়াত নিয়ন্ত্রণসহ মানুষকে ঘরে থাকতে উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষ টহল জোরদার করে পুলিশ। সেইসঙ্গে সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দিতে জেলা প্রশাসনের পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমে অংশ নিয়ে সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রাখে। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ সাধারণ ছুটি আর লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া হতদরিদ্র ও অসহায় মানুষের পরিবারগুলোকে বাঁচাতে জেলা পুলিশের তরফ থেকে সাহায্যের হাত বাড়ানো হয়। করোনা কুইক রেসপনস টিম ও স্টুডেন্ট কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের সহযোগিতায় দিনমজুর, রিক্সা-ভ্যানচালক, চা দোকানিসহ প্রান্ত্রিক মানুষকে সহায়তা দিতে পুলিশ সুপারসহ জেলা পুলিশের অন্যান্য পদস্থ কর্মকর্তা ও ৫ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রীর প্যাকেট নিয়ে তাদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেন। এমনকি জেলায় অনগ্রসর জনগোষ্ঠী অর্থাৎ ক্ষুদ্র-নৃ- গোষ্ঠী, জেলে, সুইপার, কামার ও হিজরাদের তালিকা করে তাদের কাছে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া কেউ করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় ওইসব এলাকায় লকডাউন ঘোষণার কারণে কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানুষের দুূর্ভোগের কথা বিবেচনা করে ওইসব পরিবারের বাসায় গিয়ে মোবাইল নাম্বার দিয়ে এসেছে পুলিশ। কোন কিছুর প্রয়োজন হলে ওই নাম্বারে ফোন দিয়ে সহযোগিতা পাচ্ছেন তারা। পরদিন রবিবার দুপুরে জেলা শহরের নিউমার্কেট মোড়, কলেজ মোড়, বটতলা মোড়, থানা মোড়, খোয়ারপাড়, নবীনগর মোড়, খরমপুর মোড়, হাসপাতাল রোড, নতুন বাস টার্মিনাল, ও শেরীব্রিজ মোড়সহ নয়ানী বাজারে কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ ওষুধের দোকানসহ বড় বড় কাঁচামালের দোকানগুলোতে ঝুলছে করোনা প্রতিরোধে জেলা পুলিশের সচেতনতামূলক বিশেষ ব্যানার। ব্যানারগুলোতে ‘আসুন করোনা প্রতিরোধে সচেতন হই’- এ আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘নো মাস্ক, নো মেডিসিন’ ও ‘নো মাস্ক, নো বাজার’ বা ‘মাস্ক নেই যার, বাজার নেই তার’। আর ওই প্রচারণায় সাড়া দিয়ে ক্রেতা সাধারণকে দেখা যায় তারা প্রত্যেকেই মুখে মাস্ক ব্যবহার করেই ওষুধ বা কাঁচাবাজারের মালামাল কেনাকাটা করছেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে কাঁচাবাজারের দোকানগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ব্যাহত হলে সংশ্লিষ্ট দোকানিরাই তাদের অনুরোধের সুরে সতর্ক করছেন। কোন কোন দোকানের সামনে রাখা হয়েছে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। সরেজমিনে গেলে কথা হয়, নয়ানী বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ী আবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, পুলিশের তরফে দেয়া ‘নো মাস্ক, নো বাজার’ প্রচারমূলক ব্যানার খুবই কাজে আসছে। দু/একদিন আগেও ক্রেতাদের অনেকেই যারা মুখে মাস্ক পরতেন না বা পড়লেও কেনাকাটার সময় রাখতেন হাতে- তারা এখন প্রত্যেকেই মুখে মাস্ক পরছেন। এটি তাদের পাশাপাশি আমাদের জন্যও ভাল। তিনানী বাজারের ওষুধ ব্যবসায়ী বজলুর রশিদ নাহাজ জানান, করোনা প্রতিরোধে ‘নো মাস্ক, নো মেডিসিন’ প্রচারে ক্রেতা সাধারণ সতর্ক হয়ে উঠেছেন। একদিন সকালে মুখে মাস্ক না থাকায় ওষুধ বিক্রি না করে দু/তিনজনকে ফেরত দেয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এখন সকলেই বুঝে নিচ্ছেন, মাস্ক পরে না আসলে ওষুধ পাওয়া যাবে না। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, কেবল ওষুধ নেয়ার ক্ষেত্রেই নয়, নিজের স্বাস্থ্য সচেতনতার স্বার্থেই মাস্ক পরা অপরিহার্য। বিষয়টি সম্পর্কে শেরপুর চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র সহ-সভাপতি প্রকাশ দত্ত জানান, করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে জেলা পুলিশের উদ্যোগে ব্যতিক্রমধর্মী প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে শহরের ওষুধের দোকান ও কাঁচাবাজারে ‘নো মাস্ক, নো মেডিসিন’ ও ‘নো মাস্ক, নো বাজার’ লেখা সচেতনতামূলক ব্যানারে যথেষ্ট সাড়া মিলছে। প্রথমদিক দিয়ে ওইসব ব্যবসায়ীদের নমনীয়তা পালন করতে বলা হয়েছে। তবে দু/একদিন পর থেকে কেউ মুখে মাস্ক না পরলে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখলে তাদের কাছে কোন পণ্যই বিক্রি করা হবে না বলেও জানা তিনি। এ ব্যাপারে শেরপুরের পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম পিপিএম বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে মূলত জেলা পুলিশ লিফলেট ও মাইকিং প্রচারসহ প্রথম থেকেই নানা সচেতনতামূলক কর্মকা- পরিচালনা করছে। এছাড়া কর্মহীন অসহায় হতদরিদ্র মানুষের সহায়তায় ইতোমধ্যে জেলায় ১২ হাজার পরিবারকে খাদ্যসহ অন্যান্য সহায়তা প্রদান করেছে। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের মাস্ক পরার বিকল্প নেই। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র মতামতেও সে কথা বলা হয়েছে। তাই জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি নিজেদের সুরক্ষায় মাস্ক পরতে এবার জেলার ওষুধের দোকানসহ কাঁচাবাজারে ‘নো মাস্ক, নো মেডিসিন’ ও ‘নো মাস্ক, নো বাজার’ প্রচারাভিযান শুরু হয়েছে। দোকানে দোকানে ঝোলানো হয়েছে ওই প্রচারমূলক ব্যানার। সেইসঙ্গে ওইসব এলাকায় রাখা হচ্ছে বিশেষ নজরদারি। তিনি আরও বলেন, ইতোপূর্বে পুলিশের ‘নো হেলমেট, নো ফুয়েল’ কর্মসূচী সফল হওয়ায় সে আদলে এ প্রচারাভিযান শুরু করা হয়েছে এবং তা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়া হবে। এ জন্য তিনি ব্যবসায়ী ও ক্রেতা-বিক্রেতাসহ সকলের সহযোগিতা কামনা করে কর্মসূচীটি সফল হবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
×