ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নিষেধাজ্ঞা বা করোনা ঝুঁকিতেও থামছে না জাটকা শিকার

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ২৮ এপ্রিল ২০২০

নিষেধাজ্ঞা বা করোনা ঝুঁকিতেও থামছে না জাটকা শিকার

ওয়াজেদ হীরা ॥ একে করোনা তার ওপর রয়েছে সরকারের নিষেধাজ্ঞা। সব উপেক্ষা করে লুকিয়ে নদীতে জাল ফেলছে জেলেরা আর ধরছে জাটকা (ইলিশের বাচ্চা)। বিভিন্ন জেলায় ধরা সেই জাটকা সরবরাহও হচ্ছে গোপনে। রাজধানীর বাজারেও হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে জাটকা। যদিও জাটকা রক্ষা ও ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে ১ নবেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিবছর ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল দুই মাস দেশের পাঁচটি অভয়াশ্রমে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকা অবস্থায় সময়ে মাছ ধরা ও বিক্রির ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি এসব রক্ষায় জনসচেতনতা খুব জরুরী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজধানীর একাধিক বাজারে প্রশাসনের দৃষ্টি এড়িয়ে জাটকাকে ‘চাপিলা’ হিসেবে বিক্রি করা হয় যাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ধরা না পড়েন। এসব জাটকা প্রতিকেজি বিক্রি হয় ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা। কেজিতে জাটকা ওঠে ৩০-৪০টি। অথচ দেশে এখন জাটকা সংরক্ষণের সময় চলছে। প্রতিবছর ১ নবেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দেশব্যাপী জাটকা আহরণ, পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এছাড়া প্রতিবছর ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল দেশের পাঁচ অভয়াশ্রমে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ। জেলেদের জাটকা আহরণে বিরত রাখতে সারাদেশে তালিকাভুক্ত মোট ৩ লাখ ১ হাজার ২৮৮ জেলে পরিবারকে প্রতিমাসে ৪০ কেজি হারে চাল সহায়তা দেয়া হচ্ছে। আগামী দুই মাস এ সহায়তা পাবেন তারা। তালিকার বাইরে থাকা জেলেরাও পাচ্ছেন এই সহায়তা। তবুও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে বাজারে জাটকা আসছে, কিভাবে কারা আনছে। যদিও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদ জনকণ্ঠকে বলেন, এ বছর নৌ পুলিশ এবং কোস্টগার্ডের তৎপরতা বেশ প্রসংশনীয়। তারা বড় লঞ্চ রিজর্ভ নিয়ে নদীতে অবস্থান করছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমদের করোনার কারণে মাঠ প্রশাসন যেহেতু একটু ব্যস্ত মানুষকে সচেতনতা করতে ঘরে রাখতে সেই সুযোগ কিছু লোভী জেলে নিতে পারে। তবে আমাদের অন্য টিমগুলো সংস্থাগুলো সক্রিয়। মাঠ প্রসাশনও কাজ করছে। বিভিন্ন স্থানে জাটকা আটক ও বাজারে বাজরে জাটকা বিক্রি নিয়ে সচিব বলেন, কিছু জায়গায় হচ্ছে এটা ঠিক তবে আইন প্রয়োগ করে সব করা যায় না। আমাদের প্রত্যেককেই আইনের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। এজন্য মানুষের মধ্যে সচেতনতা দরকার কেননা যেহেতু জাটকা ধরা, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন নিষিদ্ধ তাই আমাদেরও আইন মানতে হবে। যদি সাপ্লাইয়ের সঙ্গে ডিমান্ড না থাকে তাহলেও কার্যকর হয়। তিনি বলেন যদিও কোন জেলে লোভের কারণে জাটকা ধরেও সেটি যদি বিক্রি করতে না পারে তাহলে ধরতেও নিরুৎসাহিত হবে। আমরা জেলেদের মাসে ৪০ কেজি করে চাল দিয়েছি এসব থেকে বিরত থাকতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিছু জেলে প্রসাশনের চোখ এড়িয়ে এসব ধরতে নদীতে জাল ফেলছে। কখনও কখনও শত শত মণ জাটকা ধরাও পরছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। ভোলার একাধিক জেলে নাম প্রকাশ না করে বলেন আমাদের সরকার সহায়তা দিচ্ছে তবুও কিছু জেলে যায় পরিবারের অভাব নানা কারণে যায় মাছ ধরতে। তবে নজরধারিও কড়া সেটি উল্লেখ করে বলেন, কেউ মাছ ধরতে গেলে অনেক সময় আমাদের জেলেরাও খবর দিয়ে দেয়। প্রশাসনের মানুষ সবসময় টহল দেয় নদীতে। এ জন্যই তো জাটকা আটক হয়। জানা গেছে, করোনায় যেখানে সবাইকে ঘরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে সরকার তখন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কিছু লোভী জেলে দায়িত্বরতদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নদীতে জাল ফেলছে। আর সেই জালে ধরা পড়ছে শত শত টন জাটকা। বাজারে সেই জাটকা আসার পর বিক্রিও হচ্ছে হরহামেশাই। কখনও কখনও মাছ মাথায় নিয়ে ঘুরে ঘুরেও বিক্রি হয় অলিতে গলিতে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানীর মগবাজারে মাছ বিক্রেতা জমির মিয়া বলেন, যাত্রাবাড়ী মাছের পাইকারি আড়ত থেকে প্রতিদিন জাটকা কিনে আনি। কখনও কাওরানবাজারেও যাই। অলি গলিতে ঘুরলে বিক্রি হয়ে যায়। কেজিতে অনেক মাছ ধরে দামও কম তাই মানুষ কিনে। বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার প্রাদুর্ভাব চলাকালেই ৬৭৬ কোটি ১৯ লাখ ৫ হাজার টাকা মূল্যের কারেন্ট জাল জব্দ করেছে বাংলাদেশ নৌ পুলিশ। একইসঙ্গে শত শত টন জাটকাও জব্দ করা হচ্ছে। তারপরও শত শত টন জাটকা প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়েও বিক্রি হচ্ছে জাটকা। পদ্মা-যমুনাসহ মানিকগঞ্জের নদীগুলোতে গোপনে জাটকা নিধন এবং আরিচা, পাটুরিয়া, তরা ও বেউথাঘাটসহ জেলার বিভিন্ন মাছের আড়ত ও হাট-বাজারে জাটকা ইলিশ বিক্রির তথ্য পাওয়া গেছে। মানিকগঞ্জ জেলা মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি ফণীভূষণ মালো জানান, জাটকা মাছ ধরা বন্ধে নদী পাড়ের কিছু জেলেদের ৪০ কেজি করে চাল দিচ্ছে সরকার। এটি পর্যাপ্ত নয়। শুধু চাল হলেই তো হয় না। আরও সহায়তা প্রয়োজন। জেলেরা পেটের দায়েই মাছ ধরতে যায়। তিনি বলেন, মানিকগঞ্জে ২০ হাজারের উপরে জেলে পরিবার আছে। সরকারীভাবে কার্ড দেয়া হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার পরিবারকে। তাদের মধ্যেও অনেকে চাল পাচ্ছে না। গত মঙ্গলবার শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলায় অভিযান চালিয়ে ১৭০০ কেজি জাটকাসহ একটি ট্রাক জব্দ করেছে পুলিশ। একই দিন চাঁদপুরে সদর উপজেলায় হরিণা ফেরিঘাট এলাকা ১৬টি ড্রাম ভর্তি ৪৬০ কেজির এই জাটকা জব্দ করে নৌ পুলিশ। নৌ পুলিশের ডিআইজি মোঃ আতিকুল ইসলাম জানান, জাটকা রক্ষায় চাঁদপুরের মতো দেশের অন্য অভয়াশ্রমগুলোতেও তৎপর রয়েছে তার সদস্যরা। একাধিক নৌযান নদীতে টহল অব্যাহত রেখেছে নৌ পুলিশ। বরিশালের জেলে আবদুল ওহাব বলেন, ১ কেজি জাটকা ৪০টারও বেশি মাছ বড় হলে কত কেজি হবে কত মাছ বাড়বে এটি এখনও অনেকেই বুঝে না। মৎস্য অধিদফতর তথ্য মতে, ১০ ইঞ্চির ছোট সাইজের ইলিশ যাকে জাটকা নামেই চেনে সাধারণ মানুষ তা ১ নবেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ সময়ে জাটকা ধরা, বিক্রি, মজুদ ও পরিবহন করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের সশ্রম কারাদ- অথবা ৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ-ের বিধান রয়েছে। সরকার জেলেদের দিচ্ছে সহায়তা ॥ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় তথ্যে জানা গেছে, জাটকা ধরা থেকে বিরত রাখতে দেশের ২০ জেলার ৯৬ উপজেলায় ২৪ হাজার ১০৩ টন ভিজিএফ চাল বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এ সময় দেশের মোট ৩ লাখ ১ হাজার ২৮৮ জেলে পরিবার প্রতিমাসে ৪০ কেজি হারে আগামী দুই মাস (এপ্রিল ও মে) এ সহায়তা পাবেন। জেলা প্রশাসকরা ৭ মের মধ্যে এসব চাল যথানিয়মে উত্তোলন ও সংশ্লিষ্টদের মাঝে বিতরণ করবেন। নিষেধাজ্ঞা পরে মাছ ধরার প্রস্তুতি ॥ ইলিশ শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা শেষে হচ্ছে ৩০ এপ্রিল। ৫ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি থাকলেও ওইদিন মধ্যরাত থেকে ইলিশ ধরতে পারবেন জেলেরা। তবে, করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকায় স্বাস্থ্যবিধি মেনেই তাদের মাছ ধরার পরামর্শ দিয়েছে সরকার। আর মাছ ধরা থেকে বাজারজাত করা পর্যন্ত সার্বিক বিষয়ে নজরদারি করবেন সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তারা। একাধিক জেলায় কথা বলে জানা গেছে, এ সময় কালবৈশাখী ঝড়ের শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও পেটের দায়ে মাছ ধরতে যেতে হয় জেলেদের। তাই মাছ ধরার ক্ষেত্রে আগ্রহ যেমন তাকে তেমনি থাকে জীবন নিয়ে শঙ্কাও। চাঁদপুরের এক আড়তের মালিক বলেন সরকারের নিষেধ শেষ হলে জেলেরা জাল ফেলবে তবে এ সময় তো জীবনের ঝুঁকিও থাকে। জেলেদের অভাবের সংসারে ঝুঁকি থাকলেও যেতে হয় মাছ ধরতে। বাগেরহাটের উপকূলীয় মৎস্যজীবী কল্যাণ সমিতির সভাপতি শেখ ইদ্রিস আলী বলেন, এখন কালবৈশাখীর সময়। সাগর উত্তাল। করোনার আতঙ্কও আছে। তবু, জীবিকার টানে অনেক জেলেই ট্রলার নিয়ে মাছ ধরতে যাবেন। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকলেও দাদন (মহাজনের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেয়া) পরিশোধের জেলেরা মাছ ধরতে বাধ্য বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
×