ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিত না করার ফল

করোনা চিকিৎসকরাই সবচাইতে বড় বিপদে

প্রকাশিত: ০৯:৫৫, ২০ এপ্রিল ২০২০

 করোনা চিকিৎসকরাই সবচাইতে বড়  বিপদে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ কেবল বিশেষজ্ঞরা নন, খোদ বিশ^ স্বাস্থ্যসংস্থাই সব সময় সতর্ক করেছে একটি বিষয়ে। আর তা হলো প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিত করতে না পারলে সবচে’ বেশি সঙ্কটে পড়বেন করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের অগ্রনায়ক চিকিৎসকরা। দেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত থেকেই এ বিষয়ে উদ্বেগ ছিল। সঙ্কটের সর্বশেষ চিত্র বলছে, এত আহ্বান, সতর্কতার পরেও পরিস্থিতির পরিবর্তন করা গেলনা। এখন দেশে মোট করোনা রোগীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চিকিৎসকদের আক্রান্তের সংখ্যা। রবিবার পর্যন্ত দেশে করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন দুই হাজার ৪৫৬ জন। আর মারা গেছেন ৯১ জন। করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া চিকিৎসক ও চিকিৎসক সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, যে হারে চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মী আক্রান্ত হচ্ছেন তাতে আগামী কয়েক দিনে বিপদ আরও বাড়বে। হাসপাতালে করোনা চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ায় এমনটা হচ্ছে জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন পর্যন্ত আক্রান্তদের প্রায় ৮ শতাংশই চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মী। পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন পিপিইর অভাব, নিম্নমানের মাস্ক ও সার্বিক অব্যবস্থাপনার কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসকরা। মাত্র একদিন আগেই ব্র্যাকের একটি জরিপেও উঠে এসেছে সঙ্কটের চিত্র। যে রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের ২৫ শতাংশ এবং নার্সদের ৬০ শতাংশ এখনও পিপিই পাননি। যেসব স্বাস্থ্যকর্মী এসব পেয়েছেন তারাও সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান। ওই গবেষণায় জড়িত গবেষক বুশরা জেরিন ইসলাম বলেছেন, সামনের সারিতে থাকা ৭৫ ভাগ চিকিৎসক এবং ৪০ শতাংশ নার্স পিপিই পেয়েছেন। কিন্তু রেইনকোটের মতো যে পিপিই দেয়া হয়েছে, সেটা আদৌ কাজ করে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান তারা। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার সুপারিশ হচ্ছে, এগুলো একবার ব্যবহার করে ধ্বংস করতে হবে। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের পুনরায় ব্যবহার করার কথা বলা হচ্ছে। এসব বিষয় স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে বড় রকমের মানসিক চাপ তৈরি করছে। এদিকে প্রতিদিনই চিকিৎসকদের আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। গত দুই দিনেও বেড়েছে এ আক্রান্তের সংখ্যা। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ছয় জন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে দুইজন চিকিৎসক এরই মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বাকি চারজন বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আক্রান্ত এক চিকিৎসক জানান, বুধবার তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। পরীক্ষায় তার করোনা শনাক্ত হয়েছে। তার স্ত্রীও একজন চিকিৎসক। সোহরাওয়ার্দীর এ্যানেসথেসিয়া ও আইসিইউ বিভাগের ১৫ জনেরও বেশি ডাক্তার এখন কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। সরকার সম্প্রতি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের অন্যতম চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে মনোনীত করে। কিশোরগঞ্জে গত ৪৮ ঘণ্টায় নতুন করে ২৪ করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে ১৬ জনই চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী। এ নিয়ে জেলায় ১৯ চিকিৎসকসহ মোট ৭৬ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন ডাঃ মুজিবুর রহমান জানান, কিশোরগঞ্জ জেলা থেকে গত বুধবার ৯৩ জনের নমুনা পরীক্ষার জন্য মহাখালীর ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথে (আইপিএইচ) পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে ২৪ জনের কোভিড-১৯ পজিটিভ এসেছে। তাদের মধ্যে করিমগঞ্জ উপজেলায় আটজন, ভৈরব উপজেলায় পাঁচজন, তাড়াইল উপজেলায় পাঁচজন, সদর উপজেলায় চারজন এবং কুলিয়ারচর ও হোসেনপুর উপজেলায় একজন করে আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় হাসপাতাগুলোর চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এর মধ্যে করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১৪ এপ্রিল থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিশোরগঞ্জ সদর, ইটনা, কটিয়াদী, তাড়াইল ও ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও করোনা হানা দিয়েছে। তাই জেলাজুড়ে জরুরী স্বাস্থ্যসেবাও ধীরে ধীরে সীমিত হয়ে পড়েছে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ ঘটনায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডাঃ নুরুন্নবী লাইজু বলেন, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৯১ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তাদের মধ্যে তিনজন করোনায় আক্রান্ত। মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওই চিকিৎসক তাদের একজন। তিনি মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (রোগ নিয়ন্ত্রণ)। উপজেলার ইমাদপুর ইউনিয়নের ওই চিকিৎসক বর্তমানে আইসোলেশনে আছেন। ‘এন-৯৫ মাস্কের নামে যা দেয়া হচ্ছে তা নিম্নমানের এমন অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ‘ডাক্তাররাও এমন অভিযোগ করছেন। খাবার দাবার নিয়েও সমস্যা হচ্ছে। এগুলোর দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে বলেছি। এখন তো প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিষয়টি দেখভাল করছেন। ফলে আর সমস্যা হবে না। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সলান বলেছেন, ‘আমাদের যারা এগুলো ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে আছেন তারা মনে করেছিলেন, ডেঙ্গুর মতো পরিস্থিতি সামাল দিয়ে ফেলব। ফলে যে দুই মাস তারা সুযোগ পেয়েছিলেন তখন কিছুই করা হয়নি। যখন আক্রান্ত ধরা পড়ল তখনও শুধু মনোবল দিয়েই চিকিৎসকদের মাঠে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে তারা অনেক বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। এখন কিছু কাজ শুরু হয়েছে, কিন্তু ব্যবস্থাপনায় অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। সারাদেশে করোনায় চিকিৎসা দেয়া চিকিৎসকদের খোঁজখবর রাখছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সহ তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ডাঃ আতিকুজ্জামান ফিলিপ। তিনি রবিবার সন্ধ্যায় জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা অনেক সময় পেয়েছিলাম। কিন্তু প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিত করিনি। এখন মোট দেশে করোনার রোগীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চিকিৎসকদের আক্রান্তের সংখ্যা। রবিবার পর্যন্ত দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১২৩ জন চিকিৎসক। কোয়ারেন্টাইনে আছেন অন্তত তিন শতাধিক। এমন পরিস্থিতির কারণ কি? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কিন্তু প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিত না করে চিকিৎসকদের যুদ্ধে নামানো হয়েছে। যতটুকু সুরক্ষা সামগ্রী দেয়া হয়েছে তাও মানসম্মত নয়। এছাড়া ব্যবস্থাপনায় আরও সঙ্কট আছে। হাসপাতালে রোগীদের করোনা বা অন্য রোগীদের আলাদা করে ব্যবস্থা নেয়ার কোন পদক্ষেপ নেই। তথ্য লুকিয়ে রোগীদের চিকিৎসা নিতে আসাও একটা বড় সঙ্কট। সুরক্ষা সামগ্রী দেয়ার নামে কর্তৃপক্ষের অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলায় নোয়াখালীতে এক চিকিৎসককে শোকজ করা হয়েছে ইতোমধ্যেই। এ বিষয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার দেশের অসংখ্য মানুষ। এ চিকিৎসক নেতা বলেন, আমরা সব সময় খোঁজ রাখছি। আমাদের কথা স্পষ্ট। তার বিরুদ্ধে যদি কোন প্রশ্নবিদ্ধ পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করা হয় তাহলে আমরা বসে থাকব না।
×