ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা প্রতিরোধে আশা জাগাচ্ছে মানবিক উদ্যোগ

কথায় না বড় হয়ে কাজে মনোযোগ, সীমিত সাধ্য তবু ঝাঁপিয়ে পড়ছেন

প্রকাশিত: ১১:০৫, ২২ মার্চ ২০২০

কথায় না বড় হয়ে কাজে মনোযোগ, সীমিত সাধ্য তবু ঝাঁপিয়ে পড়ছেন

মোরসালিন মিজান ॥ আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে? কাজে বড় হওয়ার উপযুক্ত সময় এখন। যারা কেবল কথা বলার, তারা যথারীতি বলছেন। কাজের মানুষের সে সময় কই? সীমিত সাধ্য নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ছেন তারা। করোনা প্রতিরোধে এমন মানবিক উদ্যোগ দেখে আশাবাদী না হয়ে পারা যায় না। কোভিড ১৯ ভাইরাসে গোটা পৃথিবী ধুঁকছে। উন্নত দেশগুলোও কেমন যেন অসহায়। চীন লণ্ডভণ্ড। ইতালির মতো দেশে কান্না থামছে না। বিশ্ব পরিস্থিতি সাবধান করে দিচ্ছে বাংলাদেশকেও। ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশ অনেক বেশি ঝুঁকিতে। একবার এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে কোথায় গিয়ে নিশ্চিহ্ন হবে তা বলা খুব মুশকিল। এ অবস্থায় অনেকেই শুধু সরকার বা প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে আছেন। এর ওর সমালোচনা করে পার করে দিচ্ছেন মূল্যবান সময়। অথচ কাজের যারা তারা নিজের দায়িত্বটুকু পালনে ব্যস্ত। নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। দুর্যোগের কালে প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু মানবিক উদ্যোগের কথা জানা যাচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন করোনা প্রতিরোধে, সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। ব্যক্তিগত যোগাযোগ থেকে সংগঠিত হচ্ছেন অনেকে। কর্মসূচী নির্ধারণ করছেন। বাস্তবায়ন করছেন। শহুরে শিক্ষিতরাও যখন মওজুদে ব্যস্ত, কোয়ারেন্টাইন সেন্টার প্রতিষ্ঠায় যখন বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন, তখন সচেতন মানবিক মানুষের প্রকৃত করণীয় সম্পর্কে চমৎকার একটি ধারণা দিয়েছেন আশীষ চক্রবর্তী। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের তরুণ কর্মকর্তা নিজের নতুন ফ্ল্যাট কোয়ারেন্টাইন সেন্টার হিসেবে ব্যবহারের জন্য দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ফেসবুক পোস্টে তার দেয়া বক্তব্যটি এরকম: ‘আমার মায়ের অবসরের টাকায় এবং আমার যৌথ উদ্যোগে উত্তরা দিয়াবাড়ীতে রাজউকের একটা (একমাত্র) ফ্ল্যাট আছে। দুই সপ্তাহ আগেই এসি, ফ্রিজসহ বেশ কিছু জিনিস কিনেছি। সব সাজনোই আছে। আমার ফ্ল্যাটের চাবি আমি নিজেই স্বেচ্ছায় দিয়ে দিয়েছি (কেউ এখনো চায়নি)। কোন কিছুই আনি নাই। আমি জানি না সরকার এটা ব্যবহার করবেন কি-না? কিন্তু আমাদের সামান্য ত্যাগ যদি এই সময় কারো কাজে আসে আমি তাতেই খুশি। এখন সময় আমাদের বলার, আমার আমার করার না।’ এর চেয়ে মহৎ চিন্তা আর কী হতে পারে? আশীষের এ প্রস্তাব কতটা গ্রহণ করা যাবে তা সংশ্লিষ্টরা ভাল বলতে পারবেন। তবে তারও আগে মানবিক মানুষ হিসেবে তিনি যে দায় বোধ করেছেন তা এক কথায় অভূতপূর্ব। করোনা প্রতিরোধে রাশেদুজ্জামান নামের আরেক তরুণ কাজ করছেন বগুড়ায়। খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, জেলার সোনাতলা পৌরসভার ১১ মসজিদ ও ১ মন্দিরে দুটি করে হাত ধোয়ার সাবান এবং এক বোতল ডেটল বিতরণ করেছেন তিনি। সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনমতো এগুলো ব্যবহারের অনুরোধ করেছেন। প্রতি ওয়াক্ত নামাজ শেষে তরল ডেটল দিয়ে মসজিদের মেঝে মুছে নেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। কেন এসব? এমন প্রশ্নের উত্তরে তার জবাবÑকিছু সামাজিক কাজ করার ফলে সামান্য অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা আমাকে শিক্ষা দিয়েছে, মানুষের পাশে দাঁড়াও মানসিক প্রশান্তির জন্য, অন্য কিছুর প্রত্যাশায় নয়! বিভিন্ন সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানও কাজে নেমে পড়েছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দিন রাত কাজ করছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। জানা যায়, নিজস্ব পোশাক তৈরির কারখানায় তারা বর্তমানে মাস্ক তৈরি করছে। ফাউন্ডেশনের তৈরি মাস্ক বিনা মূল্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে বিতরণ করা হচ্ছে। একইভাবে প্রশিক্ষিতরা তৈরি করছেন হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও জীবাণু নাশক। করোনা প্রতিরোধে জরুরী এসব উপকরণ নিয়ে ঢাকার রাস্তায়, অফিসে উপাসনালয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন তারা। বিনা পয়সায় সাধ্যমতো সেবা দিচ্ছেন। সাধারণ পথচারী ও নি¤œ আয়ের মানুষগুলোকে জীবাণু মুক্ত রাখতে চেষ্টার অন্ত নেই তাদের। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মিরপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের পাশে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফার্মগেট, মিরপুর ১০, আগারগাঁও, শাহবাগসহ বিভিন্ন জায়গায় পানির ট্যাপ ও বেসিন বসিয়েছে তারা। এসব জায়গায় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা কঠিন কাজ। তাই সড়কের পাশে বড় ড্রামে পরিষ্কার পানি রাখতেও দেখা যাচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, ফাউন্ডেশন চিকিৎসকদের জন্য ভইরাস প্রতিরোধক এপ্রোণ তৈরি করছে। বিনামূল্যে বিতরণ করছে চিকিৎসকদের মধ্যে। নিজেদের মহিলা হোস্টেলে নারী ডাক্তার ও নার্সদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। প্রয়োজন হলে তাদের খাবারের ব্যবস্থাও করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। ফাউন্ডেশনের কাজ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় তাদের ফেসবুক পেজে গিয়ে। সেখানে কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানানোসহ জরুরী পোস্ট দেয়া হচ্ছে। একটি পোস্টে সাধারণ মানুষকে কাজে নামার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, জনসাধারণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়া করোনা প্রতিরোধ সম্ভব নয়। তারা কীভাবে কাজ করছেন, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা জীবাণু নাশক কোন প্রক্রিয়ায় তৈরি করছেন ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত তুলে সকলকে যার যার জায়গা থেকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। ফউন্ডেশনের আরেকটি পোস্টে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, আমি আপনি মিলেই সরকার। আমরা নিজেদের এই দেশের অংশ মনে করেই উদ্যোগ নেই। সরকারের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে বসে থাকার পক্ষে নই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ডেমরা ল’কলেজের একটি উদ্যোগও প্রশংসা কুড়িয়েছে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জাবীউল্লাহ স্বাক্ষরিত এক নোটিসে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, ‘আপনারা কলেজের এক মাসের বেতনের সমপরিমাণ টাকা দিয়ে চাল ডাল সাবান ইত্যাদি কিনে আপনার ঠিক আশপাশে থাকে এমন দুটি দুস্থ পরিবারের মধ্যে বিতরণ করেন।’ উদ্যোগ সফল করার স্বার্থে এক মাসের বেতন মওকুফেরও ঘোষণা এসেছে কলেজের পক্ষ থেকে। দুর্যোগের কালে অতীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এবার সীমিত পরিসরে হলেও, কিছু কাজ হয়েছে। হচ্ছে। প্রথম উদ্যোগটি নিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ। শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে সেখানে কাজ করেন একদল শিক্ষার্থী। তাদের তৈরি হ্যান্ড স্যানিটাইজার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। অল্পদিন কাজ করলেও, এ উদ্যোগের মাধ্যমে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর একটি বার্তা তারা সবাইকে দিতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে নোভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে কাজ করে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের মতো রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে তা বিনামূল্যে বিতরণ করেছে। একই উদ্যোগ নিয়েছে ছাত্র ও যুব ইউনিয়ন। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এসব হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি, রসায়ন ও প্রাণ রসায়নের শিক্ষার্থীদের ২৫ জনের একটি দল এগুলো তৈরি করেন। বর্তমানে পল্টনে দলীয় কার্যালয়ে তারা কাজ করছে বলে জানা যায়। নিজের দেশ ও জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যক্তিদের কেউ কেউ ঘরে বসে সচেতনতামূলক পরামর্শ দিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া এসব পরামর্শ সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। এ ক্ষেত্রে বেশি এগিয়ে আসছেন বিভিন্ন অঙ্গনের তারকা শিল্পীরা। এমনকি বিদেশে বসেও অনেকে এ নিয়ে কথা বলছেন। অভিনয় শিল্পী টনি ডায়েস এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, সারা পৃথিবী এই মুহূর্তে একটা বড় দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই যুদ্ধে লিপ্ত। আমাদের খামখেয়ালির জন্য কোভিড ১৯ আমাদের অজান্তে শরীরে ঢুকে পড়ছে। আমরা বাঙালীরা বেশ আড্ডাবাজ। চায়ের দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতে পছন্দ করি। যে কোন অজুহাতে পার্টির আয়োজন করি। আমরা দলবদ্ধভাবে ভ্যাকেশনে যেতে পছন্দ করি। এ পর্যায়ে সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, আমরা যদি এ যুদ্ধে জয়ী হতে চাই এসবের ঠিক উল্টোটা করতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ শুনতে হবে। নিউইয়র্ক পৃথিবীর রাজধানী মন্তব্য করে তিনি বলেন, অথচ এখানে সব বন্ধ। উন্নত দেশে সরকারের কথা সবাই শুনছেন। আমরা বাঙালীরা কেন শুনব না? ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে নেয়া এমন আরও অনেক উদ্যোগ করোনাভাইরাসের প্রবল ঝুঁকির মধ্যেও আশা জাগাচ্ছে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। মানুষ হিসেবে আমরা কি সে দায় অনুভব করছি?
×