ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

এম নজরুল ইসলাম

যার নামের ওপর কখনও ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া

প্রকাশিত: ০৭:৫৬, ১৭ মার্চ ২০২০

 যার নামের ওপর কখনও ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া

একজন মানুষ যে দেশ ও জাতির সমার্থক শব্দ হয়ে উঠতে পারেন, তার উদাহরণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখাতে আমরা পাই, ‘...মানুষ হয়ে জন্মলাভ করে আবার চাইবে কে, বিশ্রাম পাব কোথায়। মুক্তি পেতে হবে, মুক্তি দিতে হবে, এই-যে তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য’-এ কথাগুলো যে মহান বাঙালীর জীবনে ধ্রুবসত্য হয়ে দেখা দিয়েছিল তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী তিনি। আমাদের জাতির পিতা। রাজনীতির এক ঐতিহাসিক মহাকাব্য রচনা করে একটি পাতাঝরা বসন্ত বিকেলে তিনি ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন ইতিহাসের মোড়। একজন মানুষ দিনে দিনে নিজেকে চালকের আসনে এনে একটি আন্দোলনকে জনগণের প্রাণের দাবিতে পরিণত করতে পারেন, বিশ্বের ইতিহাসে এমন বিরল উদাহরণ তা তাঁরই সৃষ্টি। আজ তাঁর জন্মদিন। পোয়েট অব পলিটিক্স, আমাদের স্বাধীনতার মহাকাব্যের রচয়িতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার নিভৃত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। গ্রামবাংলার সবুজ শ্যামল ও নিবিড় প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠা শেখ মুজিব ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি ও সমাজ সচেতন। অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার ও প্রতিবাদী। শৈশবেই পাওয়া যায় তাঁর নেতৃত্বের পরিচয়। তিনি স্কুলজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়। কৈশোরেই কারাবাস শুরু। অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদান করায় তিনি জীবনে প্রথম গ্রেফতার হন। ম্যাট্রিক পাসের পর কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হকসহ তৎকালীন প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা। নেতৃত্বের গুণে টুঙ্গিপাড়ার খোকা একদিন হয়ে ওঠেন বাঙালী জাতির প্রতীক। বাঙালীর জাতিসত্তার ইতিহাসের সমান্তরালে উচ্চারিত তাঁর নাম। একটি দেশ, একটি জাতি, একটি পতাকা-এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের নেতা। আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের অর্জন এই স্বাধীন বাংলাদেশ। সেই সংগ্রামে তিনি ছিলেন নেতা। তাঁর নামে পরিচালিত হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধ তো একদিনের ব্যাপার নয়। হাজার বছরের পরাধীন জাতিকে একটি যুদ্ধের জন্য, একটি ভূখন্ডের স্বাধীনতার জন্য, স্বতন্ত্র জাতিসত্তার জন্য তৈরি করতে হয়েছে। প্রয়োজন হয়েছে রাজনৈতিক প্রস্তুতির। জাতিকে তৈরি করতে হয়েছে রাজনৈতিক কর্মকা-ের ভেতর দিয়ে। বাঙালী জাতি বার বার তার স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়েছে। আলাদা জাতিসত্তার পরিচয় দিতেও পিছপা হয়নি। যে বাঙালী স্বতন্ত্র পরিচয় তুলে ধরে নিজেদের মতো করে, সেই বাঙালীকে সংগঠিত রাখার কঠিন কাজটি বঙ্গবন্ধু করেন দক্ষ হাতে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম। বাঙালীদের ওপর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানীদের খড়গ রুখতে তিনি প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৪৮ সালে গঠন করেন ছাত্রলীগ। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নবগঠিত এই আওয়ামী লীগের নামকরণে প্রথমবারের মতো আঁতকে ওঠে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। এরপর থেকেই চলে অবিরাম আন্দোলন। ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটায় যুক্তফ্রন্ট। বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা বাঙালীর এই বিজয়কে মেনে নিতে না পেরে ৯২-ক ধারা জারি করে এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ষাটের দশকের শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলের একটি কনভেনশনে বঙ্গবন্ধু বাঙালীর মুক্তিসনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন। ওই ৬ দফা পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালী বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। ফলে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের ম্যান্ডেট লাভ করে। তবে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালীর এ নির্বাচনী বিজয়কে মেনে নেয়নি। বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রথমে স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ দেন। সব আয়োজন শেষ। আর অপেক্ষা নয়। ১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হয় নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবন থেকে ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এরপর যে ইতিহাস রচিত হলো, সে ইতিহাস সবারই জানা। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক তিনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাদাতা। জাতির আত্মপরিচয় এনে দিয়েছিলেন বলেই জাতির পিতা তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্বদেশ বিষয়ক নিবন্ধের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘মানুষের একটা দিক আছে যেখানে বিষয়বুদ্ধি নিয়ে সে সিদ্ধি খোঁজে। সেইখানে আপন ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা নির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত। সেখানে সে জীবরূপে বাঁচতে চায়। কিন্তু মানুষের আর-একটা দিক আছে যা এই ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে। সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে যাকে বলি ক্ষতি তাই লাভ, যাকে বলি মৃত্যু সেই অমরতা। সেখানে বর্তমান কালের জন্য বস্তু-সংগ্রহ করার চেয়ে অনিশ্চিত কালের উদ্দেশে আত্মত্যাগ করার মূল্য বেশি। সেখানে জ্ঞান উপস্থিত-প্রয়োজনের সীমা পেরিয়ে যায়, কর্ম স্বার্থের প্রবণতাকে অস্বীকার করে। সেখানে আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে যে বড় জীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়।’ বঙ্গবন্ধুর জীবনে আমরা মানুষের জীবনের এই দিকটিকে খুঁজে পাই। তিনি ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে। অনিশ্চিত কালের উদ্দেশে তাঁর আত্মত্যাগ। মৃত্যু তাঁকে দিয়েছে অমরতা। এই একই ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও লিখেছেন, ‘আমাদের অন্তরে এমন একজন আছেন যিনি মানব অথচ যিনি ব্যক্তিগত মানবকে অতিক্রম করে ‘সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট :’। তিনি সর্বজনীন সর্বকালীন মানব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই সর্বজনীন ও সর্বকালীন বাঙালী, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘যাঁর আকর্ষণে মানুষের চিন্তায় ভাবে কর্মে সর্বজনীনতার আবির্ভাব।’ এই বাংলার শ্যামল প্রান্তরে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর কথায় আশ্চর্য এক জাদু ছিল। আকৃষ্ট করতে পারতেন মানুষকে। ভালবাসতেন দেশের মানুষকে। তাঁর চিন্তা ও চেতনাজুড়ে ছিল বাংলা ও বাঙালী। আজীবন বাঙালীর কল্যাণ চিন্তা করেছেন তিনি। বাঙালীকে বিশ্বের একটি মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। জাতিকে তিনি সেই মর্যাদার স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তিনি বাঙালী জাতিকে একটি অভীষ্ট লক্ষ্যে স্থির করতে পেরেছিলেন। আজও সব সঙ্কটে তিনিই প্রেরণা আমাদের। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও প্রেরণাদাতা, মহান পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সেই মহান মানুষকে, কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় ‘যার নামের ওপর কখনও ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া।’ লেখক : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ভিয়েনাপ্রবাসী মানবাধিকারকর্মী [email protected]
×